Home » কুটিকা কি? কুটিকা কবিতার দার্শনিক তত্ত্ব আলোচনা কর।

কুটিকা কি? কুটিকা কবিতার দার্শনিক তত্ত্ব আলোচনা কর।

by TRI

অথবা, কুটিকা কবিতার অন্তর্নিহিত তত্ত্ব ও আধ্যাত্মিক চেতনা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা কর।

ভূমিকা:
জন্ম মাত্রই দুঃখ। জন্মের কারণে মানুষ মাতা-পিতা, ভাই-বোন, স্মামী-স্ত্রী, আত্মীয়-স্বজন বিভিন্ন বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে পড়ে। যতক্ষণ পর্যন্ত মানুষ এসব বন্ধন থেকে মুক্ত হতে পারবে না ততক্ষণ পর্যন্ত দুঃখ থেকে মুক্ত হতে পারবে না। বুদ্ধ বলেছেন, “ত্যাগই সুখ, ত্যাগই শান্তি।” তিনি দুঃখ থেকে চিরমুক্তির অন্বেষায় গৃহত্যাগ করে কঠোর সাধনার দ্বারা দুঃখ মুক্তির পথ চতুরার্য সত্য, আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গ তথা নির্বাণ পথ প্রদর্শন করেন। যারা সমস্ত প্রকার সংসার বন্ধন ত্যাগ করে চতুরার্য সত্য, আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গ জ্ঞান লাভ করতে পারবে তারাই দুঃখ থেকে মুক্ত হবে। সেই ধরণের দুঃখ মুক্তির কথা আলোচিত হয়েছে। “কুটিকা” নামক রুপক কবিতাটি সংযুক্ত নিকায়ের এক অনবদ্য সার্থক কবিতা। জনৈক দেবতার সাথে বুদ্ধের কথোপকথনের মধ্য দিয়ে ‘কুটিকা’ কবিতার সৃষ্টি হয়।

কুটিকা কী:
কুটিকা বলতে কুটিরকে বোঝানো হয়েছে যার অর্থ হল গৃহবন্ধন। এটাকে সংসার বন্ধনও বলা যায়। গৃহ বন্ধন বা সংসার কিভাবে হয় এবং বৌদ্ধ তাত্ত্বিক ব্যাখ্যায় গৃহবন্ধনের উপাদানসমূহ কি কি এ বিষয়ে দেবতা ও বুদ্ধ প্রশ্নোত্তরে আলোচনা করেছেন। ভগবান বুদ্ধ শ্রাবস্তীর জেতবন বিহারে জনৈক দেবতার সাথে কথোপকথন হয়। কথোপকথনে ঐ দেবতা বুদ্ধের নিকট হতে কুটিকা কাকে বলে এ সম্বন্ধে জানতে চান। উত্তরে বুদ্ধ বলেন, জীবনের প্রতিটি স্তরে যে বন্ধন রয়েছে তার নামই ‘কুটিকা’।

আরও পড়ুন:  জটা শব্দের অর্থ কি? এ কবিতার মূলভাব ব্যাখ্যা কর।

দার্শনিক তত্ত্ব/অন্তর্নিহিত তত্ত্ব ও আধ্যাত্মিক চেতনা:
বুদ্ধ দেবতাকে বলেন, “বন্ধনহীন ব্যক্তিই মুক্ত।” দেবতা পুনঃ প্রশ্ন করলেন, কার কুটির নেই? কার বাসা নেই? কার সন্তান নেই? কার বাসা নেই? কার সন্তান নেই? কে বন্ধন মুক্ত? এর উত্তরে বুদ্ধ বলেন, আমার এগুলো কিছুই নেই। সুতরাং আমি বন্ধনমুক্ত। বুদ্ধ ‘কুটির’ বলতে মাতাকে, কুলায় বলতে স্ত্রীকে, সন্তানকা বলতে পুত্রকন্যাকে এবং বন্ধন বলতে বাসনাকেই নির্দেশ করেন। এতে দেবতা অতি প্রীত হন েএবং তার ভ্রান্ত ধারণার উপশম হয়। পরে দেবতা বুদ্ধের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা পোষণ করেন। মাতা, পিতা, স্ত্রী, পুত্র–কন্যা প্রভৃতি মায়া, মোহ, আসক্তি, তৃষ্ণা এগুলো সকলই বাঁধন স্বরুপ। এগুলো ব্যবহারিক সত্যমাত্র, প্রাণীমাত্রই পঞ্চস্কন্ধের সমষ্টি এবং সকলই অনিত্য। যা উৎপত্তির তা ক্ষয়শীল। তৃষ্ণা বা আসক্তির কারণে প্রাণীগণ সংসার দুঃখ হতে মুক্ত হতে পারে না। সর্ব প্রকারের কামনা বাসনা ও তৃষ্ণাকে ধ্বংস করতে পারল সর্বদুঃখ হতে মুক্ত হওয়া যায়। আসক্তিহীন জীবনের মাতা-পিতা, স্ত্রী-পুত্র, কন্যা ও কোন প্রকার আসক্তি নেই। এটাই কবিতার প্রতিপাদ্য বিষয়।
কুটিকা কবিতার মাধ্যমে জীবন দর্শনকে নিখুঁতভাবে তুলে ধরা হয়েছে। এই কবিতার মূল প্রতিপাদ্য বিষয়ের সাথে কবিতাটি নামকরণের যথেষ্ট সঙ্গতি রয়েছে। সেজন্য কবিতাটির নামকরণ ‘কুটিকা’ যথার্থ সার্থক হয়েছে। বন্ধন মুক্ত হতে পারলে সর্বদুঃখের অবসান ঘটে। বুদ্ধ কুটিকা কবিতার অন্তর্নিহিত তত্ত্ব ও আধ্যাত্মিক চেতনা সম্পর্কে যে আলোকচিত্র প্রদর্শন করেছেন তা নিম্নের কবিতাগুলো পড়ে বুঝা যায়-
           ‘কচ্চি তে কুটিকা নত্থি কচ্চি নত্থি কুলাবকা
            কচ্চি সন্তানকা নত্থি কচ্চি মুত্তোসি বন্ধনা?’
অর্থাৎ, দেবতা– কার কুটির নেই? কার বাসা নেই? কার সন্তান নেই? কে বন্ধন মুক্ত?
           ‘তগঘ মে কুটিকা নত্থি তগঘ নত্থি কুলাবকা               (গ তে হসন্ত হবে)
            অগঘ সন্তানকা নত্থি তগঘ মুত্তোমহি বন্ধনা।’             (গ ও ম তে হসন্ত হবে)
অর্থাৎ, ভগবান বুদ্ধ– তাই বটে, আমার কুটির নেই। আমার বাসা নেই। আমার সন্তান নেই। আমি বন্ধন মুক্ত।
            ‘কিন্তাহং কুটিকং ব্রূমি কিন্তে ব্রূমি কুলাবকং
             কিন্তে সন্তানকা ব্রূমি কিন্তহং ব্রূমি বন্ধনা?’
অর্থাৎ, দেবতা– আমি কোনটিকে কুটির বলছি? কোনটাকে কুলায় বলছি? কোনটিকে সন্তান বলছি? আর বন্ধন বলছি কাকে?
             ‘মাতরং কুটিকং ব্রূসি ভরিয়ং ব্রূসি কুলাবকং
               পুত্তে সন্তানকে ব্রূসি তণহং মে ব্রূসি বন্ধনং।’
অর্থাৎ, ভগবান বুদ্ধ– মাতকে কুটির , ভার্যা বা স্ত্রীকে কুলায়, পুত্র-কন্যাকে সন্তান এবং তৃষ্ণাকেই বন্ধন বলা হয়।
              ‘সাহু তে কুটিকা নত্থি সাহু নত্থি কুলাবকা
               সাহু সন্তানকা নত্থি সাহু মুত্তোসি বন্ধনা।’
অতঃপর দেবতা বুদ্ধকে বললেন– সাধু, আপনার কুটির নেই। সাধু, আপনার কুলায় নেই। আপনার সন্তান নেই। সুতরাং আপনি বন্ধন মুক্ত।

পরিশেষে ‘কুটিকা’ কবিতায় দেবতার প্রশ্নের উত্তরের জবাবে বুদ্ধ বলেন, আমি সেই সব মায়া মোহের আসক্তি থেকে মুক্ত। আমার কোন প্রকার বাঁধন বা বন্ধন নেই। দেবতাও তা স্বীকার করে নেন। এসব নীতি স্বীকার পূর্বক দেবতা বুদ্ধের পরম ভক্ত হন। মূলত কুটিকা কবিতায় বুদ্ধ তৃষ্ণা হতে মুক্ত হবার উপদেশ দেন।

সম্পাদনায়:  মেদিনী চাকমা

Related Posts