গৌতম বুদ্ধ ছিলেন মধ্যপথ অনুসারী। তাঁর ধর্ম দর্শন ও ব্যবহারিক জীবনের সর্বত্রই এর প্রত্যয় উপস্থিত রয়েছে। মধ্যপথ শুধু ব্যক্তির চারিত্রিক উন্নয়ন ও মানসিক উৎকর্ষতা সাধন করে না বরং এর সাথে আর্থিক কল্যাণ ও পারস্পরিক সামাজিক সম্পর্ক উন্নয়নে ভূমিকা রাখে। কারণ এই মধ্যপথের মুখ্য বিষয় সততা, সংযমতা ও অপ্রমেয় মৈত্রীর চর্চা। যা পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতা, উন্নয়ন ও ঐক্যের ক্ষেত্রে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। তাই প্রত্যেকের আপন আপন শান্তি নিশ্চিত করার এবং সততা ও সংযমশীলতা রক্ষার সমষ্টিগত উপায় হিসাবে বুদ্ধ বৈশালীর জনসাধারণকে অমূল্য সপ্ত অপরিহানীয় ধর্ম পালনের নির্দেশ দিয়েছিলেন।
সপ্ত অপরিহানীয় ধর্ম:
অপরিহানীয় শব্দের অর্থ সর্বজনীয়, ত্যাগ বা পরিহার না করা। বুদ্ধ নির্দেশিত যে সাতটি নিয়ম অনুসরণ করলে ব্যক্তিগত, সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় জীবনে উন্নতি ও সমৃদ্ধি ঘটে সেগুলোকে সপ্ত অপরিহানীয় ধর্ম বলা হয়। এগুলো হলো-
১) যারা সভা-সমিতির মাধ্যমে একত্রিত হয়ে পরামর্শ করে কর্মসূচী নির্ধারণ করে তাদের সর্বদা শ্রীবৃদ্ধি হয়।
২) যারা গৃহীত কর্মসূচী সম্মিলিতভাবে সম্পাদন করে, এবং কোন বিষয়ে মত বা বিবাদ দেখা দিলে একত্রে বসে মীমাংসা করে তাদের সর্বদা শ্রীবৃদ্ধি হয়।
৩) যে জাতি সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে দূর্নীতিকে প্রশ্রয় না দেয় এবং প্রথাগত সুনীতিগুলো লঙ্ঘন না করে মেনে চলে, তাদের সর্বদা শ্রীবৃদ্ধি হয়।
৪) যারা বয়োবৃদ্ধদের সম্মান, মাতা-পিতাদের সম্মান ও তাদের হিতোপদেশ মেনে চলে, তাদের শ্রীবৃদ্ধি হয়।
৫) যে জাতির পুরুষেরা কূল-বধূ, কূল-রমণী অর্থাৎ মেয়েদের সম্মান রক্ষা করে চলে, মেয়েদের উপর কোনপ্রকার নির্যাতন করে না, তাদের শ্রীবৃদ্ধি হয়।
৬) যে জাতি পূর্বনির্মিত ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, বিহার, চৈত্য ইত্যাদি রক্ষা এবং পূজা করে তাদের শ্রীবৃদ্ধি হয়।
৭) যে জাতির লোকেরা ধর্মীয় গুরু, অর্হৎ ও শীলবান ভিক্ষুদের সেবা ও পূজা করেন অর্থাৎ গুণের সমাদর করেন, তাদের শ্রীবৃদ্ধি হয়।
সপ্ত অপরিহানীয় ধর্মের প্রেক্ষাপট:
প্রায় আড়াই হাজার বছর পূর্বের কথা। তখন বর্তমান ভারতের বৈশালী (বেসাড়) ছিল সমৃদ্ধশালী নগরী। এই বৈশালী নগরীতে বাস করতেন বজ্জী জাতির লোকেরা। কথিত আছে, বজ্জীরা শিল্প-সংস্কৃতি, ঐক্যবিধান ও গণতন্ত্র চর্চায় বেশ উন্নত ছিল। বজ্জীদের গণতন্ত্রকে আধুনিক গণতন্ত্রের সূতিকাগারও বলা হয়। নগরীটির বিস্তৃতি ছিল হিমালয় পর্বতমালা থেকে আধুনিক ভারতের বিহার রাজ্যের গাঙ্গেয় উপত্যকা পর্যন্ত। একবার বৈশালীতে দুর্ভিক্ষ, অনাবৃষ্টি, মহামারী ও অমনুষ্যের উপদ্রব দেখা দেয়। বৈশালীবাসীগণ এতে শংকিত হয়ে পড়েছিলেন। তারা সকলে সম্মিলিত হয়ে এর থেকে মুক্তিকল্পে করুণাময় বুদ্ধের কাছে উপস্থিত হয়ে বুদ্ধকে বৈশালীতে আহ্বান জানান। বুদ্ধ বৈশালীতে আগমণ করলে প্রচুর বৃষ্টিপাত হল। এবং পরিচ্ছন্ন নগরীতে স্বস্তি ফিরে এল। বুদ্ধ তাদেরকে সারনন্দন চৈত্যে একত্রিত করে সমাজের জন্য প্রয়োজনীয় সপ্ত অপরিহানীয় ধর্ম সম্পর্কে উপদেশ প্রদান করেছিলেন।
আরও পড়ুন |
গান্ধার শিল্পের সংক্ষিপ্ত ধারণা দাও। বৌদ্ধ শিল্পকলার ইতিহাসে এর গুরুত্ব মূল্যায়ণ কর। চার্বাক দর্শন কাকে বলে? চার্বাক দর্শনের জ্ঞানতত্ত্ব আলোচনা কর। |
সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে সপ্ত অপরিহানীয় ধর্মের গুরুত্ব:
সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে বুদ্ধ দেশিত এই অপরিহানীয় ধর্মের গুরুত্ব অপরিসীম। নিম্নে বিভিন্ন ক্ষেত্রে এর প্রয়োগ সম্পর্কে আলোচনা করা হল:
বুদ্ধের সপ্ত অপরিহানীয় ধর্মের প্রয়োগ:
সপ্ত অপরিহানীয় ধর্মের প্রথম দুটি ধর্ম গণতন্ত্রের পরিচায়ক। আধুনিক গণতন্ত্র সৃষ্টির আড়াই হাজার বছরেরও পূর্বে বুদ্ধ গণতন্ত্রের জন্ম দিয়েছিলেন। তাঁর ধর্মে উঁচু-নিচু সকলের সমানাধিকার ছিল। তিনি গুণবান লোকদের প্রাধান্য দিতেন। জাত্যাভিমান ও বংশ মর্যাদাকে বুদ্ধ এড়িয়ে চলতেন। বুদ্ধ বলেছিলেন-
“ন জটাহি ন গোত্তেন ন জচ্চা হোতি ব্রাক্ষণ
যমহি সচ্চঞ্চ ধম্মো চ সো সূচী সো চ।”
অর্থাৎ জন্মের দ্বারা কেউ ব্রাক্ষণ হয় না, কর্মের দ্বারা ব্রাক্ষণ হয়।
তৃতীয় ধর্ম: এ ধর্মে রাষ্ট্রীয় রীতি-নীতি ও প্রাচীন অনুশাসনের কথা বলা হয়েছে। বুদ্ধের সময় রাজা শুদ্ধেধন, বিম্বিসার, প্রসেনজিৎ, উদয়ন প্রমুখ রাজাগণের খ্যাতি প্রতিপত্তির কথা জানা যায়। তাঁরা সকলেই বৌদ্ধধর্মে দীক্ষিত হয়েছিলেন। তাদের অধীনে প্রজাবর্গ রাষ্ট্রীয় অনুশাসন মেনে চলত। পরবর্তী সময়ে অশোক, কণিষ্ক, গুপ্ত, পাল বংশীয় রাজাদের অধীনে প্রজাগণ বুদ্ধের অনুশাসনগুলো মেনে সুখ-সমৃদ্ধি অর্জন করেছিল।
চতুর্থ ধর্ম: “অভিবাদন সীলস্স নিচ্চং বদ্ধাপচাযনো
চত্তারো ধম্মা বড্ঢন্তি আযুবন্নো সুখং বলং”
অর্থাৎ মাতা-পিতা (জ্ঞান ও বয়ো) বৃদ্ধদের প্রতি সতত অভিবাদন ও সম্মান প্রদর্শনকারীর আয়ু, বর্ণ, সুখ ও বল এই চতুর্বিধ সম্পদ বৃদ্ধি হয়। বুদ্ধ মঙ্গলসূত্রে আরও বলেছেন,
“পূজা চ পূজানীযনং এতং মঙ্গল মুত্তমং।”
অর্থাৎ পূজনীয় ব্যক্তির পূজা করা উত্তম মঙ্গল। পূজনীয় ব্যক্তির সেবা করা ও গৌরবান্বিত ব্যক্তির গৌরব ও সম্মান করাও মঙ্গল।
পঞ্চম ধর্ম: পঞ্চম ধর্মে নারী জাতির মর্যাদা রক্ষা করার কথা বলা হয়েছে। বুদ্ধ মহাপ্রজাপতি গৌতমীর অনুরোধে নারীদের ভিক্ষুণী সংঘে প্রবেশাধিকার দিয়ে নারী জাতির মর্যাদা দিয়েছিলেন।
ষষ্ঠ ধর্ম: এ ধর্মে চৈত্যের সংরক্ষণ ও নিয়মিত পূজা করার কথা বলা হয়েছে। বৌদ্ধ ইতিহাসে দেখা যায় অনেক ধনাঢ্য ব্যক্তি বিহার ও চৈত্য নির্মাণ করে সংঘকে দান ও এগুলো সংরক্ষণসহ ধর্ম পালনের সুব্যবস্থা করেছিলেন। তাছাড়া বুদ্ধের মহাপরিনির্বাণের পর তাঁর দেহবশেষ রাজা অজাতশত্রু, বৈশালীর লিচ্ছবিগণ, কপিলাবস্তুর শাক্যগণ, কুশীনগরের মল্লগণ প্রমূখ ভাগ করে নিয়ে এর উপর স্তুপ নির্মাণ করেন।
সপ্তম ধর্ম: এতে ধর্মাচার্যগণের সেবা করা ও সুখ-সুবিধার ব্যবস্থা করার কথা বলা হয়েছে। শীলবান, সংসারত্যাগী, কল্যাণমিত্র, ধর্মাচার্যগণের প্রতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে। এতে করে সমাজে গুণীবানরা পূজিত হবেন এবং গুণের কদর বৃদ্ধি পাবে যা সমাজ ও রাষ্ট্রের অগ্রগতিতে যথেষ্ট ইতিবাচক ভূমিকা রাখে।
রাষ্ট্রীয় সুশাসনে সপ্ত অপরিহানীয় ধর্ম:
রাষ্ট্রীয় সুশাসন বিষয়ে বুদ্ধ দেশিত সপ্ত অপরিহানীয় ধর্মে এর দিক নির্দেশনা পাওয়া যায়। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে রাষ্ট্রীয় সুশাসন বা “Good Governance” একটি অধুনা প্রচলিত শব্দ হলেও সমাজ এবং ধর্মে এর অস্তিত্ব বহু আগে থেকেই ছিল।
নিচে রাষ্ট্রীয় সুশাসনে সপ্ত অপরিহানীয় ধর্মের প্রয়োগ তুলে ধরা হল-
১) রাষ্ট্রীয় সৎ শাসনের মূল কাঠামো: রাষ্ট্রীয় সৎ শাসনের মূল কাঠামোতে আছে রাষ্ট্রের শাসন ব্যবস্থায় সকল নর-নারীর সমান অংশ গ্রহণের সুযোগ। সপ্ত অপরিহানীয় ধর্মেও গণতান্ত্রিক ধারাকেই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। এবং সভা-সমিতিতে সকলের অংশগ্রহণ ও পরামর্শ সাপেক্ষে কর্মসূচী নির্ধারণ ও সম্পাদনের কথা বলা হয়েছে।
২) আইনের শাসন: আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজন নিরপেক্ষ সৎ আইনসম্মত বিধিব্যবস্থা। মানবাধিকার রক্ষায় পূর্ণ সুশাসন ও স্বচ্ছতা থাকা আবশ্যক। সপ্ত অপরিহানীয় ধর্ম এই বিষয়গুলোর উপর জোর দেয়া হয়েছে। যেমন-
ক) আইন ও বিধি মোতাবেক সর্বসম্মতক্রমে কোন বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও তার রুপায়ন।
খ) নারী-পুরুষের সমানাধিকার ও পুরুষ কর্তৃক নারী নির্যাতন বন্ধ।
এই সপ্ত অপরিহানীয় ধর্ম বজ্জীদের মধ্যে দীর্ঘকাল প্রচলিত ছিল বলে মগধরাজ অজাতশত্রু বজ্জীদের মধ্যে পরস্পর বিচ্ছেদ ঘটানো আগ পর্যন্ত সম্মুখ যুদ্ধে পরাস্ত করার পরিকল্পনা ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন। তাই বলা যায়, বৈশালীর অধিবাসী বজ্জীদের প্রতি দেশিত বুদ্ধের সপ্ত অপরিহানীয় ধর্ম যে কোন স্বাধীন, সার্বভৌম রাষ্ট্রের উন্নতি ও টিকে থাকার জন্য এখনও সমানভাবে প্রযোজ্য।