পরিবেশ কি?
পরিবেশ হলো পারিপার্শ্বিক অবস্থা। পারিপার্শ্বিক যেসব দৃশ্যমান ও অদৃশ্যমান উপাদানসমূহ মানুষের জীবন ও জীবিকার উপর প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে প্রভাব বিস্তার করে তাকে পরিবেশ বলে। সহজভাবে বলা যায়, যেসব পারিপার্শ্বিক দৃশ্য ও অদৃশ্য অবস্থা বা উপাদান বা উপকরণ মানুষের জীবনযাত্রা ও কর্মধারার উপর প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে প্রভাব বিস্তার করে সম্মিলিতভাবে তাই হচ্ছে পরিবেশ। সুষ্ঠু পরিবেশ কর্মপ্রচেষ্টা বৃদ্ধি করে সুষ্ঠু চিন্তাধারা গড়ে তোলে এবং জীবনযাত্রার মানকে উন্নত করে। তাই পরিবেশকে বাদ দিয়ে কোন কাজ সঠিকভাবে করা সম্ভব নয়।
আরও পড়ুন: বাংলাদেশের দারিদ্র্য দূরীকরণের উপায় সমূহ আলোচনা কর
পরিবেশের প্রকারভেদ
পরিবেশ প্রধানত দুই প্রকার। যথা :
১। প্রাকৃতিক পরিবেশ (Natural environment) : কোনো দেশের প্রাকৃতিক অবস্থান, জলবায়ু, নদ-নদী, ভূ-প্রকৃতি প্রভৃতি প্রাকৃতিক সম্পদসমূহের সমষ্টিকে সে দেশের প্রাকৃতিক পরিবেশ বলে। মানুষের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে প্রাকৃতিক পরিবেশের বিশেষ প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। প্রকৃতি মানুষের পেশা ও জীবনযাত্রার মান নিয়ন্ত্রণ করে। দেশের জনগণের কর্মোদ্যম এবং চারিত্রিক গঠনও প্রাকৃতিক পরিবেশ দ্বারা প্রভাবিত হয়।
২। সামাজিক পরিবেশ (Social environment) : সাধারণত সামাজিক পদ্ধতি ও ধর্মীয় রীতি-নীতিকে সামাজিক পরিবেশ। পরিবেশ মানুষের চিন্তা-ভাবনা ও ধ্যান ধারণাকে নিয়ন্ত্রণ করে জাতির কর্মোদ্যম ও চরিত্র গঠনে প্রভাব বিস্তার। করে। মানুষের অভ্যাস, রুচি, আচার-আচরণ, শিক্ষা, জীবনযাত্রার ধরন প্রভৃতি সামাজিক পরিবেশ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। দেশের ধর্মীয় ও সামাজিক পরিবেশ জনগণের মানসিক অবস্থা ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের গতি নির্দেশ করে। সমাজ ব্যবস্থা সমাজের বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের আপেক্ষিক গুরুত্ব এবং দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে তাদের ভূমিকা নির্ণয় করে। সুতরাং অর্থনৈতিক উন্নয়নে ধর্মীয় ও সামাজিক পরিবেশের গুরুত্ব অনস্বীকার্য।
পরিবেশ পরিবর্তনের কারণ
স্বাভাবিক এবং অস্বাভাবিক এ দু’প্রক্রিয়াই সাধারণত পরিবেশ পরিবর্তন হয়। স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় পরিবেশের কাঠামোগত পরিবর্তন হয় এবং অস্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় ধ্বংস, ক্ষয় ও ক্ষয়ক্ষতির মাধ্যমে পরিবর্তন হয়। নিচে পরিবেশ পরিবর্তনের কারণগুলো আলোচনা করা হলো :
১। জনসংখ্যার আধিক্য : পরিবেশ পরিবর্তনের অন্যতম কারণ হলো জনসংখ্যার আধিক্য। জাতিসংঘের হিসাব মতে বর্তমান বিশ্বের জনসংখ্যা ৬৫০ কোটির অধিক যার চাপ পড়ছে পরিবেশের উপর। তাই বর্তমানে জনসংখ্যা আশীর্বাদ না হয়ে অভিশাপ হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছে। খাদ্যের চাহিদা মিটাতে মানুষ অতিমাত্রায় পরিবেশের উপর নির্ভরশীল। তদুপরি জনসংখ্যার চাপ পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করছে। তাই জনসংখ্যা পরিবেশপরিবর্তন ও দূষণের ক্ষেত্রে এক বিরাট ভূমিকা পালন করছে।
২। বায়ু দুষণ : ইংল্যান্ডের শিল্প বিপ্লবের পর থেকেই কল-কারখানার নির্গত কালো ধোঁয়া, বর্জ্য, রাসায়নিক পদার্থ প্রভৃতি পরিবেশে ছড়িয়ে পড়ে এবং পরিবেশ দূষণ হতে থাকে। শিল্পের প্রসার ও জনসংখ্যার বৃদ্ধির ফলে বায়ু দূষণ হচ্ছে। পৃথিবীতে প্রতিদিন লাখ লাখ ঘনফুট কার্বন-ডাই অক্সাইড বাতাসের সাথে মিশে যাচ্ছে। ফলে বায়ু দূষণ হচ্ছে এবং পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে।
৩। পানি দূষণ : পানির অপর নাম জীবন। কিন্তু যেখানে জীবন নিহিত, সেখানেই আজ মরণব্যাধি লুকিয়ে আছে। শিল্প- কারখানার বর্জ্য, রাসায়নিক পদার্থ, লঞ্চ, স্টিমার, বড় জাহাজ বা রণতরী প্রভৃতি থেকে নির্গত রাসায়নিক বর্জ্য মানুষের জীবন নামক নিরাপদ পানিকে দিন দিন বিষে পরিণত করছে। যার ফলে প্রাণী ও উদ্ভিদ ভয়াবহ ক্ষতির সম্মুখীন এবং এতে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে।
৪। শব্দ দূষণ : মানুষের শ্রবণেন্দ্রিয় ২০ থেকে ৪০ ডেসিবেল মাত্রায় শব্দে স্বাভাবিক ও স্বচ্ছন্দ ক্রিয়া করতে পারে। কিন্তু যেখানে যানবাহন ও কলকারখানার শব্দ ৬০ থেকে ৭০ ডেসিবল সেখানকার মানুষ দীর্ঘস্থায়ী স্নায়ুবিক অসুস্থতা, অনিদ্রা, রক্তচাপ, মানসিক অস্থিরতায় ভোগে। এতে শব্দ দূষণের ফলে পরিবেশের উপর ক্ষতিকর প্রভাব পড়ছে। পানির মাধ্যমে মাটির গভীরে প্রবেশ করে ভূ-পৃষ্ঠের অভ্যন্তরে গ্যাসীয় পদার্থের চাপ সৃষ্টি করে এবং এতে বিভিন্ন ।
৫। মাটি দূষণ : অল্প জমিতে অধিক উৎপাদনের লক্ষ্যে মানুষ জমিতে রাসায়নিক সার, কীটনাশক ব্যবহারের ফলে তা রাসায়নিক পদার্থের বিক্রিয়ার ফলে ভূমিকম্পের সম্ভাবনা ও মাত্রা বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখে। যা পরিবেশের জন্য মারাত্মক বিপর্যয়ের কারণ।
৬। তেজস্ক্রিয় দূষণ : বিভিন্ন দেশে যুদ্ধ চলাকালে রাসায়নিক বোমার ব্যবহার, অস্ত্র কারখানা ধ্বংস, পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা প্রভৃতি কারণে পরিবেশে তেজস্ক্রিয় পদার্থ ছড়িয়ে পড়ে পরিবেশকে দূষিত করছে।
৭। বৈশ্বয়িক : গ্রিন হাউস গ্যাস নির্গমনের ফলে ভূ-পৃষ্ঠের উপরিভাগে অবস্থিত ওজোন স্তর ছিদ্র হয়ে সূর্যের আর্ক তেজস্ক্রিয় বেগুনি রশ্মি পৃথিবীর পৃষ্ঠে বিনা বাধায় পতিত হচ্ছে এবং ধূলি, কার্বন ও অন্যান্য গ্যাসীয় পদার্থের সাথে ভূ-পৃষ্ঠে অধিক তাপ আটকা পড়ছে যার ফলে পৃথিবী পৃষ্ঠের তাপ বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলশ্রুতিতে দুই মেরু ও হিমালয় পর্বতশৃঙ্গে জমাট বাঁধা বরফ গলতে শুরু করেছে। এতে পরিবেশের চরম বিপর্যয় হবে।
৮। বনশূন্যতা ও মরুকরণ : ব্যাপকভাবে বৃক্ষ নিধন করার ফলে ভূমিক্ষয়, নদীর ভাঙ্গন বৃদ্ধি ও আবহাওয়ার বিরূপ প্রতিক্রিয়ার কারণে প্রকৃতি ও পরিবেশ তার ভারসাম্য হারিয়ে ফেলছে। ব্যাপক বৃক্ষ নিধনের ফলে এশিয়া, আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকার বিশাল অংশ মরুভূমিতে পরিণত হয়েছে।
৯ । অপরিকল্পিত নগরায়ন : নগরায়নের সাথে যে সব পরিবেশগত সমস্যা জড়িত তা হচ্ছে-কৃষি জমি হ্রাস, বর্জ্য অপসারণ সমস্যা, বাসস্থানের অভাব, পানি ও বায়ু দূষণ ইত্যাদি।
১০। প্লাস্টিক ও অন্যান্য সামগ্রীর ব্যবহার : প্লাস্টিক দীর্ঘকাল অক্ষত থাকে, তাই মাটির জন্য এটি ক্ষতিকর। এটি মাটির ব্যাকটেরিয়া ধ্বংস করে এবং সূর্যালোককে মাটিতে পৌঁছেতে বাধা দেয়। ফলে ব্যাপকভাবে পরিবেশ দূষিত হয়। পরিশেষে বলা যায়, প্রাকৃতিক পরিবেশ দূষণের কারণে সামাজিক পরিবেশও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।