মূলধন বাজেটিং কি?
সাধারণ অর্থে মূলধন বিনিয়োগের সাথে সম্পর্কিত পরিকল্পনাকে মূলধন বাজেটিং বলে। অর্থাৎ, প্রতিষ্ঠানের অর্থ বিনিয়োগের মাধ্যমে মুনাফা অর্জন পরিকল্পনাকে সংক্ষেপে Capital Budgeting বলে। বিশেষত মূলধন বাজেটিং বলতে সিদ্ধান্ত গ্রহণের সে প্রক্রিয়াকে বুঝায় যার মাধ্যমে ফার্মসমূহ তাদের প্রধান প্রধান স্থায়ী সম্পত্তিতে বিনিয়োগ এবং তা হতে অর্থ প্রাপ্তির মূল্যায়ন করে থাকে।
প্রত্যেক কারবার প্রতিষ্ঠান মুনাফা সর্বাধিকরণের লক্ষ্যে কাজ করে। কিন্তু ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান জটিল ও ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশে কাজ করে বিধায় যে কোনো প্রক্রিয়ায় দীর্ঘমেয়াদি মুনাফা সর্বাধিকরণ করা সম্ভবপর হয় না। এমতাবস্থায় বিনিয়োগ ও অর্থ সংস্থানের জন্য দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হয়। সুতরাং, প্রতিষ্ঠানের মুনাফা সর্বাধিকরণের লক্ষ্যে বিনিয়োগ এবং বিনিয়োগের অর্থসংস্থানের জন্য দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রণয়নের সিদ্ধান্তকে মূলধন বাজেটিং বলে।
বিভিন্ন লেখক Capital Budgeting এর বিভিন্ন সংজ্ঞা প্রদান করেছেন। নিম্নে কয়েকটি উল্লেখ করা হলো-
According to John J. Hampton, “Capital budgeting describes the firm’s formal planning process for the acquisition and investment of capital.” অর্থাৎ, মূলধন বাজেটকরণ হচ্ছে প্রতিষ্ঠানের একটি আনুষ্ঠানিক পরিকল্পনা প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠান মূলধন সংগ্রহ এবং বিনিয়োগ করে থাকে।
According to Horngren, “Capital budgeting is the long-term planning decisions for making and financing proposed capital out lays.” অর্থাৎ, মূলধন বাজেট প্রণয়ন বিনিয়োগ এবং এর অর্থসংস্থানের জন্যে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রণয়নের সিদ্ধান্ত।
মূলধন বাজেটিং এর গুরুত্ব বা প্রয়োজনীয়তা
কোনো প্রতিষ্ঠানের জন্য মূলধনী ব্যয়ের ক্ষেত্রে সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়া একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ। স্থায়ী সম্পত্তিতে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের হাতে অসংখ্য প্রকল্প থাকে। এ সব প্রকল্প থেকে সর্বোৎকৃষ্ট প্রকল্পটি নির্বাচন করার প্রক্রিয়াটি হলো মূলধনা বাজেটিং। এক কথায়, To select the best project before investment is called Capital Budgeting. আর Capital Budgeting প্রতিষ্ঠানের দীর্ঘমেয়াদি এবং বিরাট অংকের আর্থিক বিনিয়োগের সাথে সম্পৃক্ত। তাই এর তাৎপর্য অন্যান্য স্বল্পমেয়াদি বিনিয়োগ সিদ্ধান্তের চেয়ে অনেক বেশি।
আরও পড়ুন: নিট বর্তমান মূল্য ও অভ্যন্তরীণ উপার্জন হার পদ্ধতির মধ্যে পার্থক্য
সঠিক মূলধন বিনিয়োগ সিদ্ধান্তের উপর প্রতিষ্ঠানের ভবিষ্যৎ উন্নয়ন অনেকাংশে নির্ভরশীল। সুতরাং কোনো প্রতিষ্ঠানের আর্থিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে মূলধন বাজেটিং এর গুরুত্ব অপরিসীম। কারণ বিনিয়োগ প্রকল্প নির্বাচনের ক্ষেত্রে ভুল সিদ্ধান্ত প্রতিষ্ঠানের উপর মারাত্মক বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। সঠিক বিনিয়োগ সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষেত্রে ব্যবস্থাপকের তাই মূলধন বাজেটের উপর যথেষ্ট নির্ভর করতে হয়। তাছাড়া নিম্নোক্ত কারণেও মূলধন বাজেটিং ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের জন্য অতীব গুরুত্বপূর্ণ।
১। সঠিক বিনিয়োগ নিশ্চিতকরণ
পণ্যের ভবিষ্যৎ চাহিদার দিকে লক্ষ্য রেখে বিনিয়োগ সম্প্রসারণ করা হয়। সুতরাং এটি ভবিষ্যৎ বিক্রয়ের সাথে সম্পৃক্ত। কিন্তু বিক্রয়ের পূর্বাভাস সঠিকভাবে করতে না পারলে স্থায়ী সম্পত্তিতে বিনিয়োগ কম বা বেশি হতে পারে যা প্রতিষ্ঠানের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর হতে পারে। কিন্তু মূলধন বাজেটিং এ ধরনের সমস্যা থেকে প্রতিষ্ঠানকে রক্ষা করে।
২। প্রতিযোগিতা মোকাবিলা
প্রযুক্তিগত পরিবর্তনের ফলে উৎপাদন পদ্ধতির পরিবর্তন করতে হয়। নতুবা প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়ে। মূলধন বাজেটিং সিদ্ধান্তের মাধ্যমে প্রত্যাশিত ও মান সম্পন্ন দ্রব্য উৎপাদন করে ভবিষ্যৎ প্রতিযোগিতার মোকাবিলা করা যায়।
৩। মুনাফা অর্জন ক্ষমতা
কোনো প্রতিষ্ঠানের মুনাফা অর্জন ক্ষমতার উপর মূলধন বাজেটিংয়ের যথেষ্ট প্রভাব রয়েছে। সঠিক বিনিয়োগ সিদ্ধান্ত প্রতিষ্ঠানকে কাঙ্ক্ষিত ফলাফল এনে দিতে পারে। কিন্তু ভুল বিনিয়োগ সিদ্ধান্ত প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্বকে বিপন্ন করে দেয়।
৪। ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তা
মূলধন বাজেটিং সিদ্ধান্ত নেয়া খুবই কঠিন কাজ। এ জন্য ভবিষ্যতের অনিশ্চিত বিভিন্ন ধরনের ঘটনার উপর সঠিক ধারণার প্রয়োজন। তাছাড়া সংখ্যাগতভাবে ভবিষ্যৎ মুনাফা এবং ব্যয় পরিমাপ করা একটা জটিল সমস্যা। কারণ মুনাফার অনিশ্চয়তা ও ব্যয় নির্ধারিত হয়ে অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ও প্রযুক্তিগত উপাদানের উপর ভিত্তি করে। এদিক থেকেও Capital Budgeting-এ যথেষ্ট গুরুত্ব আরোপ করা হয়।
৫। স্থায়ী সম্পদের স্থায়িত্ব
স্থায়ী সম্পদ ও প্রতিষ্ঠানের যন্ত্রপাতিগুলোর ভবিষ্যতের স্থায়িত্ব সম্বন্ধে ধারণা দিতে পারে একমাত্র মূলধনী বাজেট। তাই স্থায়ী সম্পদগুলোর ক্ষেত্রে মূলধন বাজেটিং-এর গুরুত্ব অপরিসীম।
৬। মোটা অংকের মূলধন
মূলধন বাজেটিং দীর্ঘমেয়াদি হওয়ায় সব সময় বড় অঙ্কের তহবিল বিনিয়োগ বিবেচনা করে। যে কোনো ভুল সিদ্ধান্তের কারণে কোম্পানির বিরাট অঙ্কের মাশুল দিতে হয়। তাই ব্যবস্থাপনায় Capital Budgeting যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ।
৭। সময়মতো সম্পদ সংগ্রহ
মূলধন বাজেটিং যদি সঠিকভাবে প্রণয়ন করা হয় সেক্ষেত্রে ফার্মের আর্থিক ব্যবস্থাপক সময়মতো সম্পদ সংগ্রহ এবং সম্পদের মানোন্নয়নের ব্যাপারে বিশেষ গুরুত্ব দিতে পারে।
৮। ঝুঁকি হ্রাসের পদক্ষেপ
দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ সিদ্ধান্ত ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের গড় আয় বৃদ্ধি করতে পারে। কিন্তু এ আয় বৃদ্ধিতে যদি ধারাবাহিকতা না থাকে তখন প্রতিষ্ঠানের ঝুঁকির চিত্র পরিবর্তন হয়ে যায়। মূলধনী বিনিয়োগ সিদ্ধান্ত যদি ব্যবসায়ের ঝুঁকি বৃদ্ধি করে, তবে এটা ব্যবসায়ের জন্য দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তাই সুচিন্তিতভাবে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত।
৯। অপরিবর্তনযোগ্যতা
মূলধন বাজেটিং সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের পর একে আর পরিবর্তন করা যায় না। কাজেই Capital Budgeting সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগেই গুরুত্বের সাথে এটাকে বিবেচনা করতে হবে।
১০। দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ
মূলধন বাজেটিং সিদ্ধান্ত দীর্ঘমেয়াদি মুনাফার ব্যবস্থা করে থাকে। সাধারণত দীর্ঘমেয়াদি সিদ্ধান্তের নমনীয়তা কম। অর্থাৎ, দীর্ঘমেয়াদি সিদ্ধান্ত গ্রহণে ভুল বা ত্রুটি থাকলে তা পরবর্তীতে ইচ্ছা করলেই পরিবর্তন করা যায় না। তাই দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ মূল্যায়নে বাজেটিং যথেষ্ট গুরুত্ব বহন করে।