মুদ্রাস্ফীতির ফলাফল (Influence of Inflation)
মুদ্রাস্ফীতির কারণে দেশের ভূমিহীন কৃষক, গরিব জনগণ, মধ্যবিত্ত চাকরিজীবী ও সীমিত আয়ের জনগণের পক্ষে জীবনযাত্রা নির্বাহ করা খুবই কঠিন হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশে মুদ্রাস্ফীতির ফলাফল নিচে আলোচনা করা হলো :
১। উৎপাদনের উপর প্রভাব
বাংলাদেশের উৎপাদনের বিভিন্ন খাতের উপর মুদ্রাস্ফীতির প্রভাব আলোচনা করা হলো :
(ক) কৃষির উপর প্রভাব : বাংলাদেশে মুদ্রাস্ফীতির ফলে কৃষি উপকরণের মূল্য যতটুকু বৃদ্ধি পায় তার তুলনায় কৃষিপণ্যের মূল্য অনেক বেশি বৃদ্ধি পায়। তবে এক্ষেত্রে সচ্ছল কৃষকেরা লাভবান হলেও দরিদ্র ও ক্ষুদ্র কৃষকেরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
(খ) শিল্পের উপর প্রভাব : শিল্পোৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণ মূল্য অপেক্ষা উৎপাদিত পণ্যের মূল্য অনেক বেশি বৃদ্ধি পায় । ফলে মালিকপক্ষ লাভবান হলেও শ্রমিক শ্রেণি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কারণ, মজুরি বৃদ্ধির তুলনায় পণ্যের মূল্য অনেক বেশি বৃদ্ধি পায়।
(গ) সেবার উপর প্রভাব : সেবা উৎপাদনের উপর মুদ্রাস্ফীতির অনুকূল প্রভাব ফেলেছে। তাই পরিবহন, যোগাযোগ, চিকিৎসা, নার্সিং, শিক্ষা, আপ্যায়ন প্রভৃতি সেবার পরিমাণ ও গুণগত মান বৃদ্ধি পাচ্ছে।
আরও পড়ুন: মুদ্রাস্ফীতি কি বা কাকে বলে ? বাংলাদেশে মুদ্রাস্ফীতির কারণ গুলো কি কি?
২। আয় বণ্টনের উপর প্রভাব
মুদ্রাস্ফীতির কারণে আয় ও সম্পদ বণ্টনের ব্যাপক পরিবর্তনে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণির লোকের মধ্যে কেউ লাভবান আবার কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যথা :
(ক) কৃষিজীবী : মুদ্রাস্ফীতির ফলে কৃষি উপকরণের তুলনায় কৃষিপণ্যের মূল্য বেশি বৃদ্ধির কারণে ধনী কৃষকেরা লাভবান হলেও দরিদ্র ও প্রান্তিক কৃষকেরা উৎপাদিত পণ্য দিয়ে তাদের চাহিদা পূরণে ব্যর্থ হওয়ায় তারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
(খ) শিল্পোদ্যোক্তা : মুদ্রাস্ফীতির ফলে শিল্পজাত দ্রব্যের মূল্য অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পাওয়ায় শিল্পোদ্যোক্তাগণ অধিক লাভবান হয়।
(গ) শ্রমিক : মুদ্রাস্ফীতির কারণে শ্রমিক শ্রেণি বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কারণ মজুরিহার বৃদ্ধি পেলেও সেবা ও দ্রব্যের তুলনায় তা অতি নগণ্য।
(ঘ) নির্দিষ্ট আয়ের লোক : নির্দিষ্ট আয়ের লোকদের বেতন ও মজুরি বৃদ্ধি পেলেও তা দামস্তর বৃদ্ধির তুলনায় অনেক কম। ফলে নির্দিষ্ট আয়ের লোক মুদ্রাস্ফীতির কারণে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
(ঙ) ঋণদাতা ও ঋণগ্রহীতা : মুদ্রাস্ফীতির ফলে ঋণগ্রহীতারা লাভবান হয় এবং ঋণদাতারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কারণ, যে পরিমাণ টাকা ঋণ দেয়া হয়, ফেরত পাওয়ার সময় সে পরিমাণ টাকা ফেরত পেলেও তা দিয়ে আগের তুলনায় কম দ্রব্য ক্রয় করা যায়।
৩। কর্মসংস্থানের উপর প্রভাব
মুদ্রাস্ফীতির কারণে ব্যবসায় বাণিজ্যের সম্প্রসারণ ঘটে। বেশি মুনাফা লাভের আশায় নতুন নতুন শিল্প স্থাপন করা হয় । অফিস আদালতের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। ফলে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়।
পরিশেষে বলা যায়, বাংলাদেশে মুদ্রাস্ফীতি তথা দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কারণে দৈনন্দিন জীবনের সাথে সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবনেও অস্থিরতা, অনিশ্চয়তা ও হতাশা বিরাজ করছে। তাই অর্থনৈতিক অস্থিরতা দূর করার জন্য মুদ্রাস্ফীতি ও দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি রোধ করা একান্ত জরুরি।
গড় মূল্যস্তরকে বলা হয় দ্রব্যমূল্য। এর সাথে মানুষের জীবনযাত্রার মান, মুদ্রাস্ফীতি, অর্থনৈতিক উন্নয়ন, জনস্বাস্থ্য, শিক্ষা ইত্যাদি জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো গভীরভাবে সম্পর্কযুক্ত। বাংলাদেশে এ ধারণাটি আরো বেশি তাৎপর্যপূর্ণ। এদেশের মোট জনসংখ্যার একটি বড় অংশ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে। ফলশ্রুতিতে দ্রব্যমূল্য ক্রমাগত বাড়তে থাকলে দাহিতা জনগোষ্ঠী বিশেষত নিম্ন আয়ের মানুষের দৈনন্দিন জীবন নির্বাহ কঠিন হয়ে পড়ে। তাই দ্রব্যমূল্যের মাত্রা তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর জন্য স্পর্শকাতর।