রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সাথে মনোবিজ্ঞানের সম্পর্ক
রাষ্ট্র পরিচালনায় যেমন মনোবিজ্ঞানের জ্ঞান প্রয়োজন তেমনি মনোবৈজ্ঞানিক চিন্তা ভাবনায়ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের জ্ঞান কিছুটা হলেও প্রভাব রাখে। গ্রিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানী এরিস্টটল বলেছেন, “মানুষ মাত্রই সামাজিক জীব। যারা রাষ্ট্রীয় আওতার বাইরে তাদের স্থান মানব সমাজের উপরে বা নিচে।”
রাষ্ট্রবিজ্ঞান রাষ্ট্র ও নাগরিকতা সম্পর্কিত মানুষের কার্যাবলি নিয়ে আলোচনা করে। কিন্তু মনোবিজ্ঞান পর্যালোচনা করে মানুষের মানসিক দিকসমূহকে নিয়ে। রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও মনোবিজ্ঞানের সম্পর্ককে ৪টি ভাগে দেখানো যেতে পারে। যথা-
১। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগের গবেষকগণ,
২। ফরাসি মনোবিজ্ঞানী লে বঁ এর অভিমত,
৩। বর্তমান প্রবণতা,
৪। ইংরেজ লেখক বার্কারের বক্তব্য।
১। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগের গবেষকগণ
ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে প্রধানত ডারউইনের জীববৈজ্ঞানিক গবেষণার ফলে রাষ্ট্রবিজ্ঞান জীববিজ্ঞান দ্বারা প্রভাবিত হয়। পরবর্তীকালে বিশেষত বিংশ শতাব্দীতে মনোবিজ্ঞানের আলোকে রাষ্ট্রকে বুঝবার প্রয়াস জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। লর্ড ব্রাইস বলেছেন যে, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের মূল মনোবিজ্ঞানের মধ্যে নিহিত রয়েছে। মানুষের স্বাভাবিক প্রবৃত্তি (Instinct) ও চিত্তাবেগ (Emotion), মানসিক গঠন ও ইচ্ছাশক্তি (Volition) রাষ্ট্রের উপর প্রভাব বিস্তার করে। এ প্রভাব গণতন্ত্রে বিরাট আকার ধারণ করে।
আরও পড়ুন: রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও সমাজবিজ্ঞানের মধ্যকার সম্পর্ক আলোচনা কর
২। ফরাসি মনোবিজ্ঞানী লে বঁ এর অভিমত
ফরাসি মনোবিজ্ঞানী লে বঁ বলেছেন যে, রাষ্ট্রের ধরন অনেকাংশে জাতির “Mental Constitution” বা মানসিক গঠন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। কোন রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে স্থায়িত্ব দিতে হলে সেটিকে জনসাধারণের মানসিক গতির সাথে মিল রেখে চলতে হবে। রেঁনা প্রমুখ রাষ্ট্র চিন্তাবিদেরা স্বীকার করেছেন যে, জাতীয়তা (Nationality) অনেক পরিমাণে দেশের জনসাধারণের মানসিক একাত্মতার উপর নির্ভর করে, তেমনি রাজনৈতিক দলগুলো জনমত গঠন করার ক্ষেত্রে নাগরিকগণের মানসিক প্রবণতা অনুযায়ী নিজ নিজ নীতিপদ্ধতি স্থির করে থাকে। সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে, মনোবিজ্ঞান তথা সামাজিক মনোবিজ্ঞানের সাথে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সম্পর্ক রয়েছে। এখানে উল্লেখ্য যে, কেবল মনোবিজ্ঞানের প্রয়োগে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ধারা নির্ণয় করা সম্ভব নয়।
৩। বর্তমান প্রবণতা
মনোবিজ্ঞান আজকাল নির্ভরতার সাথে মানুষের কার্যাবলির সঠিক প্রকৃতি নির্ধারণে সহায়ক হয়ে উঠেছে। মানুষ তার মানসিক প্রবৃত্তি, ভাবাবেগ ও অভ্যাস দ্বারা বহুলাংশে প্রভাবিত হয়। ফলে জনমত, সংগঠন, জাতীয়তাবাদ, রাজনৈতিক দলের সংগঠন ও কার্যকলাপ, অভ্যন্তরীণ অসন্তোষ ও আন্তর্জাতিক সংঘর্ষের ব্যাখ্যা মনোবিজ্ঞানের পর্যালোচনার মাধ্যমে সঠিকভাবে জানা যায়। আধুনিককালে রাজনৈতিক সম্পর্কে Prof. Erikson বলেছেন, “রাজনৈতিক কার্যক্রমের সঠিক ব্যাখ্যা নিহিত রয়েছে ব্যক্তিত্ব গঠন প্রক্রিয়ার বিশ্লেষণে।” তাই রাষ্ট্রনায়ক বা যোগ্য শাসককে মনোবিজ্ঞানের সূত্র ধরে নীতিনির্ধারণ করতে হবে। মানসিক প্রবৃত্তি বিচার করে আইন প্রণয়নে উদ্যোগী হতে হবে। মানুষের ভাব, প্রবণতা এবং চিন্তাধারার উৎস সন্ধান করেই সরকার গঠন ও পরিচালনা করা বাঞ্ছনীয়।
৪। ইংরেজ লেখক বার্কারের বক্তব্য
ইংরেজ লেখক বার্কার রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে মনোবিজ্ঞানী পদ্ধতি প্রয়োগের কয়েকটি অপূর্ণতার উল্লেখ করেছেন। অন্যান্য বিজ্ঞানের সাথেও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সম্পর্ক স্থাপন সত্য সন্ধানের জন্য আবশ্যক। যেসব মনীষী মনোবিজ্ঞানের আলোকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানকে বুঝতে চেষ্টা করেছেন তাঁদের মধ্যে ম্যাকডুগাল, গ্রেহেম ওয়ালস, ট্রাটার, লে বঁ, তার্দে প্রমুখের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
অতএব, বলা যায়, রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও মনোবিজ্ঞানের সম্বন্ধ অত্যন্ত নিবিড়, যদিও মনোবিজ্ঞানের পর্যালোচনা রাষ্ট্রবিজ্ঞানে সীমিতভাবে প্রযোজ্য হয়। শুধু রাজনৈতিক কার্যকলাপের ক্ষেত্রে যতটুকু মনোবৈজ্ঞানিক চিন্তাভাবনার দরকার ততটুকুই রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।