ধনতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থা
১৭৮৯ সালে ফরাসি বিপ্লবের মাধ্য ইউরোপে পুঁজিবাদী বা ধনতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থা যাত্রা শুরু করে। বর্তমানে ধনতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থাকে মৌলিক অর্থনৈতিক সমস্যা সমাধানের হাতিয়ার হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
যে অর্থব্যবস্থায় সম্পদের ব্যক্তি মালিকানা এবং ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য বিদ্যমান থাকে, তাকে ধনতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থা বলা হয়। এ অর্থব্যবস্থায় উৎপাদনের উপকরণগুলোর ব্যক্তিগত মালিকানা বিদ্যমান এবং সরকারি হস্তক্ষেপ ব্যতিরেকে অবাধ দাম প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বাজারব্যবস্থা পরিচালিত হয়।
V. I. Lenin এর মতে, “ধনতন্ত্র বলতে উৎপাদনের ঐ উন্নত স্তরকে বোঝায়, যেখানে মনুষ্য শ্রমের উৎপাদন শুধু নয়, মনুষ্য শ্রমশক্তি নিজেই পণ্যে পরিণত হয়।”
J. F. Ragan এবং L. B. Thomas বলেন, “বিশুদ্ধ ধনতন্ত্রের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে সম্পদের ব্যক্তিমালিকানা এবং বাজারের উপর আস্থা, যেখানে ক্রেতা ও বিক্রেতা সমবেতভাবে নির্ধারণ করে কী দামে কী পরিমাণ পণ্য ও সম্পদ বিক্রি হবে।”
ধনতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য
ধনতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থার প্রধান প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলো নিম্নরূপ:
১. সম্পদের ব্যক্তিমালিকানা
ধনতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থায় উৎপাদনের উপকরণসমূহে (ভূমি, শ্রম, মূলধন, সংগঠন) ব্যক্তিমালিকানা স্বীকৃত।
২. পুঁজিপতি ও শ্রমিক শ্রেণির অস্তিত্ব
মুনাফাভিত্তিক উৎপাদনব্যবস্থার ফলে ধনতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থায় পুঁজিপতির সৃষ্টি হয়। আবার এ অর্থব্যবস্থায় সম্পরেদ ব্যক্তিগত মালিকানা সৃষ্টি হওয়ায় শ্রমিক শ্রেণিও সৃষ্টি হয়।
৩. উৎপাদকের সার্বভৌমত্ব
এ অর্থব্যবস্থার প্রধান লক্ষ্য মুনাফা অর্জন। এ লক্ষ্যে উৎপাদক তার মুনাফা সর্বোচ্চকরণের জন্য যেকোনো দ্রব্য যেকোনো পরিমাণে উৎপাদন করতে পারে।
৪. ভোক্তার সার্বভৌমত্ব
এ অর্থব্যবস্থায় উৎপাদক যেমন মুনাফা সর্বোচ্চকরণের জন্য উৎপাদন করে, তেমনি ভোক্তা তার উপযোগ সর্বোচ্চকরণের জন্য যেকোনো দ্রব্য যেকোনো পরিমাণ ভোগ করতে পারে।
আরও পড়ুন:
অর্থনৈতিক পরিকল্পনা কি? অর্থনৈতিক পরিকল্পনার গুরুত্ব বা প্রয়োজনীয়তা আলোচনা কর
৫. অবাধ প্রতিযোগিতা
উৎপাদনকারী যেমন তার মুনাফা সর্বোচ্চকরণের জন্য স্বাধীনবাবে কাজ করতে পারে, তেমনি ভোক্তা তার উপযোগ সর্বোচ্চকরণের জন্য যেকোনো দ্রব্য ভোগ করতে পারে। ফলে উৎপাদক এবং ভোক্তার মধ্যে এ অর্থব্যবস্থায় অবাধ প্রতিযোগিতা লক্ষ করা যায়।
৬. সমাজে বিভিন্ন শ্রেণির উদ্ভব
সম্পদের ব্যক্তিমালিকানার কারণে এ অর্থব্যবস্থায় উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত বিভিন্ন শ্রেনীর অস্তিত্ব লক্ষ্য করা যায়।
৭. সরকারি নিয়ন্ত্রণহীনতা
ধনতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থায় উৎপাদক তার মুনাফা সর্বোচ্চকরণের লক্ষ্যে কাজ করে আর ভোক্তা ভোগের মাধ্যমে তার উপযোগ সর্বোচ্চ করতে চায়। এতে উৎপাদক ও ভোক্তা উভয়ই স্বাধী এবং এতে কোনো সরকারি নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজন অনুমোদিত নয়।
৮. সম্পদের দক্ষ ব্যবহার
প্রতিযোগিতার বাজারে উৎপাদনকারী যদি তার মুনাফা সর্বোচ্চকরণ করতে চায়, তবে তাকে উৎপাদন খরচ সর্বনিম্ন করতে হবে। এর ফলে উৎপাদনকারী উৎপাদনের উপকরণসমূহকে সর্বোচ্চ দক্ষতার সাথে ব্যবহার করে।
৯. স্বয়ক্রিয় দামব্যবস্থা
ধনতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থা অনিয়ন্ত্রিত। সরকার বা অন্য কোন উৎস থেকে দাম নিয়ন্ত্রণ করা হয় না। বরং চাহিদা ও যোগানের মাধ্যমে ক্রেতা ও বিক্রেতার পারস্পরিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার দ্বারা বাজারে দাম নির্ধারিত হয়। এ দাম ক্রেতা ও বিক্রেতা উভয়ই মেনে নিয়ে কার্যক্রম চালিয়ে যায়।
১০. বৃহদায়তন উৎপাদনব্যবস্থা
ইউরোপের ‘শিল্প বিপ্লবের’ ফলে ধনতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থায় বৃহদাকার যন্ত্রচালিত শিল্পকারখানার বিকাশ ঘটে।
১১. শ্রমবিভাগ সৃষ্টি
পুঁজিপতিদের মধ্যে অবাধ প্রতিযোগিতা, উৎপাদন কৌশলের পরিবর্তন এবং বৃহৎ আকারের উৎপাদন প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠার ফলে ব্যাপক শ্রমবিভাগ সৃষ্টি হয়।
১২. মুনাফা অর্জন
এ অর্থব্যবস্থায় উৎপাদনকারী মুনাফা সর্বোচ্চকরণের লক্ষ্যে তার উৎপাদনকাজ পরিচালনা করে। যেসব ক্ষেত্রে মুনাফা বৃদ্ধির সম্ভাবনা থাকে, সেসব ক্ষেত্রে উৎপাদন বৃদ্ধি পায়। এখানে মুনাফাই মূল লক্ষ্য।
১৩. কলাকৌশলে ভিন্নতা
প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য এ অর্থব্যবস্থায় উৎপাদনকারীরা ভিন্ন ভিন্ন কলাকৌশল প্রয়োগের মাধ্যমে উৎপাদনকাজ পরিচালনা করে, যাতে তার মুনাফা সর্বোচ্চকরণ সম্ভব হয়।
১৪. পুঁজির বিকাশ
ধনতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থা একটি সুদভিত্তিক অর্থব্যবস্থা। এখানে সুদভিত্তিক ব্যাংকিং ব্যবস্থার মাধ্যমে পুঁজির বিকাশ ত্বরান্বিত হয়।
১৫. আয়-বণ্টনে অসমতা
এ অর্থব্যবস্থায় ব্যক্তিগত মালিকানা স্বীকৃত। এর ফলে সম্পদের অসম বণ্টন হয়। এখানে যার সম্পদ যত বেশি, তার আয় তত বেশি। এতে আয় ও সম্পদ বণ্টনে অসমতা দেখা দেয়।