অধিকার কি বা কাকে বলে
সাধারণ অর্থে মানুষের ইচ্ছানুযায়ী কিছু করার ক্ষমতাকে অধিকার বলা হয়। কিন্তু অধিকারের এই অর্থ সন্তোষজনক ও গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ অধিকার ও দৈহিক শক্তি কখনও সমার্থক হতে পারে না। তাই পৌরনীতি ও সুশাসনে ‘অধিকার’ শব্দটি এক বিশেষ অর্থে ব্যবহৃত হয়। অধিকারের সত্যিকার ও গ্রহণযোগ্য অর্থ এই যে, এটি মানুষের ইচ্ছানুযায়ী কিছু করার ক্ষমতা যা সমাজ কর্তৃক স্বীকৃত হয়। সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতিই অধিকারের মূল বিষয়। এজন্যই অধিকার বলতে সীমিত ক্ষমতা বোঝায় এবং একজনের অধিকার অন্যের কর্তব্যের ইঙ্গিত দান করে। রাষ্ট্র সামাজিক কল্যাণের পরিবেশ সৃষ্টি ও সংরক্ষণ করে। অধিকার ভোগের মধ্য দিয়েই ব্যক্তির ব্যক্তিত্বের বিকাশ সাধন সম্ভব। তবে অধিকারসমূহ এমনভাবে ভোগ করতে হয় যাতে অপরের অধিকার কোনোরূপে ক্ষুণ্ণ না হয়।
অধিকারের সংজ্ঞা
আর্নেস্ট বার্কারের (Earnest Barker) মতে- ‘প্রতিটি রাষ্ট্রই আইনের মাধ্যমে একটি সার্বিক ন্যায় ব্যবস্থাকে রূপায়িত করে। সেই ব্যবস্থাতে এক একজন ব্যক্তি নির্দিষ্ট মর্যাদা ভোগ করার এবং নির্দিষ্টভাবে চলার যে সুযোগ পায় সেটাই তার অধিকার।’
অধ্যাপক হ্যারন্ড জে লাঙ্কি (Prof. Harold J Laski)-র ভাষায়, ‘অধিকার হচ্ছে সমাজজীবনের সেসব অবস্থা যা ব্যতীত মানুষ তার ব্যক্তিত্বের পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটাতে সক্ষম হয় না।’ (Rights are those conditions of social life without which no man can be at his best.)
দার্শনিক টি এইচ গ্রিনও অধিকারের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে প্রায় লাস্কির অনুরূপ বক্তব্য প্রদান করেছেন। তিনি বলেন, ‘অধিকার হচ্ছে সমাজজীবনের সেসব বাহ্যিক অবস্থা যেগুলো মানুষের মানসিক উৎকর্ষ সাধনের জন্য প্রয়োজনীয়।’ (Rights are the outer conditions essential for man’s inner developments.)
আরও দেখুন: ই গভর্নেন্স এর সুবিধা গুলো কি কি? – বিস্তারিত আলোচনা
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী হবহাউস (Hobhouse)-এর অভিমত হলো, ‘প্রকৃত অধিকার বলতে সামাজিক কল্যাণ সাধনের কতকগুলো শর্তকে বোঝায় এবং বিভিন্ন অধিকারের বৈধতা সমাজের সর্বাঙ্গীন উন্নতি বিধানের ওপর নির্ভরশীল।’ আর্নেস্ট বার্কার বলেছেন, ‘অধিকার হলো সর্বাধিক সংখ্যক মানুষের ব্যক্তিত্ব বিকাশের উপযোগী সর্বাধিক পরিমাণ সেইসব বাহ্যিক সুযোগ-সুবিধা যেগুলো রাষ্ট্র কর্তৃক স্বীকৃত এবং সংরক্ষিত হয়।’ (Rights are those necessary conditions of the greatest possible development of the capacities of most individuals, which are secured and guaranteed by the state.)
অধ্যাপক হল্যান্ড এর মতে, ‘এক ব্যক্তি কর্তৃক অপর ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গের কাজকর্মকে সমাজের মতামত ও শক্তি দ্বারা প্রভাবিত করার ক্ষমতাই হলো অধিকার।’ (Rights are one man’s capacity of influencing the acts of another by means of the opinion and force of the society.)
বোসানকোয়েত (Bosanquet)-এর মতে, ‘অধিকার হলো এমন দাবি যা সমাজ কর্তৃক স্বীকৃত এবং রাষ্ট্র কর্তৃক প্রযুক্ত।’ (A right is a claim recognised by society and enforced by the state.)
জাতিসংঘের ইউনেস্কো কমিটির মতে, ‘অধিকার হলো জীবনযাত্রার সেসব সুযোগ-সুবিধা যা না থাকলে সমাজের নির্দিষ্ট ঐতিহাসিক স্তরে মানুষ সমাজের সক্রিয় সদস্য হিসেবে সমাজের কল্যাণ সাধন করতে পারে না। কারণ ঐসব সুযোগের অভাবে নিজ সত্তার পূর্ণ বিকাশ আদৌ সম্ভব নয়।’
সুতরাং, অধিকার হচ্ছে এমন কতকগুলো মৌলিক সুযোগ-সুবিধা যা সবার জন্য আবশ্যক। অধিকার বলতে মানুষের আত্মবিকাশের জন্য কতিপয় সুযোগ-সুবিধা বা দাবিকে বোঝায়, যে দাবিসমূহের হয়তো নৈতিক না হয় আইনগত ভিত্তি রয়েছে।
অধ্যাপক লাস্কি বলেছেন, ‘প্রত্যেক রাষ্ট্রই পরিচিত হয় তার প্রদত্ত অধিকার দ্বারা।’ (Every State is known by the rights it maintains.)
অধিকারের বৈশিষ্ট্য
অধিকারের উল্লিখিত সংজ্ঞাসমূহ বিশ্লেষণ করলে তার কতিপয় নিজস্ব বৈশিষ্ট্য স্পষ্ট হয়। নিচে বৈশিষ্ট্যগুলো আলোচনা করা হলো-
১. সমাজ ছাড়া অধিকার রূপায়িত হতে পারে না। কারণ সমাজবদ্ধ জীব হিসাবে মানুষের প্রবৃত্তি থেকেই অধিকারের উদ্ভব।
২. দাবি মাত্রই অধিকার সৃষ্টি করে না। প্রকৃত অধিকার সমাজ কর্তৃক স্বীকৃত হতে হয়।
৩. অধিকারের সাথে বৃহত্তর সমাজের কল্যাণ ও স্বার্থ সম্পর্কযুক্ত।
৪. রাষ্ট্র অধিকারের স্রষ্টা নয়। কিন্তু রাষ্ট্রের দ্বারাই অধিকার রূপায়িত হয়।
৫. অধিকার সুনির্দিষ্ট ও সার্বজনীন।
৬. অধিকার ও কর্তব্য পরস্পর ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
৭. অধিকারের প্রবণতা ক্রমশ সম্প্রসারিত হয়।
৮. অধিকার কখনও শাশ্বত অপরিবর্তনীয় বা চিরস্থায়ী হয় না।
পরিশেষে বলা যায়, মানুষ বিবেকবান ও নৈতিকতা সম্পন্ন সামাজিক জীব। মানুষ একে অপরের সাথে সম্পর্কযুক্ত হয়ে সমাজবদ্ধ জীবন যাপন করে। এ কারণেই সমাজে মানুষের অধিকার স্বীকৃত হয়েছে।