প্রারম্ভিকা
চৈতসিক হলো চিত্তের বৃত্তি বা মনোবৃত্তি। চৈতসিক বায়ান্ন প্রকার। এরা বিভিন্ন সমবায়ে চিত্তের সাথে একসঙ্গে উৎপন্ন ও নিরোধ হয় এবং এক আলম্বন ও এক বাস্তু গ্রহণ করে। চিত্ত স্বভাবত ভাস্বর; কিন্তু চৈতসিকের সংযোগে চিত্তও চৈতসিকের স্বভাবানুরূপ আবস্থা প্রাপ্ত হয়। তথাপি চিত্ত এর ‘বিজানন’ স্বভাব ত্যাগ করেনা। চৈতসিক চিত্তের আশ্রয় ভিন্ন উৎপন্ন হতে পারেনা। কিন্তু চিত্ত চৈতসিক ভিন্ন উৎপন্ন হতে পারে দ্বি-পঞ্চ বিজ্ঞানে (চক্ষু ও. রূপ; জিহ্বা ও রস; শ্রোত্র ও শব্দ; নাসিকা ও গন্ধ; এবং কায় ও স্পর্শ) শুধু সর্বচিত্ত সাধারণ সপ্ত চৈতসিক যুক্ত থাকে। এটাই প্রকৃত চিত্ত।) এটা দ্বেষ-চৈতসিক বা লোভ-চৈতসিক বা অন্যান্য চৈতসিক বিহীন হয়ে উৎপন্ন হয়। কিন্তু দ্বেষ-চৈতসিক বা লোভ-চৈতসিকাদি চিত্তের আশ্রয় ব্যতীত উৎপন্ন হতে পারেনা। এই অর্থে চিত্তই বেদনা, সংজ্ঞা, সংস্কারাদির মধ্যে শ্রেষ্ঠ।
আরও পড়ুন:
চৈতসিক বলতে কি বুঝ? চৈতসিক কত প্রকার ও কি কি? সর্বচিত্ত সাধারণ চৈতসিক কত প্রকার ও কি কি?
চৈতসিকের প্রধান প্রধান বিভাগগুলোর সংক্ষিপ্ত পরিচয়
চৈতসিকের সংখ্যা বায়ান্ন হলেও এদেরকে প্রধানত সাতটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। যথা- (১) সর্বচিত্ত সাধারণ চৈতসিক, ২) প্রকীর্ণ চৈতসিক, ৩) অকুশল চৈতসিক, ৪) শোভন সাধারণ চৈতসিক, ৫, বিরতি চৈতসিক, (৬) অপ্রমেয় চৈতসিক এবং ৭) প্রজ্ঞেন্দ্রিয় চৈতসিক। নিম্নে চৈতসিকের বিভাগগুলোর সংক্ষিপ্ত পরিচয় দেওয়া হলোঃ
১. সর্বচিত্ত সাধারণ চৈতসিক
চারি ভূমির চিত্তসমূহ মূলতঃ সাতটি মাত্র চৈতসিকে গঠিত। যথা- স্পর্শ, বেদনা, – সংজ্ঞা, চেতনা, একাগ্রতা, জীবিতেন্দ্রিয় ও মনস্কার। এই সাত প্রকার চৈতসিককে সর্বচিত্ত সাধারণ চৈতসিক বলা হয়। তারা প্রত্যেক চিত্ত-ক্রিয়ার সঙ্গে বিদ্যমান থাকে। এই হিসেবে তারা প্রত্যেকটি এক একটি চিত্ত। যদি ৮৯ প্রকার চিত্ত কেবলমাত্র এই সাত প্রকার চৈতসিকের সংযোগে গঠিত হতো, তাহলে আমরা শুধু এক শ্রেণীর চিত্তই পেতাম। কিন্তু কুশল, অকুশল ও অব্যাকৃত (কুশল বা অকুশলের আকারে অনির্দ্ধারিত) স্বভাবসম্পন্ন আরও পঁয়তাল্লিশ প্রকার চৈতসিক রয়েছে। তারা নানাবিধ কিন্তু বিধিবদ্ধ সমবায়ে এই সপ্ত সর্বচিত্ত সাধারণ চৈতসিক গঠিত মৌলিক চিত্তের সাথে যুক্ত হয়ে চারি ভূমির ঊননব্বই প্রকার চিত্ত উৎপন্ন করে। বিস্তারিত বলতে গেলে একশত একুশ প্রকার চিত্ত উৎপন্ন করে।
২. প্রকীর্ণ চৈতসিক
বিতর্ক, বিচার, অধিমোক্ষ, বীর্য্য, প্রীতি ও ছন্দই হলো প্রকীর্ণ চৈতসিক “প্রকীর্ণ” বিশেষণটির অর্থ বিস্তীর্ণ, অসম্বন্ধ। এই চৈতসিকগুলি শোভন-অশোভন চিত্ত ক্ষেত্রে বিস্তারিত হয়ে পড়ে অর্থাৎ সংযুক্ত হয়। যেমন ‘মোহ’ শুধু অশোভন চিত্তে এবং ‘শ্রদ্ধা’ শোভন চিত্তে আবদ্ধ থাকে। কিন্তু প্রকীর্ণ চৈতসিক শোভন এবং অশোভন উভয় চিত্তেই সংযুক্ত থাকে অর্থাৎ উভয়টিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে। তাই এদেরকে প্রকীর্ণ চৈতসিক বলে। এরা যখন শোভন চিত্তে যুক্ত থাকে তখন কুশল কর্মে সাহায্য করে আর যখন অশোভন চিত্তে যুক্ত হয় তখন অকুশল কর্মের সহায় হয়। যেমন “বিরিয বা বীর্য্য” হলো প্রকীর্ণ চৈতসিক। যার অর্থ বীরত্ব, অধ্যবসায়, কর্মশক্তি ইত্যাদি। এই বীর্য্য শক্তিই শাক্যমুনিকে বুদ্ধত্ব লাভে সহায়তা করেছে আবার এই বীর্য্যই দস্যু অঙ্গুলিমালাকে হাজার হাজার নর হত্যায় সাহস যুগিয়েছে। অতএব, “বীর্য্য চৈতসিক” শোভনে বিমুক্তি সুখও এনে দেয় আবার অশোভনে অধঃপাতের কালান্তরেও নিক্ষেপ করে।
৩. অশোভন (অঙ্কুশল) চৈতসিক
মোহ, অহী, অনপত্রপা, ঔদ্ধত্য, লোভ, দৃষ্টি, মান, দ্বেষ, ঈর্ষা, মাৎসর্য্য কৌকৃত্য, স্ত্যান, মিদ্ধ এবং বিচিকিৎসা এই চৌদ্ধটি হলো অকুশল চৈতসিক। এসব চৈতসিক সমুহ কেবল অকুশল কর্মেই সহায়তা করে, কুশল চৈতসিক হলো অকুশল চৈতসিকের ঘোর শত্রু। পুণ্য কার্যে বাধা দেওয়া এদের লক্ষণ। সাধন মার্গে পরাক্রম নাশী ভূমিকা নেয়া মীরজাফরী সদৃশ। বিমুক্তির পথে অন্তরায় সৃষ্টি করা প্রধান কৃত্য।
৪. শোভন (কুশল) সাধারণ চৈতসিক
শোভন চৈতসিক ঊনিশ প্রকার। যথা- শ্রদ্ধা, স্মৃতি, হ্রী, অপত্রপা, অলোভ, অদ্বেয, তত্রমধ্যস্থতা, কায়-প্রশ্রদ্ধি, চিত্ত-প্রশ্রদ্ধি, কায়-লঘুতা, চিত্ত-লঘুতা, কায়-মৃদুতা, চিত্ত-মৃদুতা, কায়-কর্মণ্যতা, চিত্ত-কর্মণ্যতা, কায়-প্রগুণতা, চিত্ত-প্রগুণতা, কায়-ঋজুতা এবং চিত্ত-ঋজুতা। এসব চিত্তসমূহ দ্বারা মানুষ পুণ্যকর্মাদি গৃহীত, কৃত ও ফলিত হয়। স্মৃতি ভাবনা করতে সক্ষম। কায়-বাক্য-মনে পাপাচারের প্রতি ভয় থাকে। চিত্ত-চৈতসিকে সমতা বজায় থাকে এবং দেহ-মনে কোমলতা আসে, কুশল কর্ম সম্পাদনে কর্মশক্তি অর্জন করেন। সর্বোপরি সুনির্দিষ্ট নিয়মে দান-শীল-ভাবনাদি কুশল কর্ম সম্পাদন করতে পারেন।
৫. বিরতি চৈতসিক
এই চৈতসিক তিন প্রকার। যথা- সম্যক বাক্য, সম্যক্ কর্ম ও সম্যক্ আজীব। এতে মিথ্যা, পিশুন, কর্কশ ও বৃথা বাক্যের ন্যায় বাক্ দুশ্চরিত্র হতে বিরতি; প্রাণী হত্যা, চুরি ও ব্যাভিচার এই ত্রিবিধ কায়- দুশ্চরিত্র হতে বিরতি এবং প্রাণী বাণিজ্য, বিষ বাণিজ্য, অস্ত্র বাণিজ্য, নেশা বাণিজ্য ও মাংস বাণিজ্য হতে বিরতিই হলো সম্যক্ আজীব বিরতি।
৬. অপ্রমেয় চৈতসিক
অপ্রমেয় চৈতসিক দুই প্রকার। যথা- করুণা ও মুদিতা। পরের দুঃখ অপনোদনের ইচ্ছার নাম করুণা। দুঃখাভিভূতের নিরাশ্রয় ভাব দর্শন করুণা উৎপত্তির কারণ। “সব্বে সত্তা সব্ব-দুক্খা পমুচ্চন্ত” এটাই হলো করুণা ভাবনার মন্ত্র। পরের শ্রী, সম্পদ, যশঃ, লাভ, ঐশ্বর্য ইত্যাদি সোভাগ্য দর্শনে নিজ চিত্তের আনন্দই “মুদিতা”। অন্যের সম্পদ অনুমোদন মুদিতার লক্ষণ। “সব্বে সত্তা যথালব্ধ সম্পত্তিতো মা বিগচ্ছন্ত” এটা মুদিত ভাবনার মন্ত্র। করুণা ও মুদিতার আলম্বন যথাক্রমে সত্ত্বের ‘দুঃখ’ ও ‘সম্পদ’। সত্ত্ব সংখ্যা অপ্রমেয় বলে এর অপ্রমেয় চৈতসিক।
৭. প্রজ্ঞেন্দ্রিয় চৈতসিক
আলম্বনের যথার্থ স্বভাব সম্বন্ধে জ্ঞানই প্রজ্ঞা। প্রজ্ঞা যখন মোহকে পরাজিত করে আলম্বনের যথার্থ স্বভাব উদঘাটিত করবার উপযোগী শক্তি ধারণ করে তখনই এটা প্রজ্ঞেন্দ্রিয়। স্মৃতি ভাবনার সময় প্রজ্ঞা পথ নির্দেশ করে, স্মৃতি চিত্তকে সেই পথে স্থিত রাখে। সর্বশেষে এই প্রজ্ঞাই চিত্তকে নির্বাণপথ-উদ্ভাসিত করে প্রদর্শন করে।
উপসংহার
পরিশেষে বলা যায় যে, চৈতসিক হলো বাহ্যিক আলম্বন। বাইরের নানা প্রকার ছাপ চিত্তে পতিত হয়ে নিত্য নতুন নতুন চিত্ত উৎপন্ন করায়, ঠিক যেন নানাবিধ রং মিশ্রণে পানি স্বীয় স্বচ্ছতা হারিয়ে ফেলে। আমাদের চিত্তও বাইরের ছাপে সংস্কার অবস্থা প্রাপ্ত হয়।