Home » গণতন্ত্রের সফলতার শর্তাবলী আলোচনা কর
গণতন্ত্রের সফলতার শর্তাবলী আলোচনা কর

গণতন্ত্রের সফলতার শর্তাবলী আলোচনা কর

by TRI

সূচনালগ্ন থেকেই গণতন্ত্র মতবাদটি নিয়ে বিতর্ক চলে আসছে। তবে গণতন্ত্রের বিপক্ষে যুক্তির কমতি না থাকলেও এটিই এখনও বিদ্যমান শাসনব্যবস্থাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় ও উত্তম। গণতন্ত্রের শ্রেষ্ঠত্ব বা প্রয়োজনীয়তাকে অস্বীকার করার অবকাশ নেই। তবে গণতন্ত্রকে সফল করে তোলা কঠিন কাজ। স্যার হেনরি মেইন বলেছেন, ‘সরকারের অন্যান্য শ্রেণিবিভাগের তুলনায় গণতন্ত্র সফল করা সবচেয়ে কঠিন।’ গণতন্ত্র কিছু দেশে সফল হলেও অনেক রাষ্ট্রেই এটি সাফল্যজনকভাবে বাস্তবায়নের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। বিভিন্ন রাষ্ট্রে গণতন্ত্রের সাফল্য ও ব্যর্থতার কারণ হিসেবে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা নানা ধরনের বিষয়ের কথা উল্লেখ করেছেন। তার আলোকে নিচে গণতন্ত্রের সফলতার জন্য কতিপয় শর্ত তুলে ধরা হলো-

১. গণতান্ত্রিক চেতনা

গণতন্ত্রের সাফল্যের জন্য দরকার গণতান্ত্রিক চেতনাসম্পন্ন জনগণ। অর্থাৎ গণতন্ত্রকে চাপিয়ে দিলেই হবে না, জনগণের মধ্যে গণতন্ত্রকে যথাযথভাবে অনুধাবন করার বোধশক্তি ও চর্চা করার মানসিকতা থাকতে হবে। অন্যথায় গণতন্ত্র কখনও সাফল্য লাভ করবে না। গণতন্ত্রকে কার্যকর করার জন্য নাগরিককে কর্তব্য পালনে প্রস্তুত থাকতে হবে। ব্যক্তিস্বাধীনতা ও অধিকার সঠিকভাবে ব্যবহৃত না হলে গণতন্ত্র বিপর্যস্ত হবে। জনগণ স্বার্থপর ও দুর্নীতিপরায়ণ হলে গণতান্ত্রিক তথা সামগ্রিক মূল্যবোধ বিনষ্ট হয়ে যাবে। তাই গণতন্ত্রের সাফল্যের জন্য প্রয়োজন জনগণের সুবিবেচনা, সদিচ্ছা এবং উপযুক্ত শিক্ষা। রাজনৈতিক বিবেচনা, দূরদৃষ্টি ও সংগ্রামী মনোভাব- এসব মানসিক গুণকে সুশিক্ষার সাহায্যে পরিপুষ্ট করে মানুষকে গণতন্ত্র চর্চার উপযোগী করে তুলতে হবে।

গণতন্ত্র কি? গণতন্ত্র কত প্রকার ও কি কি? গণতন্ত্রের বৈশিষ্ট্য গুলো আলোচনা কর

২. গণতান্ত্রিক ঐতিহ্য

অপরের মত ও আদর্শের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন, অপরকে মতামত ও বিশ্বাস প্রকাশের সুযোগ প্রদান, সময়মত নির্বাচন অনুষ্ঠান, জনগণের সম্মতি বা ম্যান্ডেট না পেলে ক্ষমতা ছেড়ে দেওয়া, আইনসভায় বা আলোচনার টেবিলে বসে সমস্যার সমাধান খোঁজা- এগুলো হচ্ছে গণতান্ত্রিক ঐতিহ্যের কয়েকটি বৈশিষ্ট্য। কোনো সমাজে গণতন্ত্রের ঐতিহ্য না থাকলে সেখানে গণতান্ত্রিক শাসন সফল হয় না। স্বাভাবিকভাবেই গণতান্ত্রিক ঐতিহ্য একদিনে গড়ে ওঠে না, এটি দীর্ঘ দিনের চর্চার ফসল।

৩. ব্যাপক শিক্ষা

গণতন্ত্রকে সফল করতে হলে চাই ব্যাপক শিক্ষার প্রসার। জন স্টুয়ার্ট মিল এজন্যই বলেছেন, ৩ ‘সর্বজনীন ভোটাধিকারের আগে সর্বজনীন শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে।’ (Universal education must precede universal suffrage.) শিক্ষা মানুষকে আত্মসচেতন, আত্মমর্যাদাবান, কর্তব্যনিষ্ঠ ও অধিকার সচেতন করে তোলে। এর ফলে গণতন্ত্র সর্বশ্রেষ্ঠ সরকারে পরিণত হয়।

৪. অর্থনৈতিক সাম্য

সমাজে আর্থিক সমতা বিধান করতে না পারলে গণতন্ত্র সফল হতে পারে না। অধ্যাপক লাস্কির ৪ মতে, ‘অর্থনৈতিক সাম্য ব্যতীত গণতন্ত্র সফল হতে পারে না।’ রবসন-এর মতে, ‘গণতন্ত্র বলতে ন্যূনতম মৌলিক আর্থিক কল্যাণকে বোঝায়, কারণ অভুক্ত, গৃহহীন, রোগাক্রান্ত ও বস্ত্রহীনদের কাছে রাজনৈতিক অধিকার অর্থহীন।’ অভাবগ্রস্ত মানুষকে অনেক সময় ভ্রান্তপথে পরিচালনা করা যায়। এজন্য অর্থনৈতিক সাম্য গণতন্ত্রের সফলতার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শর্ত বলে বিবেচিত হয়।

৫. দক্ষ ও সৎ নেতৃত্ব

যোগ্য নেতৃত্ব গণতন্ত্রের সফলতার অন্যতম প্রধান শর্ত। প্রখ্যাত লেখক যোসেফ সুমপিটার বলেছেন, নেতৃবর্গকে সৎ, যুক্তিবাদী ও বিবেকসম্পন্ন হতে হবে। এ রকম গুণসম্পন্ন ব্যক্তির অভাব থাকলে রাজনৈতিক নেতৃত্ব অগণতান্ত্রিক ও স্বার্থান্বেষী ব্যক্তিদের হাতে চলে যাবে। অযোগ্য ও দুর্নীতিপরায়ণ নেতৃত্ব জনগণের মধ্যে গণতন্ত্র সম্পর্কে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে এবং অনেক সময় তারা এ ব্যবস্থার ওপর থেকে আস্থা হারিয়ে ফেলে।

৬. সুষ্ঠু জনমত

গণতান্ত্রিক শাসন জনমতের ওপর নির্ভরশীল। নির্বাচনে ক্ষমতা হারানোর ভয়ে ক্ষমতাসীন সরকার সাধারণত জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকে। আর জনমতের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন গণতন্ত্রকে সফল করায় অবদান রাখে। এজন্য গণতন্ত্রকে কার্যকর করতে হলে প্রচারমাধ্যমসহ জনমত গঠনের মাধ্যমগুলোকে মুক্ত ও স্বাধীন রাখতে হবে।

৭. সুসংগঠিত রাজনৈতিক দল

আধুনিক প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্রে সুসংগঠিত রাজনৈতিক দলের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। গণতন্ত্রে সুসংগঠিত ও শক্তিশালী রাজনৈতিক দলই জনমত গঠন করে ক্ষমতাসীন হতে পারে। আবার ক্ষমতাসীন দল যাতে করে রাষ্ট্র ও জনস্বার্থবিরোধী কার্যক্রমে লিপ্ত হতে না পারে তা নিশ্চিত করতে বিরোধী রাজনৈতিক দলকেও সংগঠিত ও শক্তিশালী হতে হয়।

৮. মুক্ত ও স্বাধীন প্রচার মাধ্যম

গণতন্ত্রের সফলতার অন্যতম পূর্বশর্ত হলো মুক্ত ও স্বাধীন প্রচার মাধ্যম। সংবাদপত্র, রেডিও, টেলিভিশনে সব দল ও শ্রেণির মত প্রকাশের স্বাধীনতা থাকতে হবে। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রচার মাধ্যমও বিরোধীদলের মতামত প্রকাশের জন্য উন্মুক্ত রাখতে হবে। গুরুত্বের জন্য সংবাদমাধ্যমকে রাষ্ট্রের ‘চতুর্থ এস্টেট’ বলে অভিহিত করা হয়েছে।

গণতন্ত্রে রাজনৈতিক দলের ভূমিকা ও গুরুত্ব

৯. ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ

গণতন্ত্রের সাফল্যের জন্য ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ নীতিকে অন্যতম পূর্বশর্ত হিসেবে গণ্য করা হয়ে থাকে। কেননা, ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে ক্ষমতা তৃণমূল পর্যায়ে পৌছে দেওয়া সম্ভব।বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে স্থানীয় শাসনকে শক্তিশালী করা যায়। আর স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করে।

১০. লিখিত সংবিধান

গণতন্ত্রের সফলতার জন্য লিখিত সংবিধান বড় ভূমিকা রাখে। সংবিধান লিখিত হলে জনগণ নিজেদের অধিকার ও কর্তব্য এবং সরকারি ক্ষমতার সীমা প্রভৃতি সম্পর্কে সম্যকভাবে অবহিত থাকে। ফলে সরকার সহজে অগণতান্ত্রিক আচরণ করতে পারে না।

১১. আইনের অনুশাসন

গণতন্ত্রের সফলতার আরেকটি পূর্বশর্ত হলো রাষ্ট্রে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা। অর্থাৎ, ‘আইনের দৃষ্টিতে সবাই সমান’ এ নীতির বাস্তবায়ন প্রয়োজন। ধনী, দরিদ্র, দুর্বল, ক্ষমতাবান নির্বিশেষে সবার ব্যাপারে আইন সমানভাবে প্রযোজ্য না হলে গণতন্ত্র সফল হবে না।

১২. বিচার বিভাগের স্বাধীনতা

আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগ ও ব্যাখ্যার জন্য বিচার বিভাগকে পূর্ণ স্বাধীনতা প্রদান করতে হবে। বিচারকরা যেন ভয়-ভীতির ঊর্ধ্বে থেকে নিজ নিজ দায়িত্ব নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠুভাবে পালন করতে পারেন তার নিশ্চয়তা বিধান করতে হবে। এজন্য শাসন ও আইন বিভাগের নিয়ন্ত্রণমুক্ত স্বাধীন ও নিরপেক্ষ বিচার বিভাগ গড়ে তুলতে হবে।

১৩. দক্ষ প্রশাসন

গণতান্ত্রিক শাসনপদ্ধতির সফলতার জন্য দরকার একটি সৎ, দক্ষ ও উদ্যমী প্রশাসন যন্ত্র। সরকারি কর্মচারীরা দক্ষ ও উদ্যমী না হলে সরকার সুষ্ঠুভাবে প্রশাসন চালাতে পারবে না। অদক্ষতার পরিণতিতে সরকার ক্রমশ জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে। ক্ষমতায় থাকা রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বরা সাধারণত রাষ্ট্রীয় প্রশাসন সম্পর্কে অনভিজ্ঞ ও অদক্ষ থাকেন। তাদের নির্দেশনা কার্যকর করেন প্রশাসনের দক্ষ কর্মকর্তারা। সুতরাং কর্মকর্তারা যদি দক্ষ হন তবেই কেবল গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা সফল হতে পারবে।

১৪. সহনশীলতা/পরমতসহিষ্ণুতা

গণতন্ত্রের প্রাণ হলো সহনশীলতা বা পরমতসহিষ্ণুতা। তাই গণতন্ত্রের সফলতার জন্য দল ও মত নির্বিশেষে সবাইকে সহনশীল হতে হবে। অপরের মতামতকে সহ্য করার মত মানসিকতা না থাকলে গণতন্ত্র সফল হতে পারে না।

উপরের শর্তগুলো যথাযথভাবে বাস্তবায়নের ওপর গণতন্ত্রের সাফল্য নির্ভর করে। তাই আধুনিক সমস্যাসঙ্কুল রাষ্ট্রে নানাবিধ সংকটের মোকাবিলা করে গণতন্ত্রকে সফল করতে উল্লিখিত শর্তগুলো পূরণে সব নাগরিক, দল ও সরকারের সচেষ্ট হওয়া উচিত।

Related Posts