বাংলাদেশের অর্থনীতির মৌলিক বৈশিষ্ট্য
বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার ধাবমান অর্থনীতির উন্নয়নশীল কৃষিনির্ভর একটি দেশ। ব্রিটিশ এবং পশ্চিম পাকিস্তানের দীর্ঘকালের শাসন ও শোষণের ফলে বাংলাদেশের অর্থনীতির গহিন সমুদ্রে নিমজ্জিত হয়েছিল। ফলে বাংলাদেশের কাঙ্ক্ষি অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্ভব হয় নি । নিচে বাংলাদেশের অর্থনীতির বৈশিষ্ট্য সমূহ আলোচনা করা হলো :
১ । অনুন্নত কৃষি ব্যবস্থা
বাংলাদেশ কৃষিনির্ভর অর্থনীতির দেশ হওয়া সত্ত্বেও এদেশের কৃষিব্যবস্থা মান্দাতার আমলের। কৃষিপ্রধান দেশ হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশের কৃষিপদ্ধতি প্রাচীন ও সেকেলের । লাঙ্গল-গরু দিয়ে এদেশে কৃষিকার্য পরিচালিত হয় । উন্নত ধরনের সেচ, সার, বীজ, গরিব কৃষকের পক্ষে জোগাড় করা সম্ভব হয় না । ফলে একরপ্রতি ফলন অত্যন্ত কম।
২। অনুন্নত শিল্প ব্যবস্থা
ব্রিটিশ ও পশ্চিম পাকিস্তানের শাসন ও শোষণের সময় এ দেশে কোন শিল্প কারখানা গড়ে উঠে নি । অল্পসংখ্যক যে শিল্প কারখানা ছিল তাও আবার খুবই অনুন্নত। বাংলাদেশ শিল্পের ক্ষেত্রে অত্যন্ত অনগ্রসর। কোন ভারী শিল্প এখানে গড়ে উঠে নি। মূলধন, উদ্যোক্তা ও দক্ষ কারিগরের অভাবই এর মূল কারণ। তাছাড়া ব্রিটিশ সরকারের অবহেলা, পাকিস্তানি শাসকদের শোষণ এবং সুষ্ঠু শিক্ষানীতির অভাবই শিল্পোন্নয়নের অন্তরায়।
আরও পড়ুন:
সামষ্টিক অর্থনীতি কাকে বলে? সামষ্টিক অর্থনীতির হাতিয়ার সমূহ ব্যাখ্যা কর
সামষ্টিক অর্থনীতির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সমূহ আলোচনা কর
৩। কৃষিনির্ভর অর্থনীতি
বাংলাদেশ কৃষিনির্ভর অর্থনীতির একটি ছোট দেশ। দেশের মোট শ্রমশক্তির শতকরা ৭০-৭৫ ভাগ মানুষ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কৃষির উপর নির্ভরশীল। আমাদের জাতীয় আয়ের প্রায় ২০% আসে কৃষি থেকে। কৃষিপণ্য রপ্তানি করে জাতীয় আয়ের সিংহভাগ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা হয়।
৪। অধিক জনসংখ্যা
বাংলাদেশের আয়তনের তুলনায় জনসংখ্যার ঘনত্ব অনেক বেশি। তাই জনসংখ্যার ক্রমবর্ধমান চাপ বাংলাদেশের অর্থনীতির আর একটি বৈশিষ্ট্য। ২০০১ সালের আদমশুমারি মতে প্রতি বর্গকিলোমিটারে ৮৩৪ জন লোক বসবাস করে। ২০১১ সালের হিসাবে প্রতি বর্গকিলোমিটারে ৯৬৪ জন লোক বসবাস করে। প্রতিবছর ২৩ লক্ষ শিশু বর্তমান জনসংখ্যার সাথে যোগ দেয়। জনসংখ্যার এই ক্রমবর্ধমান চাপ বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য হুমকিস্বরূপ।
৫। বেকারত্ব
বেকারত্ব বাংলাদেশের অর্থনীতির আরেকটি বৈশিষ্ট্য। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে পর্যাপ্ত পরিমাণে কর্মসংস্থান সৃষ্টি না হওয়ায় বেকার সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। বর্তমানে বাংলাদেশের প্রায় ১.৭৫ কোটি লোক বেকার আছে, যা শ্রমশক্তির প্রায় ৩৩%।
৬। খাদ্য ঘাটতি
জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি করা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে প্রতিবছর প্রায় ১৫ লক্ষ টন খাদ্য ঘাটতি দেখা দেয়। বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা খরচ করে এ খাদ্য আমদানি করতে হয়। ফলে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ব্যাহত হচ্ছে।
৭। অনুন্নত আর্থ-সামাজিক অবকাঠামো
বাংলাদেশের অর্থনীতির বৈশিষ্ট্য গুলোর মধ্যে একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো অনুন্নত আর্থ-সামাজিক অবকাঠামো । বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবকাঠামো অত্যন্ত দুর্বল। দেশের পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থা, বিদ্যুৎ সরবরাহ, সেচ ব্যবস্থা প্রভৃতি অর্থনৈতিক অবকাঠামোর এখনও আশানুরূপ উন্নতি হয় নি। তাছাড়া, শিক্ষা ও সংস্কৃতি, স্বাস্থ্য ব্যবস্থা প্রভৃতি সামাজিক অবকাঠামো এখনও অনুন্নত পর্যায়ে রয়েছে।
৮। মূলধনের স্বল্পতা
বাংলাদেশের অর্থনীতির আরেকটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো মূলধনের স্বল্পতা। বাংলাদেশের অধিকাংশ লোক দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে বলে মাথাপিছু সঞ্চয়ের হার ২৩.৭৪% এর কম। কিন্তু অর্থনৈতিক উন্নয়ন ধারা বজায় রাখার জন্য জাতীয় আয়ের কমপক্ষে ২৫% সঞ্চয় প্রয়োজন। তাই সঞ্চয়ের অভাবে মূলধন গঠন করা সম্ভব হয় না।
৯। সম্পদের অপূর্ণ ব্যবহার
বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো প্রাকৃতিক সম্পদের অপূর্ণ ব্যবহার। বাংলাদেশ প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর কিন্তু মূলধনের অভাব, প্রযুক্তিগত জ্ঞানের অভাব ইত্যাদি কারণে অনেক প্রাকৃতিক সম্পদ এখনও অব্যবহৃত অবস্থায় আছে। বিশেষ করে খনিজ সম্পদ এখনও পুরোপুরি উত্তোলন করা যায় নি।
১০। মুদ্রাস্ফীতি
উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি বাংলাদেশের অর্থনীতির আরেকটি বৈশিষ্ট্য। মুদ্রাস্ফীতির কারণে উৎপাদনের উপাদানের দাম বৃদ্ধি পায়। ফলে উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি পায়। এতে মানুষের ভোগান্তি বৃদ্ধি পায় এবং আন্তর্জাতিক বাজারে রপ্তানি পণ্য বিক্রয়ে সমস্যার সৃষ্টি হয়। ২০১১-১২ অর্থবছরের মার্চ পর্যন্ত গড় মূল্যস্ফীতির হার দাঁড়িয়েছে ১১.১১%।
১১। নিরক্ষর জনসংখ্যা
বাংলাদেশের অধিকাংশ লোক অশিক্ষিত ও নিরক্ষর। শিক্ষার অভাবে অধিকাংশ লোক কুসংস্কারাচ্ছন্ন ও অদৃষ্টের উপর নির্ভরশীল হয় ও তারা অর্থনৈতিক উন্নয়নে উদাসীন থাকে। ২০১০ সালের হিসাব অনুযায়ী সাক্ষরতার হার হলো ৫৭.৯% । উন্নত দেশে এ হার হলো ৯০%-১০০%।
১২। প্রাকৃতিক দুর্যোগ
বাংলাদেশ প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণ একটি দেশ। বাংলাদেশে প্রবল বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, খরা ইত্যাদি প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে আমাদের কৃষি বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়। এতে বাংলাদেশের অর্থনীতিও মারাত্মক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়।
১৩। বৈদেশিক সাহায্য নির্ভর
বাংলাদেশের মোট উন্নয়ন ব্যয়ের প্রায় ৫০% বিদেশি ঋণ ও সাহায্যের মাধ্যমে সংগ্রহ করা হয়। এরূপ অতি নির্ভরশীলতা স্বনির্ভরতার পথে বাধাস্বরূপ। তবে বর্তমানে এ নির্ভরশীলতা হ্রাস পাচ্ছে।
১৪। স্বল্প মাথাপিছু আয়
বাংলাদেশের অর্থনীতির আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো স্বল্প মাথাপিছু আয়। বাংলাদেশের জাতীয় ও মাথাপিছু আয় অত্যন্ত কম । বিশ্বের অনেক উন্নয়নশীল দেশের তুলনায় বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় অনেক কম যা প্রায় ৮০০ মার্কিন ডলারের নিচে। তবে মাথাপিছু আয় ধীরগতিতে হলেও ক্রমান্বয়ে বাড়ছে, সেই সাথে জীবনযাত্রার মানও উন্নত হচ্ছে।
১৫। আমদানি নির্ভর
বাংলাদেশের অর্থনীতি মূলত আমদানি নির্ভর। প্রতিবছর মূলধন দ্রব্যসহ প্রচুর পরিমাণ ভোগ্য ও বিলাসবহুল পণ্য বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। ফলে আমদানিতে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা খরচ হয় বিধায় অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্ভব নয় ।
১৬। বাণিজ্য ঘাটতি
আমাদের দেশে চাহিদা অনুযায়ী উৎপাদন সম্ভব হয় না। ফলে বাংলাদেশে রপ্তানির চেয়ে আমদানি বেশি থাকায় লেনদেনে বাণিজ্য ঘাটতি বিদ্যমান। ফলে উন্নয়নের সুফল ঘুরে ফিরে বিদেশে চলে যায়।
১৭। দারিদ্র্যের দুষ্টচক্র
বাংলাদেশের অর্থনীতির আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো দারিদ্র্যের দুষ্টচক্র। বাংলাদেশের অর্থনীতি দারিদ্র্যের দুষ্টচক্রে আবদ্ধ । অর্থাৎ আয় কম বলে সঞ্চয় কম ফলে মূলধন গঠনের হার কম। ফলশ্রুতিতে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান কম । এ কারণে আবারও উৎপাদন ও আয় কম। এই দারিদ্র্যের দুষ্টচক্র থেকে বাংলাদেশ বেরিয়ে আসতে পারছে না।
১৮। নিম্নস্তরে ভারসাম্য ফাঁদ
বাংলাদেশ কিছু কিছু খাতে উন্নয়ন করলেও অর্থনীতি সবসময় এমন একটি নিম্নস্তরের আয়ে ভারসাম্য লাভ করে যেখান থেকে আর অধিক উন্নয়ন সম্ভব নয় ।
১৯। দক্ষ উদ্যোক্তার অভাব
বাংলাদেশে মূলত দক্ষ উদ্যোক্তার অভাব রয়েছে। দক্ষ উদ্যোক্তার অভাবে বাংলাদেশে বিনিয়োগ বৃদ্ধি পাচ্ছে না ফলে শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার প্রয়োজনীয় অবকাঠামো সৃষ্টি হচ্ছে না।
২০। সীমাবদ্ধ বাজার
বাংলাদেশে উৎপাদিত দ্রব্যসামগ্রী বিশ্বের খুব কম দেশেই রপ্তানি হয়। তাই দেশে বিদেশে পণ্যসামগ্রী ও সেবার বাজারের সীমাবদ্ধতাও বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম বৈশিষ্ট্য ।
২১। দক্ষ শ্রমশক্তির অভাব
বাংলাদেশের অর্থনীতি শ্রম নিবিড় হলেও দক্ষ শ্রমিকের যথেষ্ট অভাব রয়েছে। তাছাড়া সাধারণ ও কারিগরি শিক্ষার অভাবে প্রয়োজনীয় শ্রমশক্তি তৈরি করা যাচ্ছে না।
২২। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা
রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে বাংলাদেশের অর্থনীতি আজ ধ্বংসপ্রায়। রাজনৈতিক অস্থিরতা, আমলাতান্ত্রিক মনোবৃত্তি, লালফিতার দৌরাত্ম্য, দেশের উন্নয়ন প্রচেষ্টাকে বহুলাংশে ব্যাহত করে।
উপরোক্ত বৈশিষ্ট্যগুলো বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বিদ্যমান থাকলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এদেশের অনেক ক্ষেত্রেই উন্নয়নের ছোঁয়া লেগেছে। দেশ আজ কৃষি, শিল্প, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও যোগাযোগ ব্যবস্থায় তথা তথ্য প্রযুক্তিতে অগ্রগতি লাভ করছে। সুষ্ঠু পরিকল্পনা এবং সুশাসনের আওতায় বাংলাদেশের অর্থনীতি দ্রুত দারিদ্র্যের দুষ্টচক্র থেকে বেরিয়ে আসবে বলে আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস।