শাসন বিভাগের ক্ষমতা বৃদ্ধির কারণ
আধুনিক গণতান্ত্রিক সরকারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ হলো শাসন বিভাগ। আধুনিককালে পৃথিবীর প্রত্যেকটি রাষ্ট্রের শাসন বিভাগের ক্ষমতা অপ্রতিহতভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। সব ধরনের সরকারের ক্ষেত্রেই শাসন বিভাগের ক্ষমতা বৃদ্ধির প্রবণতা দেখা যায়। এ সম্পর্কে অধ্যাপক বার্কার বলেন, ‘ঊনবিংশ শতকে যেভাবে আইন পরিষদের ক্ষমতা বৃদ্ধি ঘটেছিল বিংশ শতকে শাসন বিভাগের ক্ষমতা সেই গতিতেই সম্পন্ন হয়েছে।’ (If the function of the Legislature due to the growth of the cabinet system is the criterion of the nineteenth century, the growth of the power of the executive is the criterion of the twentienth century.) নিচে শাসন বিভাগের ক্ষমতা বৃদ্ধির কারণ সমূহ আলোচনা করা হলো:
১. সদস্যদের অদক্ষতা
গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সাধারণ নির্বাচনে জ্ঞানী-গুণী ও দক্ষ ব্যক্তিত্ব যথেষ্ট সংখ্যায় নির্বাচিত হন না। ফলে আইনসভায় অদক্ষ ও অযোগ্য সদস্যের আগমন ঘটে। আইন প্রণয়নের জন্য যে বিশেষ জ্ঞানের প্রয়োজন তা না থাকায় আইন প্রণয়নের মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজের মূল দায়িত্ব শাসন বিভাগের ওপর অর্পিত হয়। আইনের জটিলতা ও টেকনিক্যাল জ্ঞানের অভাবেই আইনসভা এরূপ ক্ষমতা হস্তান্তর করেছে। এতে শাসন বিভাগের ক্ষমতা ও মর্যাদা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
আইনসভার ক্ষমতা হ্রাসের কারণ | আইন বিভাগের ক্ষমতা হ্রাসের কারণ |
২. সরকারি কার্যাবলির প্রসারতা
বর্তমানে প্রায় সব রাষ্ট্রই জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্র। জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রের কাজের ব্যাপকতার ফলে আর্থিক দৈন্য, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির চাপ ইত্যাদি কারণে প্রতিটি রাষ্ট্রেই নতুন নতুন সমস্যার জন্ম হচ্ছে। এ সমস্যাগুলোর সমাধান আইনসভার পক্ষে দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। এক্ষেত্রে শাসন বিভাগকে বহুমুখী কর্মসূচি গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করতে হয়। সরকারি কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে সম্পাদনের নেতৃত্ব শাসন বিভাগকেই দিতে হয়।
৩. আইনসভার সাংগঠনিক দুর্বলতা
আইনসভার সাংগঠনিক দুর্বলতার কারণে জনগণ এর প্রতি আস্থা হারাচ্ছে। এ প্রেক্ষাপটে শক্তিশালী শাসন বিভাগের উত্থান হচ্ছে এবং শাসন বিভাগের ওপর বর্তমানে বেশ কিছু আইন প্রণয়নের দায়িত্ব অর্পিত হওয়াতে শাসন বিভাগের ক্ষমতা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
৪. শাসনকার্যে জটিলতা
আধুনিককালে শাসনকার্য পরিচালনা ক্রমশ জটিল হয়ে পড়েছে। এজন্য প্রতিবছর অনেক বিশেষজ্ঞ নিয়োগ করা হচ্ছে। এসব শাসন বিভাগীয় বিশেষজ্ঞদের হাতে যথেষ্ট ক্ষমতা অর্পণ করা হয়। এটি শাসন বিভাগের ক্ষমতাকে বৃদ্ধি করে।
৫. দলীয় ব্যবস্থার কঠোরতা
বর্তমান সংসদীয় শাসনব্যবস্থায় আইনসভা মূলত সরকারের ভূত্যের ভূমিকা পালন করছে। সুসংগঠিত দলীয় ব্যবস্থা, কঠোর দলীয় নিয়মানুবর্তিতা প্রভৃতির কারণে মন্ত্রিসভা আইনসভার সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের ওপর সম্পূর্ণ নির্ভর করতে পারছে না। তাই সঙ্গত কারণে সাম্প্রতিক কালে আইনসভার ক্ষমতা দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে এবং শাসন বিভাগের ক্ষমতা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে।
৬. অর্পিত ক্ষমতাপ্রসূত আইন
বর্তমানে আইনসভা বছরে মাত্র কয়েকবার এবং সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য বসে। ফলে আইন প্রণয়নে আইনের খুঁটিনাটি সব দিক দেখার মতো প্রয়োজনীয় সময় আইনসভার হাতে থাকে না। তাই আইনসভা যেকোনো আইনের মূল কাঠামো প্রস্তুত করে তা পরিপূর্ণতা দানের বিষয়টি শাসন বিভাগের ওপর অর্পণ করে। এগুলোকে ক্ষমতা প্রসূত আইন বা ‘Deligated Legislation’ বলে। যা শাসন বিভাগের ক্ষমতাকে ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি করেছে।
৭. স্বার্থগোষ্ঠীদের প্রাধান্য
রাজনৈতিক দলের পাশাপাশি অনেক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর উপস্থিতি লক্ষ করা যায়। তাদের কাজ হলো সরকারি নীতিকে প্রভাবিত করে নিজের স্বার্থের অনুকূলে জনমত গঠনপূর্বক জনগণের সমস্যা ও দাবি সরকারের সম্মুখে তুলে ধরে সরকার ও জনগণের মধ্যে সংযোগ সাধন করা। যদিও তত্ত্বগতভাবে আইনসভাই সরকার ও জনগণের মধ্যে সংযোগ সেতু হিসেবে কাজ করে। তবে বর্তমানে চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠী সরাসরি সরকারের সাথে সংযোগ রক্ষা করছে। এক্ষেত্রে আইনসভার গুরুত্ব হ্রাস পাচ্ছে।
৮. জরুরি অবস্থা ও আন্তর্জাতিক সংকট
আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সমস্যার সমাধান, বিভিন্ন অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক চুক্তি সম্পাদন শাসন বিভাগের ওপর ন্যস্ত। এছাড়া বন্যা, মহামারি, ঝড়, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা প্রভৃতি জাতীয় সংকট ও জরুরি পরিস্থিতিতে আইনসভা যথাসময়ে দ্রুত ও দৃঢ় সিদ্ধান্ত নিতে পারে না বিধায় এসব দায়িত্ব শাসন বিভাগকে পালন করতে হচ্ছে। ফলে শাসন বিভাগের ক্ষমতা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে।
৯. রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপ
সাম্প্রতিককালে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোতে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার অজুহাতে সামরিক বাহিনী রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল করছে গণতন্ত্রের কবর রচনার মাধ্যমে। সামরিক সরকার ক্ষমতার মসনদে বসে তথাকথিত নির্বাচনের মাধ্যমে সামরিক শাসনের বৈধতা আনয়নের উদ্যোগ গ্রহণ করে। এক্ষেত্রে আইনসভার মর্যাদা সর্বোতভাবে ভলুণ্ঠিত হয়।
১০. শাসন বিভাগের ওপর জনগণের আস্থা
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উৎকর্ষের ফলে জনগণ এখন আইন বিভাগ ও শাসন বিভাগের কাজের মধ্যে তুলনামূলক বিচার করতে সক্ষম হচ্ছে। শাসন বিভাগ প্রশাসনে জনগণের কল্যাণে কার্যকর ভূমিকা পালন করায় জনগণের সাথে সরাসরি যোগাযোগ প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে এবং জনগণ শাসন বিভাগের প্রতি নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে।
উপরিউক্ত আলোচনার প্রেক্ষাপটে বলা যায়, গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় শাসন বিভাগ ও আইনসভা দুটোর গুরুত্বই অপরিসীম। এক্ষেত্রে উভয় বিভাগের দক্ষতা বৃদ্ধি পেলে তাদের মধ্যে ব্যবধান হ্রাস পাবে এবং উভয়ের মর্যাদা অক্ষুণ্ণ থাকবে। সেজন্য প্রয়োজন আইনসভার যোগ্য সদস্য এবং শাসন বিভাগে আরও অধিক দক্ষতা সম্পন্ন প্রশাসক।