বাংলাদেশ কি উন্নয়নশীল দেশ নাকি উন্নত নাকি অনুন্নত দেশ? এই প্রশ্নটি অনেকের মনে ঘুরপাক খায়। আবার উন্নয়নশীল দেশ কাকে বলে, অনুন্নত দেশ কাকে বলে এবং উন্নত দেশই বা কাকে বলে এই নিয়ে অনেকের কনফিউশন থাকে। আজকের লেখায় এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করে বুঝিয়ে দেয়া হবে। এবং সেই সাথে বাংলাদেশ কি উন্নয়নশীল দেশ কিনা তা পরীক্ষা করা হবে।
বাংলাদেশ উন্নয়নশীল নাকি উন্নত দেশ?
যেসব দেশের জনগণের মাথাপিছু আয় অনেক বেশি, জীবনযাত্রার মান অনেক উন্নত এবং বেকারত্বের হার শূন্য তাকে উন্নত দেশ বলে।
অন্যদিকে যেসব দেশের জনগণের মাথাপিছু আয় খুবই কম, জীবনযাত্রার মান খুব নিম্ন এবং বেকারত্বে জর্জরিত সেসব দেশকে অনুন্নত দেশ বলে ।
অনুন্নত দেশের অর্থনীতিতে স্থবির অবস্থা বিরাজমান। আবার যেসব দেশ মন্থর গতিতে হলেও ক্রমন্বয়ে উন্নয়নের দিকে ধাবিত হচ্ছে তাকে উন্নয়নশীল দেশ বলে।
সম্প্রতি বাংলাদেশ স্থবির অর্থনৈতিক অবস্থা কাটিয়ে কৃষি, শিল্প ও ব্যবসায়-বাণিজ্যসহ প্রতিটি ক্ষেত্রে গতিশীল অর্থনৈতিক অবস্থার দিকে ধাবিত হচ্ছে। কাজেই প্রকৃত অর্থে বাংলাদেশ উন্নত, অনুন্নত না উন্নয়নশীল দেশ এটা বলার আগে বাংলাদেশের অর্থনীতির বৈশিষ্ট্যসমূহ আলোচনা করতে হবে।
নিচে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক বৈশিষ্ট্যসমূহ আলোচনা করা হলো :
১। স্বল্প মাথাপিছু আয় : পৃথিবীর দরিদ্র দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। এদেশের মানুষের মাথাপিছু আয় কম। জনসংখ্যার এক বিরাট অংশ বেকার। প্রাকৃতিক সম্পদের ব্যবহারও যথাযথ নয়। ২০০৩-২০০৪ সালে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ছিল ৪১৮ মার্কিন ডলার। ২০১০-২০১১ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮১৬ মার্কিন ডলার। সুতরাং, উন্নত দেশের তুলনায় মাথাপিছু আয় কম হলেও এই পরিমাণ ধীরে ধীরে বাড়ছে। তবে বর্তমানে (২০২৩-২৪) বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় হলো ২৮২৪ ডলার। (সূত্র: প্রথম আলো)
২। নিম্ন জীবনযাত্রার মান : বাংলাদেশের জনগণের মাথাপিছু আয় কম বলে তাদের জীবনযাত্রার মানও অত্যন্ত নিম্ন যেখানে একজন সুস্থ মানুষের দৈনিক ৩০০০-৩৫০০ ক্যালরি খাদ্যমান দরকার সেখানে বাংলাদেশের মানুষ গড় খাদ্যমান পাচ্ছে ১৫০০ ক্যালরিরও কম। বাংলাদেশে এখনও ৪০% মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করছে।
৩। কৃষির উপর নির্ভরশীলতা : বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ হওয়ায় আমাদের অর্থনীতিও কৃষির উপর নির্ভরশীল। তবে আশার কথা হচ্ছে কৃষিখাতের উপর শ্রমশক্তির নির্ভরশীলতা ক্রমশও হ্রাস পাচ্ছে ।
৪ । অনুন্নত কৃষি ব্যবস্থা : বাংলাদেশের কৃষিব্যবস্থা অত্যন্ত অনুন্নত। আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতি ও রাসায়নিক সারের ব্যবহার আমাদের কৃষিতে এখনও ব্যাপকভাবে প্রসার লাভ করে নি। তা কৃষি উৎপাদন খুবই কম। তবে দেশে জনগণের খাদ্য সমস্যা দূরীকরণ ও দারিদ্র্য বিমোচনের লক্ষ্যে বর্তমানে সরকার লাগসই প্রযুক্তিনির্ভর কৃষি ব্যবস্থার উপর গুরুত্ব দিচ্ছেন।।
৫। স্বল্প পুঁজি : বাংলাদেশের জনগণ হতদরিদ্র। তাই তাদের মাথাপিছু আয় কম, ফলে সঞ্চয়ও কম। এতে মূলধন গঠন সম্ভব হচ্ছে না। তাই প্রাকৃতিক সম্পদ ও জনশক্তির পূর্ণ ব্যবহার থেকে বাংলাদেশ বঞ্চিত ।
৬। অধিক জনসংখ্যা : অধিক জনসংখ্যার কারণে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ব্যাহত হচ্ছে। তবে পূর্বে যেখানে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ২.৩% ছিল বর্তমানে ১.৩২%। এতে বুঝা যাচ্ছে ধীরে ধীরে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার হ্রাস পাচ্ছে।
৭। শিল্পে অনগ্রসর : বাংলাদেশ শিল্পে অত্যন্ত অনগ্রসর। ব্রিটিশ কিংবা পাকিস্তান আমলে আমাদের দেশে কোনো নতুন শিল্প গড়ে উঠে নি। তবে বর্তমানে যুগের সাথে চাহিদা মিলিয়ে দেশে শিল্পখাতের গুরুত্ব ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং জিডিপি-তে এর অবদানও বাড়ছে।
৮। বেকার সমস্যা : অত্যধিক জনসংখ্যার কারণে বাংলাদেশে বেকার সমস্যা অত্যন্ত প্রকট। বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় ১.৫ কোটি কর্মক্ষম লোক বেকার রয়েছে।
৯। ছদ্মবেশী বেকার : পর্যাপ্ত পরিমাণে শিল্পায়নের ব্যবস্থা না থাকায় অনেকেই কৃষির উপর ভিড় করছে। প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি লোক কৃষিকাজে জড়িত। এদের অর্ধেককে সরিয়ে নিলেও কৃষি উৎপাদনের তেমন ক্ষতি হবে না। এরা ছদ্মবেশী বেকার। বাংলাদেশে এর পরিমাণ ২৫%-৩০%। এ কারণে আমাদের মাথাপিছু আয় কম।
১০। কারিগরি ও প্রযুক্তিগত জ্ঞানের অভাব : স্বল্প আয়, জীবনযাত্রার নিম্নমান, কারিগরি ও প্রযুক্তিগত শিক্ষাকেন্দ্রের অপ্রতুলতা ইত্যাদি কারণে বাংলাদেশ দক্ষ ও কর্মকুশলতা সম্পন্ন শ্রমিকের অভাব রয়েছে যা অর্থনৈতিক উন্নয়নের অন্তরায়। তবে বর্তমানে এখানে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়াতে প্রযুক্তিগত জ্ঞানের সাড়া ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে।
১১। অনুন্নত অর্থনৈতিক কাঠামো : বাংলাদেশের সড়ক, রেলপথ ও নৌপথের অবস্থা এখনও অনুন্নত। নদী ভরাট হয়ে জলপথের পরিমাণ হ্রাস পাচ্ছে। সড়ক ও রেলপথের বেহাল দশা। নিত্যনৈমিত্তিক দুর্ঘটনা লেগেই আছে। তবে বর্তমানে এসব কাঠামো উন্নয়নের প্রকল্প সরকার হাতে নিচ্ছে।
১২। বৈদেশিক বাণিজ্যের উপর নির্ভরশীলতা : রপ্তানির তুলনায় আমাদের আমদানির পরিমাণ অনেক বেশি। ফলে বৈদেশিক বাণিজ্যের ভারসাম্য সবসময় আমাদের প্রতিকূলে থাকে।
১৩। সামাজিক ও ধর্মীয় প্রথা : আমাদের দেশে এখনও যৌথ পরিবার, বর্ণ প্রথা, রক্ষণশীল মনোভাব, কুসংস্কারাচ্ছন্ন মনোবৃত্তি ইত্যাদির অস্তিত্ব থাকলেও সামাজিক ও ধর্মীয় কুসংস্কারাচ্ছন্নতা এখন আর আমাদের উন্নয়নের পথে বাধা নয়।
১৪। অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক দুর্বলতা : রাজনৈতিক অস্থিরতা, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, দুর্নীতি ও দুরাচার আমাদের অর্থনীতিতে উন্নয়নের গতি ব্যাহত করে।
১৫। আয় ও সম্পদের অসম বণ্টন : বাংলাদেশে আয় ও সম্পদের অসম বণ্টনের কারণে ধনী আরো ধনী হচ্ছে এবং দরিদ্র আরে দরিদ্রতর হচ্ছে। এতে অর্থনৈতিক উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
উল্লিখিত আলোচনা থেকে বলা যায় যে, বাংলাদেশের অর্থনীতিতে অনুন্নত দেশের প্রায় অধিকাংশ বৈশিষ্ট্যই বিদ্যমান। কাজেই এ দিক থেকে বাংলাদেশ অনুন্নত দেশ বলা যায়। কিন্তু বর্তমানে বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রতিটি স্তরে গতিশীল অবস্থা বিরাজ করছে। ফলে আর্থ-সামাজিক অবকাঠামোর উন্নয়নসহ কৃষি, শিল্প ও ব্যবসায়-বাণিজ্য সম্প্রসারিত হচ্ছে। এমতাবস্থায় বাংলাদেশকে উন্নয়নশীল দেশ বলাই যুক্তিযুক্ত।