মিশ্র অর্থব্যবস্থা
যে অর্থব্যবস্থায় অর্থনৈতিক কার্যক্রম- উৎপাদন, বিনিময়, বণ্টন ও ভোগের ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত উদ্যোগের পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ বজায় থাকে, তাকে মিশ্র অর্থব্যবস্থা বলে। এ অর্থব্যবস্থায় ধনতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থার দুর্বলতা পরিত্যাগ করে শক্তিশালী দিকগুলো গ্রহণ করা হয়েছে। অর্থাৎ ব্যক্তিগত ও সরকারি উদ্যোগ সম্মিলিত ভূমিকা পালন করে।
অধ্যাপ পি. এ. স্যামুয়েলসনের মতে, “মিশ্র অর্থব্যবস্থা এরূপ একটি অর্থব্যবস্থা, যেখানে উৎপাদন ও ভোগকার্য সংগঠিত করার ক্ষেত্রে বাজারব্যবস্থার সাথে সরকারি নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্তার সংমিশ্রণ ঘটে।”
মিশ্র অর্থব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য
মিশ্র অর্থনৈতিক ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য নিম্নরূপ:
১. সম্পদের মালিকানা
ধনতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থায় সম্পদের ব্যক্তিমালিকানা এবং সমাজতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থায় রাষ্ট্রীয় মালিকানা বিদ্যমান। আর মিশ্র অর্থব্যববস্থায় ব্যক্তিগত মালিকানার পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় মালিকানা বিদ্যমান।
২. সরকারি নিয়ন্ত্রণ
যেসব খাত জনগুরুত্বপূর্ণ এবং রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার সাথে সংশ্লিষ্ট, সেসব খাত রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণাধীন থাকে। ভারী শিল্পকারখানা, গুরুত্বপূর্ণ আমদানি-রপ্তানি সরকারি মালিকানা ও নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত হয়।
আরও পড়ুন: ধনতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থা এবং সমাজতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থার মধ্যে পার্থক্য
৩. বেসরকারি বিনিয়োগ
ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প স্থাপনে বেসরকারি বিনিয়োগ লক্ষ করা যায়। আমদানি ও রপ্তানিতে সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি বেসরকারি উদ্যোগও পরিলক্ষিত হয়। তবে কিছু কিছু বেসরকারি উদ্যোগের সরকারি নিয়ন্ত্রণ বজায় থাকে।, যেন একচেটিয়া ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করা যায়।
৪. সরকারি ও বেসরকারি খাতের সম্পর্ক
অর্থনৈতিক সম্পর্ক সমাধানে মিশ্র অর্থব্যবস্থায় সরকারি ও বেসরকারি খাতের মধ্যে পরিপূরক সম্পর্ক বজায় থাকে।
৫. মুনাফা
এ অর্থব্যবস্থায় বেসরকারি খাত স্বীকৃত হওয়ায় ব্যক্তিগত মুনাফা অর্জনের সুযোগ থাকে, তবে জনস্বার্থে সরকার নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থাও গ্রহণ করে থাকে।
৬. দামব্যবস্থা
মিশ্র অর্থব্যবস্থায় দ্রব্য বা উপকরণের দাম এদের চাহিদা ও যোগানের মাধ্যমে নির্ধারিত হয়। তবে সরকার রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনে জনস্বার্থে দামব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।
৭. অর্থনৈতিক পরিকল্পনা
রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ খাত যেমন- কৃষি, শিল্প, খনিজ, বন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, যাতায়াত, যোগাযোগ, ব্যবসা-বাণিজ্য ইত্যাদি খাতে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়।
৮. ভোক্তার সার্বভৌমত্ব
এ অর্থব্যবস্থায় ভোক্তা তার পছন্দমতো যেকোনো পরিমাণ দ্রব্য ভোগের মাধ্যমে সর্বোচ্চ উপযোগ লাভ করতে পারে। এতে ভোক্তার সার্বভৌমত্ব বজায় থাকে।
৯. বণ্টনব্যবস্থা
এ অর্থব্যবস্থায় সম্পদের ব্যক্তিমালিকানা স্বীকৃত হওয়ায় অস্বাভাবিক মুনাফা অর্জন সম্ভব। ফলে আয়ের ক্ষেত্রে অসম বণ্টন লক্ষ করা যায়।
১০. নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থা
সরকার মুদ্রানীতি ও রাজস্বনীতির মাধ্যমে মুদ্রাস্ফীতি, মুদ্রা সংকোচন, অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা, বাণিজ্যচক্র, বেকারত্ব ইত্যাদি নিয়ন্ত্রণ করে থাকে।
১১. শ্রমিকের স্বার্থ সংরক্ষণ
শ্রমিকদের স্বার্থ সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে এ অর্থব্যবস্থায় সরকার ন্যূনতম মজুরি, কর্মকালীন সময়, ছুটি, নিরাপত্তা, শ্রম আদালত, শিল্পবিরোধ নিষ্পত্তিসহ সামাজিক নিরাপত্তা বিধানের জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করে।
১২. মুদ্রাস্ফীতির অস্তিত্ব
এ অর্থব্যবস্থায় ব্যক্তি উদ্যোগের কারণে কখনো কখনো অধিক উৎপাদন বা কম উৎপাদন হওয়ার কারণে মুদ্রাস্ফীতি দেখা দেয়।
১৩. প্রতিযোগিতা
এ অর্থব্যবস্থায় ব্যক্তি খাতের অস্তিত্ব থাকায় উৎপাদন ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা বিরাজ করে। তবে সরকারি নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে অসুস্থ প্রতিযোগিতা রোধ করা হয়।
১৪. সামাজিক নিরাপত্তা
মিশ্র অর্থব্যবস্থায় শ্রমিকদের সামাজিক নিরাপত্তার মাধ্যমে সামাজিক কল্যাণ নিশ্চিত করা হয়। বেকার ভাতা, বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা, প্রতিবন্ধী ভাতা, পেনশন ইত্যাদির মাধ্যমে সরকার সামাজিক সুরক্ষা নিশ্চিত করে।
১৫. উদ্যোক্তা শ্রেণির উদ্ভব
এ অর্থব্যবস্থায় রাষ্ট্র যেমন উদ্যোক্তার ভূমিকা পালন করতে পারে, তেমনি যেকোনো ব্যক্তি উদ্যোক্তা হিসেবে বিনিয়োগের মাধ্যমে ব্যবসা-বাণিজ্য করে মুনাফা অর্জন করতে পারে।
মিশ্র অর্থব্যবস্থা মূলত সরকারি নিয়ন্ত্রণাধীন বেসরকারি খাতের বিকাশ কিংবা বেসরকারি খাতের মধ্যে সরকারি খাতের অবস্থান। বিশুদ্ধ ধনতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থায় কিছু ত্রুটি যেমন রয়েছে, তেমনি সমাজতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থায়ও কিছু ত্রুটি রয়েছে। ফলে ধনতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থার ত্রুটি বর্জন করে ভালো গুণসম্পন্ন বৈশিষ্ট্যের সমন্বয় করে মিশ্র অর্থব্যবস্থার সৃষ্টি। এজন্য অনেক অর্থনীতিবিদ মিশ্র অর্থব্যবস্থাকে অন্যতম শ্রেষ্ঠ অর্থব্যবস্থা বলেও মনে করেন।