সরকারি ব্যয়
সরকারের দৈনন্দিন কার্যক্রম পরিচালনা এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য সম্পদ ব্যবহার তথা অর্থব্যয় অপরিহার্য। সরকারি ব্যয় ব্যবস্থাপনা সরকারের রাজস্ব ব্যবস্থাপনার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। সরকারি ব্যয়ের অগ্রাধিকার তালিকায় (i) গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো খাতে বরাদ্দ ও ব্যয় উৎসাহিতকরণ, (ii) বেসরকারি খাত কর্তৃক উৎপাদনশীল খাতে অধিক বিনিয়োগের অনুকূল পরিবেশ সৃজনের সহায়ক খাতে অধিক সম্পদ ব্যবহার, (iii) জন কল্যাণমুখী সামাজিক নিরাপত্তা খাতের ব্যয় অব্যাহত রাখা, (iv) সরকারি খাতের ব্যয়ে কৃচ্ছতা সাধন এবং (v) অনুৎপাদনশীল খাতে ব্যয় নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি ক্ষেত্রে বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করা হয়।
দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড তথা উৎপাদনমুখী কার্যক্রমের সহায়ক পরিবেশ সৃজনের মাধ্যমে জনগণের মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি, অধিকতর কর্মসংস্থান, জীবনমানের উন্নয়নের মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচন, ভৌত অবকাঠামো নির্মাণ এবং মানবসম্পদ উন্নয়নের লক্ষ্যে সরকার প্রতি বছর বিপুল অর্থ ব্যয় করে।
সরকারি ব্যয়ের উদ্দেশ্য
আধুনিককালে সরকারি ব্যয়ের প্রয়োজনীয়তা, গুরুত্ব, আওতা, পরিধি এবং ক্ষেত্র সম্পর্কে সরকার পূর্বেই জনগণকে অবহিত করেন। নিম্নে সরকারি ব্যয়ের উদ্দেশ্য বা প্রধান প্রধান খাতসমূহ আলোচনা করা হলো:
১. মৌলিক চাহিদা পূরণ
আধুনিককালে পৃথিবীর অধিকাংশ দেশেই জনসংখ্যা দ্রুত বেড়ে চলেছে। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার জন্য অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান ইত্যাদি মৌলিক চাহিদা পূরণের জন্য সরকারকে ক্রমশ অধিক পরিমাণে অর্থ ব্যয় করতে হয়।
বাংলাদেশের কুটির শিল্পের সমস্যা ও সমাধান |
২. প্রতিরক্ষা ব্যয় নির্বাহ
সরকারের প্রধান ও পবিত্রতম দায়িত্ব হলো দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষা করা। এ উদ্দেশ্যে সরকারকে সেনা-নৌ-বিমানবাহিনী গঠন, যুদ্ধের অত্যাধুনিক সরঞ্জামাদি উৎপাদন, ক্রয় ও সংরক্ষণ করার জন্য সরকারকে প্রচুর অর্থ ব্যয় করতে হয়। কারণ আধুনিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা অত্যন্ত ব্যয়বহুল।
৩. আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা
অব্যাহতভাবে অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য দেশের ভিতরে শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখার লক্ষ্যে বিচার বিভাগ, স্বাস্থ্য বিভাগ, শিক্ষা বিভাগ, স্থানীয় সরকার বিভাগ ইত্যাদি এরূপ কিছু বিভাগ রয়েছে। এখানে কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতনভাতা বাবদ সরকারের প্রচুর অর্থ ব্যয় হয়।
৪. বেসামরিক প্রশাসন পরিচালনা
যেকোনো রাষ্ট্রের প্রশাসনিক কাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পাদনের জন্য-শাসন বিভাগ, দেশের আইন-শৃঙ্খলা ও বেসামরিক প্রশাসনের জন্য সরকারকে প্রচুর অর্থ ব্যয় করতে হয়।
৫. বিচার বিভাগ
বিচার বিভাগের জন্য সরকারকে বিপুল অর্থ ব্যয় করতে হয়। দেশে চুরি, ডাকাতি, হাইজ্যাক, হত্যা, খুন ইত্যাদির মতো সমাজবিরোধী ও আইন-শৃঙ্খলা পরিপন্থী কাজে জড়িত অপরাধীদের বিচারের জন্য সরকারকে কোর্ট-কাচারি স্থাপন ও বিচারক নিয়োগের জন্য প্রচুর অর্থ ব্যয় করতে হয়।
৬. শিক্ষার সুযোগ-সুবিধা সম্প্রসারণ
শিক্ষা সরকারি ব্যয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ খাত। অনেক দেশে বেসরকারি পর্যায়ে শিক্ষার ক্ষেত্রে যে সুযোগ-সুবিধা রয়েছে তা সমগ্র জনগণের জন্য যথেষ্ট নয়। তাই বেসরকারি শিক্ষার পাশাপাশি পরিপূরক ব্যবস্থা হিসেবে সরকারি পর্যায়ে শিক্ষার সুযোগ-সুবিধা সম্প্রসারণের জন্য সরকার প্রচুর অর্থ ব্যয় করে।
৭. স্বাস্থ্য ও জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ
দেশের জনগণের স্বাস্থ্যের উন্নয়নের জন্য সরকারকে হাসপাতাল, ডাক্তার, ওষুধ ও চিকিৎসা সেবা প্রদান, কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ করতে হয়। এছাড়া জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার রোধ করার জন্য সরকার পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচি গ্রহণ করে থাকে। এসব কাজে সরকারের প্রচুর অর্থ ব্যয় হয়।
৮. কৃষিখাত
স্বল্পোন্নত দেশগুলোতে কৃষিকে কেন্দ্র করে দেশের উন্নয়ন আবর্তিত হয়। এসব দেশে সরকার দরিদ্র কৃষকদের জন্য কৃষি উপকরণ বাবদ ভর্তুকি প্রদানে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অর্থ ব্যয় করে।
৯. শিল্পখাত
জনগণের আয় ও নিয়োগ বৃদ্ধির পরিপূরক বা পরিবর্তক হিসেবে শিল্প প্রতিষ্ঠিত ও পরিচালিত হয়। বর্তমানে শিল্প প্রশাসনের জন্যও বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করতে হয়। এছাড়াও অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য ভারী ও ঝুঁকিবহুল শিল্প স্থাপনে সরকার প্রচুর অর্থ ব্যয় করে।
১০. কর্মসংস্থান বৃদ্ধি
অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশসমূহে কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে সরকার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নানারূপ কর্মসূচি বাস্তবায়নে অনেক অর্থ ব্যয় করে।
১১. সামাজিক নিরাপত্তা
আধুনিক বিশ্বের অনেক দেশেই সামাজিক নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা চালু রয়েছে। এ ব্যবস্থার মধ্যে দুর্ঘটনাজনিত ক্ষতিপূরণ, পেনশন, বয়স্কভাতা, বেকারভাতা, গ্র্যাচুইটি (পারিতোষিক), যৌথ বিমা ইত্যাদির জন্য সরকার উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অর্থ ব্যয় করে থাকে।
১২. সম্পদ আবিষ্কার ও সুষ্ঠু ব্যবহার
দেশের অনাবিষ্কৃত সম্পদ আবিষ্কার, উত্তোলন ও সুষ্ঠু ব্যবহারের জন্য দিন দিন সরকারের ব্যয় বৃদ্ধি পাচ্ছে।
১৩. পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন
উন্নত পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থা অর্থনৈতিক উন্নয়নের পূর্বশর্ত। তাই এ খাতে সরকার প্রচুর অর্থ ব্যয় করে থাকে।
১৪. নগরায়ন
শিল্প বিপ্লব বা সভ্যতার বিকাশের সাথে সাথে মানুষের চাহিদারও পরিবর্তন হচ্ছে। গ্রাম থেকে শহর অভিমুখে জনস্রোত ঠেকানোর জন্য নগরায়নের লক্ষ্যে কর্মপরিকল্পনাসহ অনেক অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে।
১৫. দুর্যোগ মোকাবিলা
বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, অগ্নিকাণ্ড, মহামারী এরূপ দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্তদের সাহায্যার্থে সরকার প্রচুর অর্থ ব্যয় করে।
১৬. আঞ্চলিক বৈষম্য হ্রাস
দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্য বিভিন্ন সামাজিক সমস্যার সৃষ্টি করে। তাই আঞ্চলিক বৈষম্য হ্রাস করার জন্য সরকারি ব্যয়ও ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। যেমন: দেশের অপেক্ষাকৃত দরিদ্র অঞ্চলে দ্রুত দারিদ্রদ্র্য বিমোচনে গবেষণা কর্মসূচি গ্রহণের মাধ্যমে বিভিন্ন মৌসুমি দ্রব্যের উৎপাদন বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য সরকার প্রচুর অর্থ ব্যয় করে।
১৭. মানব সম্পদের উন্নয়ন
যেকোনো দেশের সরকার মানব সম্পদ উন্নয়নে অধিক অর্থ ব্যয় করে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, প্রশিক্ষণ, সেনিটেশন প্রভৃতির মাধ্যমে দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলার লক্ষ্যে সরকার প্রচুর অর্থ ব্যয় করে থাকে।
১৮. বাণিজ্যচক্র রোধ
বাণিজ্যচক্রের প্রভাবে অনেক সময় অর্থনীতির মন্দাভাব দেখা দেয়। ফলে ব্যক্তিগত বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান স্তর হ্রাস পায়। এরূপ অর্থনৈতিক সংকট দূর করার জন্য সরকার বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করে।
১৯. আয়ের সুষম বণ্টন
সমাজের ধনী ও গরিব লোকদের মধ্যে আয় ব্যবধান হ্রাস করার লক্ষ্যে সরকার ধনীদের উপর হতে উচ্চ কর আরোপের মাধ্যমে সম্পদ সংগ্রহ করে গরিবদের জন্য অধিক হারে ব্যয় করে।
২০. পররাষ্ট্র বিষয়ক কার্যাবলি
কোনো রাষ্ট্রই একা তার প্রয়োজনীয় সকল পণ্য সেবা উৎপাদন বা সংগ্রহ করতে পারে না, প্রয়োজন অন্যের সহযোগিতা। ছাত্র-শিক্ষকদের মেধার বিকাশে ভবিষ্যৎ প্রযুক্তিকে করায়ত্ত করার লক্ষ্যে জ্ঞান অন্বেষণে প্রয়োজনীয় বইপত্র, বৃত্তি; দেশীয় পণ্যের বাজার সম্প্রসারণ, আমদানি-রপ্তানির লক্ষ্যে অন্যান্য দেশের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন ও উন্নয়নে মিশন পরিচালনায় কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য প্রচুর অর্থ ব্যয় করতে হয়।
২১. ঋণ ও সুদ পরিশোধ
সরকার দেশের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের জন্য মূলধন ঘাটতি পূরণের লক্ষ্যে দেশি ও বিদেশি উৎস হতে ঋণ গ্রহণ করতে হয়। এ ঋণের সুদ-আসল শোধ বাবদও প্রতি বছর সরকারকে প্রচুর অর্থ ব্যয় করতে হয়।
২২. আন্তর্জাতিক সংস্থায় চাঁদা পরিশোধ
প্রতি বছর জাতিসংঘ, বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (IMF) এ ধরনের যে সফল আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের সদস্য তার জন্য বাংলাদেশ সরকারকে চাঁদা পরিশোধ করতে হয়।
রপ্তানিমুখী শিল্প কি? রপ্তানিমুখী শিল্পের গুরুত্ব আলোচনা কর। |
২৩. চিত্তবিনোদন
আধুনিক রাষ্ট্রকে কল্যাণকর রাষ্ট্র বলা হয়। তাই সরকার জনগণের মৌলিক চাহিদা পূরণের পর চিত্তবিনোদনমূলক কর্মসূচি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে পাঠাগার, খেলার মাঠ, পার্ক, চিড়িয়াখানা, জাদুঘর প্রভৃতি খাতেও প্রচুর অর্থ ব্যয় করে।
২৪. অর্থনৈতিক উন্নয়ন
আধুনিককালে দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য সরকারকে উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে সরাসরি অংশগ্রহণ করতে হয়। দেশের উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড যত বৃদ্ধি পাচ্ছে, ততই সরকারি ব্যয়ও বাড়ছে।
উপরের আলোচনা সাপেক্ষে বলা যায়, সময়ের বিবর্তনে পুলিশি রাষ্ট্রের ধারণা বিদায় নেওয়ায় কল্যাণকর রাষ্ট্রীয় ধারণা সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বর্তমান যুগে সরকারকে অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক কার্যাবলিসহ যাবতীয় কাজ সম্পাদন করতে হয়। তাই বর্তমান শতাব্দীতে প্রত্যেক দেশের সরকারি কার্যাবলির পরিধি ব্যাপকভাবে সম্প্রসারিত হয়েছে।
আশাকরি, উপরের আলোচনা থেকে সরকারি ব্যয়ের উদ্দেশ্য কি তা স্পষ্ট হয়েছে।