আজকের গুরুত্বপূর্ণ আর্টিকেলে সাম্য কাকে বলে, সাম্যের বিভিন্ন রূপ এবং সাম্য ও স্বাধীনতার সম্পর্ক সম্বন্ধে আলোচনা করা হবে। আশাকরি, আর্টিকেলটি পড়ে অনেককিছু জানতে পারবেন।
সাম্য কাকে বলে ?
বিভিন্ন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও চিন্তাবিদগণ নানাভাবে সাম্যের সংজ্ঞা প্রদান করেছেন। অধ্যাপক লাস্কি (Laski) বলেন, “সাম্য অর্থ আচরণের সমতা নয়।” তিনি আরো বলেন, “সাম্য হল সেরূপ সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা যাতে কোন ব্যক্তির ব্যক্তিত্বকে অন্যের ব্যক্তিগত সুবিধার জন্য বিসর্জন দিতে হয় না।” তার মতে সাম্যের তিনটি বিশেষ দিক রয়েছে। যথা- ১. বিশেষ সুযোগ-সুবিধার অনুপস্থিতি ২. যথার্থ ও যথেষ্ট সুযোগ-সুবিধাদির সৃষ্টি এবং ৩. বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় সম্পদ সামগ্রী জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সমভাবে বন্টন।
উপরের সংজ্ঞাগুলোর আলোকে বলা যায় যে, সাম্য বলতে আমরা মানব জীবনের সেই পরিবেশ বা প্রক্রিয়াকে বুঝি, যেখানে জাতি ধর্ম, বর্ণ, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকল নাগরিককে সমান সুযোগ-সুবিধা প্রদান করা হয়।
আরও পড়ুন
শিশু অধিকার গুলো কি কি? শিশু অধিকার রক্ষায় ইউনিসেফের ভূমিকা
সাম্যের বিভিন্ন রূপ
সাম্যের প্রকারভেদ নিয়ে বিভিন্ন মত রয়েছে। বার্কার (Ernest Barker) দু’ধরনের সাম্যের কথা বলেছেন। যথা- আইনগত সাম্য ও সামাজিক সাম্য। অধ্যাপক লাস্কি (H J Laski) বলেছেন রাজনৈতিক ও সামাজিক সাম্যের কথা। তবে আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ছয় প্রকার সাম্যের কথা বলেছেন। নিম্নে সেগুলোর আলোচনা করা হল-
পৌরসাম্য (Civic Equality)
সকলের সমানভাবে পৌর অধিকার ও স্বাধীনতা ভোগ করাকে পৌরসাম্য বলে। জাতি, ধর্ম, বর্ণ, বংশগত প্রতিপত্তি প্রভৃতি, নির্বিশেষে প্রত্যেক নাগরিক সকল ব্যক্তিগত অধিকার ভোগ করার সুযোগ পেলেই পৌরসাম্য প্রতিষ্ঠিত হয়। রাষ্ট্র আইনের মাধ্যমে নাগরিক অধিকার ভোগের সমান সুযোগ দেয়।
সামাজিক সাম্য (Social Equality)
সামাজিক সাম্যে সকলেই সমান। জাতি, ধর্ম, বর্ণ ও গোত্র নির্বিশেষে যখন সকল মানুষকে সমান সামাজিক সুযোগ-সুবিধা প্রদান করা হয় তখন তাকে সামাজিক সাম্য বলে। সামাজিক দৃষ্টিতে সকল অধিকার ও সুযোগের সমতা প্রতিষ্ঠাই সামাজিক সাম্য।
রাজনৈতিক সাম্য (Political Equality)
রাজনৈতিক সাম্য বলতে সকল নাগরিকের সমানভাবে ভোটদানের অধিকার, সরকারি চাকরিতে সমানভাবে নিয়োগের অধিকার এবং স্বাধীন ও নিরপেক্ষ নির্বাচনে সমানভাবে অংশগ্রহণের অধিকারকে বুঝায়। এছাড়া স্বাধীনভাবে মত প্রকাশের অধিকার এবং সরকারের সমালোচনা করার অধিকারও রাজনৈতিক সাম্যের অন্তর্গত। নাবালক, দেউলিয়া,উন্মাদ ব্যতীত সকলে রাজনৈতিক অধিকারগুলো ভোগ করার সুযোগ পেলে রাজনৈতিক সাম্য প্রতিষ্ঠিত হয়। রাজনৈতিক সাম্য গণতন্ত্রের অন্যতম শ্রেষ্ঠ শর্ত।
অর্থনৈতিক সাম্য (Economic Equality)
অর্থনৈতিক সাম্য বলতে সকলের সমান অর্থনৈতিক নিরাপত্তা, সামাজিক নিয়ন্ত্রণে ব্যক্তি মালিকানা এবং সমাজের দুর্বল সম্প্রদায়কে রক্ষার বিশেষ অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে বুঝায়। অর্থনৈতিক অসাম্য-বৈষম্য থাকলে সমাজে সম্পদশালী শ্রেণীর সৃষ্টি হয়। এ শ্রেণীই বিশেষ সুযোগ-সুবিধা ও স্বাধীনতা ভোগ করে। এর ফলে সাম্যের আদর্শ ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। অর্থনৈতিক সাম্য ব্যতীত রাজনৈতিক ও সামাজিক সাম্য অর্থহীন।
আইনগত সাম্য (Legal Equality)
আইনের দৃষ্টিতে সাম্য বা সমানাধিকর স্বীকৃত হলে আইনগত সাম্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বলা যায়। আইনের প্রয়োগ সকলের জন্য সমান, সমপর্যায়ে সাম্য, যুক্তি সঙ্গত খরচে বিচার পাওয়ার ব্যবস্থা ইত্যাদি হল আইনগত সাম্যের মর্মকথা। আইনগত সাম্যে রাষ্ট্রের সকল নাগরিক আইনগত সমান সুযোগ-সুবিধা ও অভিন্ন অধিকার ভোগ করতে পারবে। আইনের অনুশাসনের মধ্য দিয়েই আইনগত সাম্য মূর্ত হয়ে উঠে।
প্রাকৃতিক সাম্য (Natural Equality)
প্রাকৃতিক সাম্য বা স্বাভাবিক সাম্যের অর্থ জন্মগতভাবে সকল মানুষ সমান। ফরাসি দার্শনিক রুশোর লেখায় এবং আমেরিকার স্বাধীনতার ঘোষণায় প্রাকৃতিক সাম্যের আদর্শ মূর্ত হয়ে উঠেছে। কিন্তু এরূপ সাম্যকে বর্তমানে খুব একটা গুরুত্ব দেয়া হয় না। কারণ শক্তি-সামর্থ্য, বুদ্ধিবৃত্তি প্রভৃতি ক্ষেত্রে মানুষে মানুষে জন্মগত পার্থক্য রয়েছে।
উপরিউক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা বলতে পারি যে, সাম্য একটি অখন্ড ধারণা। কিন্তু মানুষ তার ব্যক্তিত্বের পূর্ণ অভিব্যক্তি লাভের ক্ষেত্রকে বিভিন্ন দিকে সম্প্রসারিত করায় রাষ্ট্রবিজ্ঞানীগণ সাম্যের ধারণাকে বিভিন্ন দিক থেকে আলোচনা করেছেন। উপরে বর্ণিত সাম্যের ছয়টি রূপ ছাড়াও কেউ কেউ সাম্যকে “ব্যক্তিগত সাম্য” ও “আন্তর্জাতিক সাম্য” রূপে বর্ণনা করেছেন।
সাম্য ও স্বাধীনতার সম্পর্ক
সাম্য ও স্বাধীনতা পরস্পর সম্পর্কযুক্ত। সাম্য ছাড়া স্বাধীনতার কোন মূল্য থাকে না। আবার স্বাধীনতা না থাকলে সাম্য প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। সাম্য ও স্বাধীনতার পারস্পরিক সম্পর্ক ক্ষেত্রে দুটি পরস্পরবিরোধী মতবাদ প্রচলিত আছে। একটি হচ্ছে, স্বাধীনতা ও সাম্য পরস্পর বিরোধী এবং অপরটি হচ্ছে, স্বাধীনতা ও সাম্য পরস্পর সম্পূরক। নিম্নে এ দু’টি মতবাদ ব্যাখা করে সাম্য ও স্বাধীনতার পারস্পরিক সম্পর্ক আলোচনা করা হল-
সাম্য ও স্বাধীনতা পরস্পর সম্পূরক: সাম্য ও স্বাধীনতা পরস্পর বিরোধী নয় বরং সম্পূরক। এরা একে অপরের পথে কোনরূপ বাধা-বিঘ্ন সৃষ্টি করে না। সাম্য ব্যতীত স্বাধীনতা ভোগ করা যায় না। কেননা মানুষে মানুষে ভেদাভেদ থাকলে সবল দুর্বলের উপর হস্তক্ষেপ করে। এমতাবস্থায় দুর্বল স্বাধীনতা ভোগ করতে পারে না। আইনের দৃষ্টিতে সকলে সমান বলে বিবেচিত না হলে প্রকৃত স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠিত হয় না। অর্থনৈতিক সাম্য বিঘ্নিত হরে রাজনৈতিক স্বাধীনতা ব্যর্থ হয়। তাই বলা যায়, সাম্য স্বাধীনতাকে প্রতিষ্ঠিত করে। আবার স্বাধীনতা না থাকলে মানুষে মানুষে ব্যবধান সৃষ্টি হয়। কাজেই সাম্য প্রতিষ্ঠার জন্য স্বাধীনতার প্রয়োজন। এ ব্যাপারে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী রুশো (Rousseau) বলেন, “সাম্য ব্যতীত স্বাধীনতা অর্থহীন।” অধ্যাপক লাস্কি (H J Laski) এ মতের সমর্থন করে বলেন, একটি রাষ্ট্রে যত সাম্য থাকবে, সে রাষ্ট্রে তত স্বাধীনতা থাকবে।” আর. এইচ. টনি (R H Tawney) এজন্যই বলেছেন, “স্বাধীনতা বলতে যদি মানবতার নিরবচ্ছিন্ন প্রসার বুঝায়, তাহরে এরূপ স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠিত হতে পারে কেবল সাম্যভিত্তিক সমাজে।”
উপরের আলোচনা থেকে আমরা বলতে পারি যে, সাম্য স্বাধীনতার বিরোধী নয় বরং পরস্পর সম্পূরক।
সাম্য ও স্বাধীনতা কি পরস্পর বিরোধী ?
সাম্য ও স্বাধীনতা পরস্পর বিরোধী ও আপোসহীন। স্বাধীনতা মানুষকে নিজের ইচ্ছামত সবকিছু করার ক্ষমতা দেয়। কিন্তু সাম্য কাউকে বিশেষ সুযোগ-সুবিধা প্রদানের পক্ষপাতী নয়। কাজেই দেখা যায়, একটি অপরটির স্বাভাবিক অপসারণ ঘটায়। সাম্যের ভাবাবেগ স্বাধীনতার আশাকে ব্যর্থতায় পর্যবসিত করে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী লর্ড এ্যাক্টন (Lord Acton) এবং ডি. টকভিল (De Tocqueville) এর মতে, “সাম্য ব্যক্তি স্বাধীনতার উপর সামাজিক নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে।” লর্ড এ্যাক্টন আরো বলেন, “সাম্যের আকা খা স্বাধীনতার আশা ব্যর্থ করে দেয়।” অবশ্য এ ধরনের মতবাদ মূলত অর্থনৈতিক সাম্যের দিকেই ইঙ্গিত করেছে। তারা উৎপাদন, বিনিময় ও বন্টন ব্যবস্থার উপর অত্যধিক গুরুত্ব আরোপ করেছেন। তাদের মতে, সাম্যনীতি অনুসরণ করতে হলে বিত্তশালী বা সম্পদশালীর বিত্ত বা সম্পদের সীমা নির্দিষ্ট করে দেয়া উচিত। কেননা রাষ্ট্রবিজ্ঞানে নিয়ন্ত্রণহীন অবাধ স্বাধীনতার কোন স্থান নেই। প্রকৃত অর্থে স্বাধীনতা বলতে মানুষের এরূপ কাজ করার ক্ষমতাকে বুঝায় যার দ্বারা অন্যের অনুরূপ কাজে হস্তক্ষেপ না হয়। সাম্য না থাকলে স্বাধীনতা হয় অবাধ। ফলে স্বেচ্ছাচারিতার জন্ম হয়। তাই সাম্য ও স্বাধীনতা পরস্পর বিরোধী।
উপরিউক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে আমরা বলতে পারি যে, স্বাধীনতাকে পুরোপুরি ভোগ করতে হলে সাম্য একান্ত আবশ্যক। আবার সাম্যকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য স্বাধীনতা অপরিহার্য। কাজেই দেখা যায়, উভয়ের মধ্যে কিছু কিছু বিরোধ থাকলেও উভয়ের সম্পর্ক অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। কাজেই সাম্যের আদর্শে স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠিত করতে পারলেই প্রকৃত স্বাধীনতা উপভোগ করা যাবে।