অধিকার ও কর্তব্যের মধ্যে সম্পর্ক
অধিকার ও কর্তব্যের ধারণা পরস্পর ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কযুক্ত। অধিকারের কথা উচ্চারণের সাথে সাথে কর্তব্যের বিষয়টি স্বাভাবিকভাবেই উঠে আসে। ব্যক্তির জীবনের যথাযথ বিকাশের জন্য কিছু অধিকার ভোগের প্রয়োজন হয়। রাষ্ট্র ব্যক্তিকে আইনসংগত অধিকার প্রদানের মাধ্যমে তার সার্বিক বিকাশে সহায়তা করে। তবে রাষ্ট্রের কাছ থেকে অধিকার পাওয়ার বিনিময়ে কিছু কর্তব্যও পালন করতে হয়। কোনো ব্যক্তি বা সংস্থার কাছ থেকে অধিকার পাওয়ার ক্ষেত্রেও কমবেশি একই শর্ত প্রযোজ্য। অবশ্য নেহাত অধিকার পাওয়ার জন্যই কর্তব্য পালন করতে হয় তা নয়। বিষয়টি হচ্ছে, কোনো অধিকার পাওয়ার জন্য স্বাভাবিকভাবেই যে পথ দিয়ে যেতে হয় তা-ই হলো কর্তব্যের পথ। তার অর্থ হচ্ছে অধিকার ও কর্তব্য একই যাত্রাপথের দুইটি দিক মাত্র। এজন্য রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা মনে করেন অধিকার ও কর্তব্য একই মুদ্রার দুই পিঠ। অধ্যাপক হ্যারন্ড জে লাঙ্কি তার অধিকার সম্পর্কিত আলোচনায় কর্তব্যের ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘কর্তব্য সম্পাদনের সাথে সম্পর্কহীন অধিকারের দাবির কোনো অর্থ নেই।’
অধিকার কি | অধিকার কাকে বলে | অধিকারের সংজ্ঞা ও বৈশিষ্ট্য |
বাস্তবিকই অধিকারের ধারণা কখনও কর্তব্যহীন হতে পারে না। কর্তব্য পালন ব্যতীত কোনো কিছু দাবি করা যুক্তিসংগত নয়। নিচে অধিকার ও কর্তব্যের সম্পর্ক দেখানো হলো-
১. একই বিষয়ের দুটি দিক
অধিকার বলতেই কর্তব্য কথাটি আসে এবং বিপরীতক্রমে কর্তব্য বলতে উঠে আসে অধিকারের কথা। তাই বলা হয়, অধিকারের মধ্যেই কর্তব্য নিহিত আছে (Rights imply duties)। কেউ যদি কোনো অধিকার ভোগ করতে চায় তবে তাকে কর্তব্য পালন করেই তা ভোগ করতে হয়। লাস্কি যথার্থই বলেছেন, ‘ব্যক্তিত্বের পূর্ণ বাস্তবায়নের জন্য কিছু শর্তের প্রয়োজন। কিন্তু সেই সঙ্গে শর্তগুলো সম্পাদনের প্রয়োজন আরও বেশি।’ যেমন- কেউ যদি ভোটদানের অধিকার ভোগ করতে চায় তবে তাকে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে হয় অর্থাৎ ভোট দিতে হয়। সুতরাং অধিকার ও কর্তব্য একই বিষয়ের দুটি দিক মাত্র। একটিকে বাদ দিয়ে অপরটি কল্পনা করা যায় না।
২. পারস্পরিক সীমাবদ্ধতা
অধিকারের সীমা কর্তব্যের দাবি দ্বারা সীমাবদ্ধ। অধিকার যদি অবাধ হয় তাহলে তা হবে স্বেচ্ছাচার। আর অধিকার স্বেচ্ছাচার হলে শুধু সবলেরাই তা ভোগ করতে পারবে। দুর্বলের অধিকার সবলের কুক্ষিগত হয়ে পড়বে। তাই সবলের অধিকার দুর্বলের প্রতি কর্তব্যের দ্বারা সীমাবদ্ধ থাকে।
৩. পারস্পরিক নির্ভরশীলতা
কারও অধিকার বলতে যেমন তার নিজের কর্তব্য বোঝায়, তেমনি একজনের অধিকার বলতে অন্যজনের কর্তব্যও বোঝায়। যেমন- আমার পথ চলার অধিকার আছে তার অর্থ এই যে, আমি চলব এবং অপরকে চলতে দেব। আবার আমি যখন পথ চলব তখন অন্যজন আমাকে চলার জন্য পথ করে দেবে। এভাবে একজনের অধিকার অন্যজনের কর্তব্যে পরিণত হয়। কাজেই অধিকার ও কর্তব্যের সম্পর্ক খুবই নিবিড় ও পরস্পরের ওপর নির্ভরশীল।
৪. উৎপত্তিগত সম্পর্ক
অধিকার ও কর্তব্য সমাজবোধ থেকে এসেছে। এদের উভয়ের অস্তিত্ব সমাজের মধ্যে বিদ্যমান এবং সমাজের মধ্যেই এদের ভোগ ও পালন হয়ে থাকে। অধিকার ভোগ ও কর্তব্য পালনের মধ্যে সমাজের মঙ্গল নিহিত। যেমন- সমাজ আমাকে শিক্ষিত করে আমার শিক্ষার অধিকার পূরণ করে, আর আমি সমাজের কল্যাণে সেই শিক্ষাকে প্রয়োগ করে কর্তব্য পালন করি। তাই সমাজের বাইরে অধিকার ও কর্তব্যের অস্তিত্ব নেই। সমাজে বাস করতে গিয়ে মানুষ যেসব দাবি করে সেগুলোই সমাজের স্বীকৃতি পেয়ে অধিকার ও কর্তব্যে পরিণত হয়।
৫. রাষ্ট্র ও নাগরিকের সম্পর্কের ভিত্তি
রাষ্ট্র সব অধিকারের উৎস। আমরা রাষ্ট্রের কাছ থেকে অধিকার লাভ করি। কিন্তু সে অধিকার ভোগ করতে হলে কর্তব্য পালন করতে হয়। রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য দেখানো, নিয়মিত কর প্রদান করা, রাষ্ট্রের আদেশনিষেধ মেনে চলা ইত্যাদির মাধ্যমেই আমরা রাষ্ট্রের কাছ থেকে বিভিন্ন অধিকার লাভ করি।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, আয়কর প্রদান গুরুত্বপূর্ণ নাগরিক কর্তব্য। নাগরিকরা ঠিকমত আয়কর দিলে রাষ্ট্রের রাজস্বভান্ডার সমৃদ্ধ হয় এবং রাষ্ট্রের উন্নয়ন সহজসাধ্য হয়। আবার রাষ্ট্র তার নাগরিকদের অধিকার পূরণের মাধ্যমে এর উন্নতির পথই সুগম করে।
৬. উভয়ই সর্বজনীন
অধিকার ও কর্তব্য ব্যক্তিগত নয়, সর্বজনীন। অধিকার কেবল একক ভোগের জন্য নয়, এটি সবার জন্য স্বীকৃত। একজনের অধিকার ভোগের সাথে সাথে অন্য সবার অধিকার ভোগের দাবিও স্বীকৃত হয়। তেমনি কর্তব্যপালনও সবার জন্য প্রযোজ্য। ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রের কল্যাণে নাগরিকদের সবাইকে সমান দায়িত্বের সাথে কর্তব্যও পালন করতে হয়।
সুতরাং দেখা যাচ্ছে, নাগরিকের অধিকার ও কর্তব্য এ দুটি ধারণা অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। অধিকার ব্যতীত নাগরিক জীবন যেমন কল্পনা করা যায় না, তেমনি কর্তব্যপালন ব্যতীত রাষ্ট্রের অস্তিত্ব টিকে থাকাই সম্ভব হবে না। এই বিষয়ে কার্ল মার্কস বলেছেন, “No rights without duties” অর্থাৎ কর্তব্য ব্যতীত কোনো অধিকার নেই।
অধিকার কত প্রকার ও কি কি? – আলোচনা কর |
বাংলাদেশের সংবিধানে নাগরিক অধিকার ও কর্তব্য
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের তৃতীয় ভাগের ২৭ থেকে ৪৪ অনুচ্ছেদ পর্যন্ত মোট ১৮টি মৌলিক অধিকারের কথা লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। মৌলিক অধিকারগুলো হলো- ১. আইনের চোখে সমতা ২. ধর্ম-গোষ্ঠী-বর্ণ প্রভৃতি নির্বিশেষে বৈষম্যহীনতা ৩. সরকারি নিয়োগ লাভে সুযোগের সমতা ৪. উপাধি, সম্মান ও ভূষণের বিলোপ সাধন ৫. আইনের আশ্রয় লাভের অধিকার ৬. জীবন ও ব্যক্তি স্বাধীনতার রক্ষণ ৭. গ্রেফতার ও আটক সম্পর্কে রক্ষাকবচ ৮. জবরদস্তি শ্রম নিষিদ্ধকরণ ৯. বিচার ও দণ্ড সম্পর্কে রক্ষণ ১০. চলাফেরার স্বাধীনতা ১১. সমাবেশের স্বাধীনতা ১২. সংগঠনের স্বাধীনতা ১৩. চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা এবং বাক্ স্বাধীনতা ১৪. পেশা বা বৃত্তির স্বাধীনতা ১৫. ধর্মীয় স্বাধীনতা ১৬. সম্পত্তির অধিকার ১৭. গৃহ ও যোগাযোগের রক্ষণ ১৮. মৌলিক অধিকার বলবৎকরণ।
এছাড়া সংবিধানের ২৬(১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, মৌলিক অধিকারের সাথে অসামঞ্জস্যপূর্ণ সব প্রচলিত আইন যতখানি অসামঞ্জস্যপূর্ণ ততখানি বাতিল হবে।
বাংলাদেশ সংবিধানের ২০ ও ২১ নং অনুচ্ছেদে নাগরিকের কর্তব্যসমূহ ব্যাখ্যা করা হয়েছে। ২০(১)-এ বলা হয়েছে, কর্ম হইতেছে কর্মক্ষম প্রত্যেক নাগরিকের পক্ষে অধিকার, কর্তব্য ও সম্মানের বিষয়, এবং ‘প্রত্যেকের কাছ হইতে যোগ্যতানুসারে ও প্রত্যেককে কর্মানুযায়ী’-এই নীতির ভিত্তিতে প্রত্যেকে স্বীয় কর্মের জন্য পারিশ্রমিক লাভ করিবেন। রাষ্ট্র এমন অবস্থা সৃষ্টির চেষ্টা করবে, যেখানে সাধারণভাবে কোনো ব্যক্তি অনুপার্জিত আয় ভোগ করতে সমর্থ হবে না। ২১(১)-এ বলা হয়েছে, সংবিধান ও আইন মান্য করা, শৃঙ্খলা রক্ষা করা, নাগরিক দায়িত্ব পালন করা এবং জাতীয় সম্পত্তি রক্ষা করা প্রত্যেক নাগরিকের কর্তব্য। সব সময় জনগণের সেবা করার চেষ্টা করা প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিযুক্ত প্রত্যেক ব্যক্তির কর্তব্য।
পরিশেষে বলা যায়, অধিকারের মধ্যেই কর্তব্য নিহিত আছে। অধিকার হলো কর্তব্যের ফল। নাগরিক রাষ্ট্রের প্রতি কর্তব্য পালন না করে রাষ্ট্রের কাছে অধিকারের দাবি তুলতে পারে না। তেমনি রাষ্ট্রও সঠিকভাবে নাগরিকের অধিকার পূরণ না করে তার কাছ থেকে যথার্থ কর্তব্যপালন ও আনুগত্য আশা করতে পারে না। লাস্কি যথার্থই বলেছেন, ‘আমি যা পাই তার প্রতিদান দেওয়ার চেষ্টা না করে পাওয়ার কোনো অধিকার নেই।’