Home » করনীয় মৈত্রী সূত্রটি কেন আবৃ্ত্তি করা হয়েছিল? এ সূত্রের সারমম তুলে ধর

করনীয় মৈত্রী সূত্রটি কেন আবৃ্ত্তি করা হয়েছিল? এ সূত্রের সারমম তুলে ধর

by TRI

করনীয় মৈত্রী সূত্র আবৃত্তি

ভূমিকা

বুদ্ধ ছিলেন একাধারে সকলের অপ্রতিম কল্যান- মিত্র, পুণ্যতীর্থ, অদ্বিতীয় শিক্ষক, সাধক ও নিবার্ন মার্গের হল ব্যক্তিগত ক্রোধ পরিচালক। তার দেশিত উপদেশ হল ব্যক্তিগত ক্রোধ এবং জাতিতে জাতিতে ক্রোধ বিনাশের একমাত্র পন্থা হল সকল প্রাণীর প্রতি মৈত্রী পোষন করা। খুদ্দক নিকায় ত্রিপিটকের অন্তর্গত সূত্রপিটকের পঞ্চম নিকায়। আর খুদ্দক পাঠো হচ্ছে খুদ্দক নিকায়ের প্রথম গ্রন্থ। খুদ্দক পাঠো শব্দের অর্থ সংক্ষিপ্ত পাঠ বা আবৃত্তি। করনীয় মৈত্রী সূত্র খুদ্দক পাঠো এর অন্তর্গত একটি অন্যতম সূত্র। এই সূত্র আবৃত্তির মাধ্যমে ভূত, যক্ষ, প্রেত প্রভৃতির উপদ্রব হতে রক্ষা পাওয়া যায়।

করণীয় মৈত্রী সূত্র যে কারণে আবৃত্তি করা হয়েছিল

একসময় ভগবান বুদ্ধ শ্রাবস্তীতে অবস্থান করছিলেন। তখন বর্ষাবাসের সময় ছিল। বর্ষাবাসের জন্য ভিক্ষুরা পর্বতের গুহা বা বনের মধ্যে সুবিধামতো স্থান বসবাসের জন্য বেছে নিতেন। হিমালয় পর্বতের পাশে বনের মধ্যে বহু বৃক্ষ দেবতা ছিল। তারা ভিক্ষুদের ধর্মজীবন ও শীলতেজের প্রভাবে আতঙ্কিত হয়ে পড়ল এবং শীলের তেজ সহ্য করতে না পেরে গাছ ছেড়ে পরিবার পরিজন নিয়ে যত্রতত্র পালিয়ে বেড়াতে লাগল। তারা কেবল ভাবছিল কবে ভিক্ষুরা ঐ স্থান ত্যাগ করবে। যত তাড়াতাড়ি ভিক্ষুরা এই স্থান ত্যাগ করবে তত তাড়াতাড়ি তারা আবার তাদের নিজের আবাসে ফিরে যেতে পারবে। কিন্তু তারা দেখল, ভিক্ষুরা বর্ষাবাস শেষ না করে স্থান ত্যাগ করবে না।

একদিন ভিক্ষুদেরকে বিতাড়িত করার উদ্দেশ্যে বৃক্ষদেবতারা এক রাতে ভয়ংকর আকৃতির মূর্তি ধারণ করলে ভিক্ষুরা ভয় পেয়ে গেলেন। ফলে তাঁরা ধ্যান- সমাধিতে চিত্ত নিবিষ্ট করতে পারলেন না। একদিন তাঁরা পরস্পর আলোচনা করে বর্ষাবাস ব্রত ত্যাগ করে শ্রাবস্তীতে ভগবান বুদ্ধের কাছে চলে এলে । ভগবান বুদ্ধ তাদেরকে দেখে চলে আসার কারণ জানতে চাইলে তাঁরা বৃক্ষদেবতাদের উপদ্রবের কথা খুলে বললেন। সবশুনে বুদ্ধ বললেন- ”ভিক্ষুগণ! তোমরা আবার সে স্থানে ফিরে যাও। আমি তোমাদেরকে বৃক্ষদেবতাদের ভয় থেকে পরিত্রানের উপায় বলে দিচ্ছি। বৃক্ষদেবতা বা যক্ষদের সাথে শত্রুভাব পোষন না করে মৈত্রীভাব পোষণ কর। তোমরা ধৈর্য্য ধরে তাদের প্রতি মৈত্রী ও করুনা প্রদর্শন কর।” এই বলে বুদ্ধ তাঁদের করনীয় মৈত্রী সূত্র দেশনা করলেন এবং প্রতিমাসে অষ্টধর্ম শ্রবণ দিবসে এই সূত্র উচ্চস্বরে আবৃত্তি করার জন্য নির্দেশ দিলেন।

বুদ্ধের উপদেশমতো ভিক্ষুরা সেই স্থানে ফিরে গিয়ে করনীয় মৈত্রী সূত্র পাঠ ও মৈত্রী ভাবনায় রত হলেন। করনীয় মৈত্রী প্রভাবে বৃক্ষদেবতাদের উপদ্রব বন্ধ হল। মৈত্রী ও করুণার প্রভাবে বৃক্ষদেবতারা আর ভিক্ষুদের কোনো উৎপাত করল না, অধিকন্তু অত্যন্ত সন্তুষ্ট চিত্তে তাঁদের সেবায় রত হলেন। অবশেষে ভিক্ষুরা সেখানে বর্ষাবাস শেষ করতে সক্ষম হলেন।

করণীয় মৈত্রী সূত্রের সারমর্ম

সমগ্র সত্ত্ব বা জীবের হিত-সুখ কামনা হল মৈত্রী ভাবনা। দ্বেষহীন অবস্থাই হল মৈত্রী। সকল প্রাণী শত্ৰু হীন হোক, নীরোগী হোক এবং সুখে বাস করুক এটাই মৈত্রী ভাবনার মূল মন্ত্র।

যে ব্যক্তি অপরকে নিজের মত সর্বদা তার সুখ শান্তি কামনা করেন তার মনে ক্রোধের উদয় হয় না। কারণ ভালবাসার মানুষের প্রতি ক্রোধ না হওয়ায় স্বাভাবিক। সুতরাং তিনি ক্রোধকে জয় করে ক্ষমাশীল হন। ক্রোধ মানুষের পরম শত্রু। ক্রোধের বশবর্তী হয়ে মানুষ পারে না এমন কোন কাজ নেই। তাই ধৰ্ম্মপদে বলা হয়েছে- ”শত্রুতা শত্রুতা করে, বিদ্বেষ করে বিদ্বেষী, বিক্ষিপ্ত চিত্ত করে তার চেয়ে বেশী ক্ষতি”। অর্থাৎ, বিক্ষিপ্ত চিত্ত মানুষের জন্য অমঙ্গলজনক। এটি মানুষের ইহ ও পরকালের শত্রু। ইহকালে এটি মানুষের অশেষ দুঃখ, যন্ত্রনা প্রদান করে বহু অনিষ্ট ও অনর্থ ঘটায় এবং পরকালে নিরয়গামী করে বিষম ক্লেশ প্রদান করে থাকে।

ক্রোধ অতি দ্রুতবেগে মানুষের আয়ু হানি করে, যে যত বেশী ক্রদ্ধ হয় তারই তত বেশী আয়ু কমে যায়। এইরূপ বিষম শত্রুকে একমাত্র মৈত্রী ভাবনা দ্বারা জয় করা সম্ভব। যারা সকল প্রাণীর প্রতি মৈত্রীভাব পোষন করেন তাদের চিত্ত সবসময় প্রফুল্ল থাকে। যিনি মৈত্রী ভাবনা করেন তিনি সুখে নিদ্রা যায়, অন্য ব্যক্তির মত ঘুমের মধ্যে দাঁত মিড়মিড় করে না, প্রলাপ বকেন না, স্থিরভাবে নিঃশব্দে সুখে ঘুমিয়ে থাকেন। অপরদিকে মানুষ নানা দুঃস্বপ্ন দেখে ভয় পায়, কিন্তু মৈত্রী ভাবনায় রত ব্যক্তি স্বপ্ন দেখে কোন ভয় পান না। দান দেওয়া, ধর্মকথা শুনা, বুদ্ধপূজা প্রভৃতি ভালোস্বপ্ন দেখে আনন্দিত হন। যে ব্যক্তি মৈত্রী ভাবনা করে থাকেন তিনি সর্বদা মানুষের প্রিয় হন। এমনকি যক্ষ, ভূত, প্রেতদের ও প্রিয় হয়ে থাকেন। দেবতাগন তাকে সকল বিপদ আপদ হতে রক্ষা করে।

আরও পড়ুন:   চন্দ্রবংশীয় রাজাদের রাজত্বকাল সংক্ষেপে আলোচনা কর

মৈত্রী ভাবনাকারী ব্যক্তি আগুনের তাপ, বিষ বা অস্ত্র দ্বারা দুঃখ প্রাপ্ত হন না। নিয়মিত মৈত্রী ভাবনা করলে চেহারা খুবই প্রসন্ন ও উজ্জ্বল হয়ে থাকে। আর যে ব্যক্তি সর্বদা মৈত্রী ভাবনা করে তিনি মোহ প্রাপ্ত না হয়ে ঘুমানো অবস্থায় সুখে প্রানত্যাগ করেন। মৈত্রী ভাবনার দ্বারা অর্হত্ব ফল লাভ না হলে ও ব্রহ্মলোকে উৎপন্ন হওয়া যায়। ব্রহ্মগণ সর্বদা মৈত্রী, করুনা, মুদিতা ও উপেক্ষা ভাবনায় রত থাকেন। তাঁদের আর অন্য কোন ভাবনা নেই। তাই যেসমস্ত কার্য ভাবনার ব্যাঘাত হতে পারে সে সমস্ত কার্য পরিত্যাগ করে আহার শেষ করে কোন নির্জন স্থানে আসন পেতে সুখে উপবেশন করে সকল প্রাণীর প্রতি মৈত্রী ভাবনা করা উচিত। প্রকৃত বন্ধু হিসেবে বন্ধুর আন্তরিক মঙ্গল কামনাই হল মৈত্রী।

বুদ্ধের মতে, মাতা যেমন তাঁর নিজ একমাত্র পুত্রের জীবন রক্ষা করেন তাঁর নিজের জীবনের বিনিময়ে, সেরূপ সর্বজীবের প্রতি অপ্রমেয় দয়া ভাবই হল এই মৈত্রী। হিংসা বা হত্যা চিন্তা এখানে সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। এ মৈত্রী হল জাতি-ধর্ম-বর্ণ তথা মানুষ-প্রাণী হত্যা-চিন্তা এখানে সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। এ মৈত্রী হল জাতি – ধর্ম – বর্ণ তথা মানুষ – প্রাণী নির্বিশেষে সমগ্র জীব-জগতের প্রতি আত্মার পোষন। তাহলে মানুষে মানুষে, জাতিতে জাতিতে আর কোন হিংসাভাব থাকতে পারে না। পৃথিবী হয়ে উঠবে একটি পরিবার, মানুষেরা হবে একটি পরিবারের সদস্য। তখন পৃথিবীতে নেমে আসবে শান্তি, মহাশান্তি।

উপসংহার

সর্বশেষে বলা যায় যে, একমাত্র মৈত্রীর দ্বারা মানুষ অমরত্ব লাভ করতে পারে। তাই সকল জীব তথা প্রাণীর প্রতি মৈত্রী কামনা করা উত্তম মঙ্গল। জগতে রাগ, দ্বেষ, মোহ প্রভৃতি ত্যাগ করে নির্বাণ সুখ লাভ করার জন্য মৈত্রীভাব পোষন করা কর্তব্য। মৈত্রী ভাবনা করলে শীলবান ও সম্যক দৃষ্টি সম্পন্ন হয়। এর প্রভাবে সুনিদ্রা হয়, পাপ দর্শন হয় না তাই আমাদের প্রত্যেকের মৈত্রী ভাবনা করা উচিত।

Related Posts