সমাজতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থা
যে অর্থব্যবস্থায় সমাজের অধিকাংশ সম্পদ ও উৎপাদনের উপকরণের উপর রাষ্ট্রীয় মালিকানা বা সরকারি মালিকানা থাকে তাকে সমাজতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থা বলে। একে নির্দেশমূলক অর্থব্যবস্থাও (Command Economy) বলা হয়। এ ধরনের অর্থব্যবস্থায় মুনাফা অর্জন নয় বরং সামাজিক কল্যাণ নিশ্চিত করতেই যাবতীয় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়।
উল্লেখ্য, ১৯১৭ সালে সর্বপ্রথম রাশিয়ার জারতন্ত্রের পতন ও লেনিনের নেতৃত্বে সমাজতন্ত্রের উত্থান হয়।
অর্থনীতিবিদ J. F. Ragan ও L. B. Thomas বলেন, “সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি এমন একটি অর্থব্যবস্থা, যেখানে সম্পদ সরকারি মালিকানাধীন থাকে এবং কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষ অর্থনৈতিক সিদ্ধান্তসমূহের মধ্যে সমন্বয় সাধন করে।”
সমাজতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য
নির্দেশমূলক বা সমাজতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থায় নিম্নোক্ত বৈশিষ্ট্য লক্ষ করা যায়-
১. যৌথ ও রাষ্ট্রীয় মালিকানা বিদ্যমান
সমাজতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থায় শ্রমিকেরা যৌথ শ্রমের ভিত্তিতে উৎপাদনে অংশগ্রহণ করে। ছোট, বড় সব শিল্প রাষ্ট্রীয় মালিকানায় থাকে। এ অর্থব্যবস্থায় ব্যক্তিগত মালিকানা স্বীকার করা হয় না।
২. শ্রেণি শোষণ অনুপস্থিত
এ অর্থব্যবস্থায় সব কর্মকাণ্ড মুনাফার লক্ষ্যে পরিচালিত হয় না। ফলে বিভিন্ন শ্রেণির অস্তিত্ব লক্ষ্য করা যায় না, ফলে শোষণও থাকে না।
৩. পূর্ণ প্রতিযোগিতা অনুপস্থিত
এ অর্থব্যবস্থায় কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষ সব পণ্যের দাম নির্ধারণ করে। ‘স্বয়ংক্রিয় দাম ব্যবস্থা’ এখানে অনুপস্থিত। তাই এ অর্থব্যবস্থায় পূর্ণ প্রতিযোগিতা অনুপস্থিত।
আরও পড়ুন: ধনতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থা কী? ধনতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য কী কী?
৪. কেন্দ্রীয় পরিকল্পনা
এ অর্থব্যবস্থায় সব অর্থনৈতিক কার্যক্রম কেন্দ্রীয় পরিকল্পনা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। উৎপাদন, বণ্টনসহ উন্নয়নের সব পরিকল্পনা কেন্দ্রীয় পরিকল্পনা কর্তৃপক্ষ নির্ধারণ করে।
৫. সর্বাধিক সামাজিক কল্যাণ অর্জন
কেবল মুনাফা অর্জনই এ অর্থব্যবস্থার প্রধান লক্ষ্য নয়, দেশের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে উৎপাদন ও বণ্টন নিশ্চিত করে সর্বাধিক সামাজিক কল্যাণ অর্জন এর মূল লক্ষ্য।
৬. চাহিদার উপর নিয়ন্ত্রণ
এ অর্থব্যবস্থায় ভোক্তা স্বাধীনভাবে দ্রব্যসামগ্রী ভোগ করতে পারে না। ভোক্তা বা ক্রেতার চাহিদাকে রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রণ করে।
৭. শ্রমিকদের স্বার্থরক্ষা
শ্রমিকদের কল্যাণে এ অর্থব্যবস্থা পরিচালিত হয়। দামব্যবস্থা নিয়ন্ত্রিত ও মজুরি রাষ্ট্র কর্তৃক নির্ধারিত হয়, যাতে শ্রমিকরা সুস্থ ও স্বাচ্ছন্দ্যপূর্ণ জীবন যাপন করতে পারে।
৮. মুদ্রাস্ফীতির অনুপস্থিতি
সমাজতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থায় উৎপাদন, বণ্টন, রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণাধীন, ফলে অধিক উৎপাদন বা কম উৎপাদন হতে পারে না। ফলে মুদ্রাস্ফীতিও নেই।
৯. সামাজিক নিরাপত্তা
এর অর্থব্যবস্থা রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত বলে সমাজের প্রতিটি মানুষের মৌলিক চাহিদা এবং জীবনের সাধারণ ঝুঁকির বিরুদ্ধে আর্থিক নিরাপত্তা প্রদানের চেষ্টা করা হয়।
১০. সুষম উন্নয়ন
এ অর্থব্যবস্থা কেন্দ্রীয় পরিকল্পনার ভিত্তিতে পরিচালিত হয়। আর কেন্দ্রীয় পরিকল্পনায় দেশের সব অঞ্চলের গুরুত্ব দেওয়া হয়। ফলে সমাজের উন্নয়ন সুষম হয়।
১১. বেকারত্বহীনতা
এ অর্থব্যবস্থায় সামাজিক নিরাপত্তার বিষয়টি অধিক গুরুত্ব পায়। সব কর্মক্ষম ব্যক্তির অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে রাষ্ট্র কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে; ফলে বেকারত্ব থাকে না।
১২. দ্বন্দ্বহীন উৎপাদন পদ্ধতি
এ অর্থব্যবস্থায় ছোট-বড় সব উৎপাদন প্রতিষ্ঠান রাষ্ট্রীয় মালিকানায় প্রতিষ্ঠিত। ফলে উৎপাদন ক্ষেত্রে কোন দ্বন্দ্ব লক্ষ করা যায় না।
১৩. ব্যক্তিগত মুনাফার অনুপস্থিতি
সমাজতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থায় সামাজিক নিরাপত্তার বিষয় নিশ্চিত করা হয়। মুনাফা এক্ষেত্রে মুখ্য বিষয় নয়। আর উৎপাদন পদ্ধতি যেহেতু রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন, ফলে ব্যক্তিগত মুনাফা এক্ষেত্রে অনুপস্থিত।
১৪. উৎপাদকের সার্বভৌমত্বের অনুপস্থিতি
এ অর্থব্যবস্থায় উৎপাদন তার ইচ্ছামতো উৎপাদনকাজ পরিচালনা করতে পারে না, কারণ উৎপাদন কার্যক্রম রাষ্ট্র কিংবা কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ কর্তৃক পরিচালিত হয়, ফলে উৎপাদকের সার্বভৌমত্ব থাকে না।