সরকারের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ আইনসভা। আইন প্রণয়ন, সংশোধন ও পরিবর্তনে আইনসভা সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী। ঊনবিংশ শতকে আইনসভার সার্বভৌমিকতা এবং শ্রেষ্ঠত্ব রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের অন্যতম প্রধান আলোচ্য বিষয় ছিল। তবে আধুনিককালে কঠোর দলীয় ব্যবস্থা, বিচার বিভাগের প্রাধান্য, আইন প্রণেতাদের অদক্ষতা ইত্যাদি কারণে আইনসভার ক্ষমতা হ্রাস পাচ্ছে। অন্যদিকে বৃদ্ধি পাচ্ছে শাসন বিভাগের ক্ষমতা।
প্রখ্যাত রাষ্ট্রবিজ্ঞানী লর্ড ব্রাইস (Lord Bryce) বিভিন্ন দেশের সংসদীয় কার্যক্রম পর্যালোচনা করে আইনসভার ক্ষমতা হ্রাসের কারণ সম্পর্কে আলোকপাত করেছেন। তিনি ‘Modern Democracies’ গ্রন্থে আইনসভার ক্ষমতা ও প্রভাব- প্রতিপত্তি হ্রাসের কয়েকটি কারণ উল্লেখ করেছেন। নিচে তা তুলে ধরা হলো:
১. আইনসভার সদস্যদের বিশেষ জ্ঞানের অভাব
আধুনিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় আইনসভার সদস্যপদ লাভের জন্য বিশেষ কোনো শিক্ষাগত যোগ্যতার শর্ত নেই। ফলে কার্যত যেকোনো ব্যক্তি আইনসভার সদস্য হওয়ার জন্য নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারেন। এক্ষেত্রে বাস্তবতা হলো, আইনসভার সদস্যদের অনেকে অল্পশিক্ষিত হতে পারেন। তাছাড়া সাধারণ বা উচ্চশিক্ষিত সদস্যদেরও আইন প্রণয়নের কলাকৌশল সম্পর্কে সাধারণত জ্ঞান থাকে না। এ কারণে আইন প্রণয়নের ব্যাপারে তারা মূলত আমলা তথা শাসন বিভাগের ওপর নির্ভরশীল হন। সদস্যদের এরূপ নির্ভরশীলতার কারণে আইনসভার ক্ষমতা হ্রাস পাচ্ছে।
২ . জনকল্যাণমূলক কাজের সম্প্রসারণ
সাম্প্রতিককালে উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় জনকল্যাণমূলক কাজের ক্রমবর্ধমান সম্প্রসারণের ফলে শাসন বিভাগের দায়িত্ব অনেকাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে। কারণ আইনসভা নিয়মিত কাজের পাশাপাশি এ বিপুল সেবামূলক কর্মকান্ডের দায়িত্ব প্রত্যক্ষভাবে পালন করতে পারে না। এজন্য শাসন বিভাগকেই এসব বিষয়ে নেতৃত্ব দিতে হয়। এর ফলে শাসন বিভাগের সাথে জনসাধারণের সংযোগ গভীরতর হয়। এ সুবাদেই শাসন বিভাগ অধিক ক্ষমতা চর্চার সুযোগ লাভ করে।
৩. আইন প্রণয়নে দীর্ঘসূত্রতা
আইনসভার মতো একটি বৃহদায়তন ও নিয়মতান্ত্রিক সংগঠনের পক্ষে প্রয়োজন হলেও যখন তখন অধিবেশন আহ্বান করে দ্রুতগতিতে আইন প্রণয়ন ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা অসম্ভব। সমাজ ও মানুষের জীবনযাত্রায় প্রতিনিয়ত পরিবর্তনের ফলে নিত্যনতুন আইন প্রণয়নের প্রয়োজন হয়। রাষ্ট্রের কাজে এই যে বিপুলসংখ্যক নতুন আইন প্রণয়ন বা সংশোধনের প্রয়োজন হয়, বরাদ্দকৃত স্বল্প সময়ে আইনসভার পক্ষে তা করা সম্ভব হয় না। আইন প্রণয়নে অনেক অনুসন্ধান, তথ্যউপাত্ত যাচাই, গবেষণা এবং আর্থসামাজিক, সাংবিধানিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতা বিবেচনায় নিতে হয় বলে এটি একটি সময়সাপেক্ষ ও জটিল কাজ। এ কারণে এতে দীর্ঘ সময় লাগে। এটি শাসনবিভাগের ক্ষমতা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাওয়া এবং বিপরীতক্রমে আইনসভার ক্ষমতা হ্রাস পাওয়ার অন্যতম কারণ।
মন্ত্রিপরিষদ শাসিত সরকার ও রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারের পার্থক্য |
৪. অর্পিত ক্ষমতাপ্রসূত আইন
আইনের জটিলতা, সদস্যদের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার অভাব এবং বিশেষ করে সময়ের অভাবের জন্য আইনসভা নিজেই শাসন বিভাগকে আইন প্রণয়নের কিছু কিছু ক্ষমতা অর্পণ করে। এ কারণেও শাসন বিভাগকে কিছু আইন প্রণয়ন করতে হয়। একে অর্পিত ক্ষমতাপ্রসূত আইন (Delegated Legislation) বলে। এই অধিকারের ভিত্তিতে শাসন বিভাগ আইন বিভাগের এখতিয়ারে হস্তক্ষেপ করে নিজের কর্তৃত্বের সীমানা বৃদ্ধি করে। এরূপ অর্পিত ক্ষমতাপ্রসূত আইন বা অধঃস্তন আইনের পরিধি যত বাড়বে, শাসনবিভাগের কর্তৃত্বও তত বেড়ে যাবে।
৫. দলীয় ব্যবস্থার কঠোরতা
সংসদীয় গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় আইনসভা মূলত সরকারের আজ্ঞাবহ সংস্থায় পরিণত হয়েছে। এজন্য অনেকে সংসদকে ‘রাবার স্ট্যাম্প’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। সংগঠিত দলীয় ব্যবস্থা, কঠোর দলীয় শৃঙ্খলা ইত্যাদির কারণে মন্ত্রিসভা আইনসভার সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের সমর্থনের ব্যাপারে নিশ্চিত থাকে। প্রায় সব ক্ষেত্রে দলীয় সদস্যরা দলীয় নেতাদের মতামতকে সমর্থন করে থাকেন। তারা সাধারণত নিজ দলের চাওয়ার বিরুদ্ধে গিয়ে স্বাধীনভাবে মত প্রকাশ করতে পারেন না। এ কারণে আইনসভার সদস্যদের ক্ষমতা, মর্যাদা ও মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা সংকুচিত হয়। ফলে স্বাভাবিকভাবেই শাসন বিভাগের ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। বিশেষ করে সংসদীয় ব্যবস্থায় এ অবস্থা প্রকট আকার ধারণ করেছে।
৬. জরুরি অবস্থায় সীমাবদ্ধতা
আধুনিক রাষ্ট্রগুলোর সমস্যা অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। শাসন বিভাগকে এখন নিত্যনতুন জাতীয় সংকট, আন্তর্জাতিক স্নায়ু যুদ্ধ, অর্থনৈতিক, কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক সমস্যা ইত্যাদি মোকাবিলার দায়িত্ব গ্রহণ করতে হয়। আইনসভায় বিভিন্ন আদর্শ ও স্বার্থের প্রতিনিধিত্ব থাকায় সেখানে এসব বিষয়ে খোলামেলা আলোচনার মাধ্যমে দ্রুত কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা যায় না।
৭. চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর প্রাধান্য
অনেকের মতে, আইনসভার ক্ষমতা হ্রাসের আর একটি প্রধান কারণ চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর (Pressure Group) ভূমিকা। বর্তমানে বিভিন্ন চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠী ও সংগঠন জনগণের স্বার্থ ও সমস্যা সম্পর্কে সরকারের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করে। এসব সংগঠন বা গোষ্ঠী যথেষ্ট শক্তিশালী ও যোগ্যতাসম্পন্ন হওয়ায় অনেক ক্ষেত্রেই তারা আইনসভার মাধ্যমে দাবি বা অভিযোগ উত্থাপনের প্রয়োজন বোধ করে না। এমনও হয়ে থাকে যে, অনেক সময় সরকার ও সংশ্লিষ্ট সংগঠনের মধ্যে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে বোঝাপড়া হয়ে যাওয়ার পর সেগুলো আইনসভার কাছে নিছক আনুষ্ঠানিক অনুমোদনের জন্য উপস্থাপন করা হয়। এসব প্রভাবশালী চাপসৃষ্টিকারী সংস্থা অনেক সময় প্রত্যক্ষভাবে শাসন বিভাগের সাথে যোগাযোগ করে মন্ত্রী ও আমলাদের প্রভাবিত করে নিজেদের স্বার্থ হাসিল করে নেয়। এক্ষেত্রে আইনসভার আলোচনাকে তেমন গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করা হয় না। এ কারণেও আইনসভার ক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে।
৮. জনমত গঠনে ব্যর্থতা
জনসাধারণের মধ্যে রাজনৈতিক শিক্ষার বিস্তার এবং জনমত গঠনের ক্ষেত্রে আইনসভার ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু বর্তমানে আইনসভা এক্ষেত্রে ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে। অন্যদিকে প্রচার মাধ্যম যেমন বেতার, টেলিভিশন, সংবাদপত্র এবং অনলাইন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম তথা ইন্টারনেট জনমত গঠন ও প্রকাশের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। এ কারণে এক্ষেত্রে আইনসভার গুরুত্ব কমেছে।
৯. বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনা
আইনসভায় যেসব আইন গৃহীত হয় সেগুলোর সাংবিধানিক বৈধতা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখার অধিকার দেশের সর্বোচ্চ আদালতের রয়েছে। সুপ্রিম কোর্ট আইনসভা প্রণীত যেকোনো আইন সংবিধান বহির্ভূত হলে তা বাতিল ঘোষণা করতে পারে। এসব ক্ষেত্রে আইনসভার মর্যাদা কিছুটা হলেও ক্ষুণ্ণ হয়।
১০. সামরিক বাহিনীর হস্তক্ষেপ
তৃতীয় বিশ্বের অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোতে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার সুবাদে সামরিক বাহিনী কখনো কখনো রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় হস্তক্ষেপ করে। এর ফলে নির্বাচিত আইনসভার ভূমিকা গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে। কারণ সামরিক সরকার ইচ্ছামতো দেশ পরিচালনা করে। সেখানে নির্বাচিত আইনসভার কোনো ভূমিকা থাকে না।
পরিশেষে বলা যায়, সাম্প্রতিককালে বিভিন্ন বাস্তব কারণে আইনসভার ক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে এবং কার্যত শাসন বিভাগের পূর্ণ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তবে এখনো সংসদীয় সরকারব্যবস্থায় আইনসভার আস্থা হারালে শাসন বিভাগ তথা মন্ত্রিসভাকে পদত্যাগ করতে হয়। আইনসভার পক্ষে সংখ্যাগরিষ্ঠ নির্বাচকমণ্ডলীর সমর্থন থাকলে সরকার বা শাসন বিভাগ আইনসভাকে উপেক্ষা করতে পারে না। প্রকৃতপক্ষে, বিশ্বের সব দেশের আইনসভার ক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে একথা বলা যায় না। তবে আধুনিক রাষ্ট্রের আইনসভাগুলো তাদের পূর্বের গৌরব ও প্রতিপত্তি বহুলাংশে হারিয়েছে।
অতএব, উপরোক্ত লেখা থেকে আপনারা আইনসভার ক্ষমতা হ্রাসের কারণ বা আইন বিভাগের ক্ষমতা হ্রাসের কারণ সম্পর্কে জানতে পারলেন।