নবাব স্যার সলিমুল্লাহ এর পরিচয়
নবাব স্যার সলিমুল্লাহ ১৮৭১ সালের ৭ জুন ঢাকার সম্ভ্রান্ত নবাব পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম ছিল নবাব খাজা আহসান উল্লাহ। ছোটবেলা থেকেই স্যার সলিমুল্লাহর তীক্ষ্ণ মেধাশক্তির পরিচয় পাওয়া যায়। তিনি শিক্ষা জীবন শেষ করে ব্রিটিশ সরকারের অধীনে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের চাকরি গ্রহণ করেন। কিছুদিন পর চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করেন। উল্লেখ্য যে, মুসলমানদের রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সমঅধিকার প্রতিষ্ঠা করার জন্য এ উপমহাদেশে তিনি যে রাজনৈতিক কাঠামোর মূলভিত্তি রচনা করেছিলেন তাই পরবর্তীতে তাকে গণমানুষের মনে স্থান করে দিয়েছিল। ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনকে তিনি সমর্থন করেন এবং কার্যত আধুনিক ঢাকার গোড়াপত্তন করেন। ১৯১৫ সালে তিনি পরলোকগমন করেন।
রাজনৈতিক আন্দোলনে নবাব স্যার সলিমুল্লাহ এর অবদান
নবাব স্যার সলিমুল্লাহর উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক অবদান ছিল। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি আন্দোলন হলো-
ক. বঙ্গভঙ্গ সমর্থন।
খ. মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠা।
গ. মুসলমানদের জন্য পৃথক নির্বাচনের দাবিকে প্রশস্ত করা।
ক. বঙ্গভঙ্গ সমর্থন
বঙ্গভঙ্গ প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে স্যার সলিমুল্লাহর অবদান ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন বাংলা প্রদেশে মুসলমান জনগণ সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক জীবনে তারা ছিল অবহেলিত। প্রশাসনে তাদের প্রতিনিধিত্ব ও প্রভাব ছিল না বললেই চলে। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে সৃষ্ট হিন্দু জমিদার, মহাজনদের শোষণ ও নির্যাতনের শিকারে পরিণত হয় বাংলার মুসলমানগণ। তারা ব্যবসায় বাণিজ্য, শিক্ষাদীক্ষা, চাকরি প্রভৃতি ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়ে। কলকাতাকে কেন্দ্র করে নতুন শিল্পভিত্তিক আধুনিক মধ্যবিত্ত শহরে সমাজ গড়ে ওঠে সেখানে মুসলমানদের সংখ্যা ছিল নগণ্য। পূর্ব বাংলার কৃষকদের সোনালি পাটের আয় দিয়ে সরকার কলকাতা শহরের উন্নয়ন ঘটালেও পূর্ব বাংলার মুসলমান সমাজের ভাগ্যের উন্নয়ন ঘটেনি। শিক্ষিত মধ্যবিত্ত হিন্দু শ্রেণির সাথে মুসলমানরা কোনো দিক দিয়েই প্রতিযোগিতা করতে পারছিলেন না। বাঙালি মুসলমানদের এ ঘোরতর দুর্দিনে নবাব স্যার সলিমুল্লাহ পূর্ববঙ্গ ও আসামকে নিয়ে একটি নতুন প্রদেশ গঠনে সচেষ্ট হন। ভারতের বড়লাট লর্ড কার্জন প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে বাংলাকে বিভাগ করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। স্বদেশী আন্দোলন দমন, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট তথা ব্রিটিশ শাসন দীর্ঘস্থায়ী করাই ছিল বড়লাট লর্ড কার্জনের উদ্দেশ্য। ১৯০৫ সালের ১ সেপ্টেম্বর বঙ্গভঙ্গ সম্পন্ন হয় এবং ১৫ অক্টোবর পূর্ব বাংলা ও আসাম নিয়ে নতুন প্রদেশ গঠন করা হয়। এ নতুন প্রদেশের রাজধানী হয় ঢাকা। সাত বছরকাল পূর্ববঙ্গ ও আসাম প্রদেশ বর্তমান ছিল। এর ফল হয়েছিল শুভ। চাকরি, ব্যবসায় বাণিজ্য, শিল্প ও অন্যান্য ক্ষেত্রে প্রভূত উন্নতি তথা পূর্ব বাংলার মুসলমানদের মধ্যে প্রাণচাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। কিন্তু ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদ করলে তিনি এটিকে ইংরেজ সরকারের বিশ্বাসঘাতকতা বলে বর্ণনা করেন।
বাংলায় হিন্দু-মুসলিম ঐক্য প্রচেষ্টায় দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাসের অবদান |
খ. মোহামেডান প্রভিন্সিয়াল ইউনিয়ন গঠন
নবাব স্যার সলিমুল্লাহ ছিলেন অত্যন্ত দূরদর্শী। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন যে, বঙ্গভঙ্গ হলে শিক্ষিত ও সচেতন হিন্দু জনগণ এর বিরোধিতা করবে। এজন্যই বঙ্গভঙ্গ বিরোধী তৎপরতা মোকাবিলা এবং মুসলমানদের স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য মোহামেডান প্রভিন্সিয়াল ইউনিয়ন গঠন করেন। এটা গঠনের মধ্যেই মুসলমানদের জন্য স্বতন্ত্র রাজনৈতিক সংগঠন তৈরির বীজ লুক্কায়িত ছিল।
‘গ. মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠা
মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠায় স্যার সলিমুল্লাহর অবদান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ১৮৮৫ সালে সর্বভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠিত হলেও ভারতের মুসলমানদের আকৃষ্ট করতে ব্যর্থ হয়। তাই বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন মোকাবিলা ও এটিকে স্থিতিশীল করার জন্য সর্বভারতীয় একটি মুসলিম রাজনৈতিক সংগঠনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। ১৯০৬ সালের ৩০ ডিসেম্বর ঢাকার শাহবাগে ‘নিখিল ভারত মুসলিম শিক্ষা সম্মেলনে’ মুসলমানদের জন্য পৃথক রাজনৈতিক সংগঠন সম্পর্কে আলোচনা হয়। নবাব ভিকারুল মূলকের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত উক্ত অধিবেশনে ঢাকার নবাব স্যার সলিমুল্লাহ একটি রাজনৈতিক সংগঠন তৈরির প্রস্তাব উত্থাপন করেন। হাকিম আকমল খান, নবাব মহসিন-উল-মূলক ও অন্যান্য মুসলিম নেতার সমর্থনে ঐ সম্মেলনে সর্বভারতীয় মুসলিম লীগের জন্য হয়।
ঘ. স্বতন্ত্র নির্বাচকমণ্ডলী ও নির্বাচন
সংখ্যালঘু হওয়ার কারণে মুসলমান জনগণ নির্বাচনে জয়যুক্ত হয়ে সরকার গঠন ও নিজেদের স্বার্থ সংরক্ষণ করতে সক্ষম হচ্ছিল না। এলক্ষ্যে মুসলমানদের জন্য আইনসভার আসন সংখ্যা বাড়ানোর দাবি নিয়ে মহামান্য আগাখানের নেতৃত্বে একটি মুসলিম প্রতিনিধিদল ১৯০৬ সালে ভাইসরয় লর্ড মিন্টোর সাথে সাক্ষাৎ করেন। এ প্রতিনিধি দলের প্রভাবশালী সদস্য ছিলেন নবাব স্যার সলিমুল্লাহ। লর্ড মিন্টো প্রতিনিধি দলের দাবি মেনে নেন। ১৯০৯ সালের মর্লে-মিন্টো সংস্কার আইনে মুসলমানদের জন্য ‘স্বতন্ত্র নির্বাচন’ প্রথা স্বীকৃত হয়। এ স্বতন্ত্র নির্বাচন ব্যবস্থাই পরবর্তীকালে মুসলমানদের স্বার্থ সংরক্ষণ ও রাজনৈতিক অগ্রগতি সাধনে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।