মন্ত্রি মিশন পরিকল্পনা
ব্রিটিশ শাসিত ভারতের রাজনৈতিক ও শাসনতান্ত্রিক অগ্রগতিতে ১৯৪৬ সালের মন্ত্রি মিশন পরিকল্পনা একটি উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ। ১৯৪২ সালের ক্রিপস মিশনের ব্যর্থতায় ভারতের রাজনীতি ভিন্ন খাতে প্রবাহিত হয়। অন্যদিকে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সংকটময় মুহূর্তে ভারত থেকে মিত্রবাহিনী প্রত্যাহারের জন্য মহাত্মা গান্ধী জোর দাবি জানান। এ দাবি একসময় অহিংস থেকে সহিংস আন্দোলনে রূপ নেওয়ায় গান্ধীসহ কতিপয় কংগ্রেস নেতা গ্রেফতার হন। ফলে সমগ্র ভারত জুড়ে রাজনৈতিক অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়। এরূপ অচলাবস্থা নিরসনের জন্য যে সিমলা বৈঠক আহ্বান হয় তাও ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। এদিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অবসান ঘটে এবং ব্রিটেনের নির্বাচনে শ্রমিক দল ক্ষমতাসীন হয়ে ভারতের রাজনৈতিক ও শাসনতান্ত্রিক সমস্যার সমাধানকল্পে নতুন নীতি গ্রহণ করে। অতঃপর ১৯৪৬ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি ব্রিটিশ পার্লামেন্টের উভয় কক্ষের সরকারি ঘোষণানুযায়ী ব্রিটিশ মন্ত্রিসভার তিন সদস্য যেমন- তৎকালীন ভারত সচিব পেথিক লরেন্স, বাণিজ্য বোর্ডের সভাপতি স্যার স্টাফোর্ড ক্রীপস এবং নৌবিভাগের প্রথম লর্ড এ. ভি. আলেকজান্ডারকে ভারতে প্রেরণ করা হয়। এ মিশন ভাইসরয়ের সহায়তায় শাসনতান্ত্রিক নীতি ও কার্যাবলি সম্পর্কে ভারতীয় না নেতৃবৃন্দের সাথে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে নিজস্ব পরিকল্পনা ঘোষণা করেন যা ‘মন্ত্রি মিশন পরিকল্পনা’ নামে খ্যাত।
প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন এর কার্যকারিতা আলোচনা কর |
মন্ত্রি মিশন পরিকল্পনা বৈশিষ্ট্য সমূহ
১৯৪৬ সালের মন্ত্রি মিশন পরিকল্পনা কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্যে সমৃদ্ধ। মন্ত্রি মিশন পরিকল্পনার প্রস্তাবগুলো দু ভাগে বিভক্ত। যথা-
(i) দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা (Long term scheme) এবং
(ii) স্বল্পমেয়াদি পরিকল্পনা (Short term scheme).
দীর্ঘমেয়াদি প্রস্তাব
মন্ত্রি মিশন পরিকল্পনায় যেসব দীর্ঘমেয়াদি প্রস্তাব করা হয় তা নিম্নরূপ-
১. ভারতীয় ইউনিয়ন গঠন: মন্ত্রি মিশন পরিকল্পনায় উল্লেখ করা হয় যে ব্রিটিশ ভারত ও দেশীয় রাজ্যগুলোর সমন্বয়ে ‘ভারতীয় ইউনিয়ন’ গঠিত হবে।
২. ভারতীয় ইউনিয়নের ক্ষমতা: ভারতীয় ইউনিয়ন সরকারের হাতে তিনটি ক্ষমতা থাকবে। যথা- দেশরক্ষা, পররাষ্ট্র সংক্রান্ত ও যোগাযোগ। এ বিষয়গুলো পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ সংগ্রহের অধিকার ইউনিয়ন সরকারের থাকবে।
৩. প্রদেশ ও দেশীয় রাজ্যের ক্ষমতা: জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ পূর্বোক্ত তিনটি বিষয়ের ক্ষমতা ব্যতীত অন্যান্য বিষয়ের ক্ষমতা যেমন- আইনশৃঙ্খলা, জেল, কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ইত্যাদি প্রদেশ ও দেশীয় রাজ্যগুলোর এখতিয়ারে ছেড়ে দেওয়া হয়।
৪. আইন ও শাসন বিভাগ গঠন: ব্রিটিশ ভারত ও দেশীয় রাজ্যগুলোর সমন্বয়ে ভারতীয় ইউনিয়নের আইন ও শাসন বিভাগ গঠিত হবে। কোনো সাম্প্রদায়িক স্বার্থ সংক্রান্ত বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য উপস্থিত উভয় সম্প্রদায়ের অধিকাংশ সদস্যের ভোট প্রয়োজন হবে।
৫. প্রাদেশিক গ্রুপ গঠন: এ পরিকল্পনা অনুযায়ী সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে প্রদেশগুলোকে তিনটি গ্রুপে বিভক্ত করা হয়। যথা-
A গ্রুপ: হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ বোম্বাই, মাদ্রাজ, মধ্যপ্রদেশ, যুক্তপ্রদেশ, উড়িষ্যা ও বিহার এ ৬টি প্রদেশকে ক গ্রুপের অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
B গ্রুপ: মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ পাঞ্জাব, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ এবং সিন্ধু প্রদেশকে খ গ্রুপের অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
C গ্রুপ: বাংলা ও আসাম নিয়ে গ গ্রুপ গঠিত হয়।
মর্লে মিন্টো সংস্কার আইন ১৯০৯ ব্যাখ্যা কর |
৬. গ্রুপগুলোর আইন ও শাসন বিভাগ: পরিকল্পনায় উল্লেখ করা হয় যে প্রত্যেক গ্রুপের একটি করে আইন ও শাসন বিভাগ থাকবে। তারা স্ব-স্ব বিষয় নির্ধারণ করবে।
৭. সর্বভারতীয় গণপরিষদ: তিনটি গ্রুপের গণপরিষদের সদস্যদের নিয়ে একটি সর্বভারতীয় গণপরিষদ গঠনের প্রস্তাব করা হয়। যার কাজ হবে গ্রুপগুলোর সমন্বয়ে গঠিত ভারতীয় ইউনিয়নের জন্য একটি সংবিধান প্রণয়ন করা। সংবিধান প্রণীত হওয়ার পর প্রদেশগুলো গ্রুপ ত্যাগ করতে পারবে।পরিকল্পনায় সংবিধান সংশোধনের বিধানও রাখা হয়।
তাছাড়া প্রস্তাবিত যুক্তরাষ্ট্র গঠনের পর দেশীয় রাজ্যগুলোর ওপর থেকে ব্রিটিশ সার্বভৌম ক্ষমতার অবসান হবে এবং দেশীয় রাজ্যগুলো তাদের ভবিষ্যৎ সম্পর্ক নির্ধারণের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে আলাপ-আলোচনা করবে।
স্বল্পমেয়াদি প্রস্তাব
মন্ত্রি মিশন পরিকল্পনায় একটি স্বল্পমেয়াদি প্রস্তাব করা হয়। আর তা হলো-
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন: গভর্নর জেনারেল ভারতের প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে অন্তর্বর্তীকালের জন্য একটি কেন্দ্রীয় সরকার গঠন করেন। সংবিধান প্রণীত না হওয়া পর্যন্ত এ সরকার শাসনকার্য পরিচালনা করবে।