ষড়তাত্ত্বিক
ভূমিকা
পিতৃহত্যা এবং গুরু দেবদত্তের মৃত্যুর পর রাজা অজাতশত্রুর মনে এক তাৎপর্যময় প্রশ্নের উদয় হয়। তা হল গৃহীগণের জন্য বহুবিধ শিল্প আছে। যথা- হস্তী আরোহণ, অশ্বারোহণ, চেলক গুপ্তচর, ক্ষৌরকার, মালাকার, কুম্ভকার ইত্যাদি। ঐসব শিল্পাবলম্বী প্রত্যেকেই সাংদৃষ্টিক শিল্পফল প্রাপ্ত হন। তার দ্বারা তারা স্বয়ং সুখী হন, পিতা-মাতা, স্ত্রী-পুত্র ও মিত্রামাত্যকেও সুখী এবং তৃপ্ত করেন। কিন্তু প্রব্রজ্যিত হয়ে এরূপ ইহ জীবনেই লভ্য কোন সাংদৃষ্টিক শ্রামাণ্যফল পাওয়া যায় কি না এই প্রশ্নের উত্তরের সন্ধানে রাজা সমসাময়িক খুব নামজাদা ছয়জন জ্ঞানী, যশস্বী, তীর্থম্বর এবং অভিজ্ঞ গুণাচার্য পুরণ কাশ্যপ, মোক্খলি গোসাল, অজিত কেশকম্বলী, পকুধ কচ্চায়ন, সঞ্জয় বেলটঠিপুত্র ও নিগ্রন্থনাথ পুত্রের নিকট একের পর এক গমন করেন। এদের একত্রে ষড়তাত্ত্বিক বলা হয়। কিন্তু কারো মতবাদে তিনি মানসিক শান্তি লাভ করতে পারেন নি। বরং তিনি ছয় শাস্তার মধ্যে সঞ্জয়কে সর্বাপেক্ষা অজ্ঞানী বলেছেন। পরিশেষে তিনি রাজবৈদ্য জীবকের পরামর্শে তথাগত বুদ্ধের নিকট যান এবং বুদ্ধের শ্রামণ্যফল সূত্র’ দেশনায় অতীব প্রীত হয়ে ভগবানের শরণাগত উপাসক হন। পরিব্রাজক সুভদ্রও এই ষড়তাত্ত্বিক দের মতবাদে সন্তুষ্ট হতে না পেরে ভগবানের অন্তিম সময়ে তাঁরই সত্যধর্ম দেশনা শুনে পরম শান্তি নির্বাণ সাক্ষাৎ করেন।
ষড়তাত্ত্বিক
ষড় শব্দের অর্থ হল “ছয়” আর তাত্ত্বিক শব্দের অর্থ যিনি তত্ত্ব প্রদান ও তর্ক করতে পারেন তাকেই বুঝাই। সুতরাং শব্দগতভাবে তাত্ত্বিক বলতে তাকেই বোঝায় যিনি তত্ত্ব ও তর্কে পারদর্শী। ভগবান তথাগত বুদ্ধের সমসাময়িক তৎকালীন ভারতে ছয়জন নামজাদা ধর্মগুরু যথা- পুরণ কাশ্যপ, মোক্খলি গোসাল, অজিত কেশকম্বলী, পকুধ কচ্চায়ন, নিগ্রন্থনাথ পুত্র ও সঞ্জয় বেলটঠিপুত্র বাস করতেন। তাঁরা ছিলেন তৎকালীন সংঘনায়ক, গণনায়ক, গণাচার্য, প্রাজ্ঞ, যশস্বী ও তীর্থঙ্কর এবং বহুজনের দ্বারা সম্মানিত। এজন্য তাদেরকে একত্রে ষড়তাত্ত্বিক বলা হয়।
ষড়তাত্ত্বিকদের জীবন ও ধর্মমত
ষড়তাত্ত্বিক গণ ঈশ্বর, আত্মা, মন ও মোক্ষ সম্বন্ধে বিভিন্ন মনোভাব পোষণ করতেন। নিচে ষড়তাত্ত্বিক দের জীবন কর্ম ও ধর্মমত সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হল-
১. পূরণ কাশ্যপ: কোন এক ভদ্রলোকের ঔরসে এক বিজাতিয়া স্ত্রীর গর্ভে তার জন্ম হয়। পূর্বে সে বংশে ৯৯ জন জন্মেছিল, তার জন্মে একশত জন পূর্ণ হওয়ায় তিনি “পূরণ” আখ্যা লাভ করেন। তার ব্যক্তিগত নাম কাশ্যপ। তাঁর গোত্র নাম “কাশ্যপ” থেকে প্রমাণিত হয় যে, তিনি জাতিতে ব্রাক্ষ্মণ ছিলেন। যৌবনে তিনি এক দ্বারবানের কাজে নিযুক্ত হন। এই কাজে তিনি বিরক্ত হয়ে বনে পলায়ন করেন। সেখানে দস্যুরা তাঁর বস্ত্র কেড়ে নেয়। বিবস্ত্র হয়ে তিনি নিকটবর্তী গ্রামে প্রবেশ করেন। গ্রামবাসীদেরকে বললেন- “আমি সমস্ত বিদ্যায় পূর্ণতা প্রাপ্ত হয়েছি বলে লোকে আমাকে পূরণ বলে এবং ব্রাক্ষণ বংশে জন্মেছি বলে লোকে আমাকে কাশ্যপ বলে।” তখন গ্রামবাসীরা তাকে বস্ত্রদান করলে তিনি বললেন- “লজ্জা নিবারণের জন্য বস্ত্র ব্যবহৃত হয়, পাপ হতে লজ্জার উৎপত্তি, আমি সমস্ত পাপ-প্রবৃত্তি নির্মূল করেছি, অতএব আমার বস্ত্রের প্রয়োজন নেই”। একথা শুনে লোকে তাঁকে পূজা করতে লাগল। পরে তাঁর পাঁচশত প্রধান শিষ্য হয়। আশি হাজার লোক তাঁর মত অনুবর্তন করে।
ধর্মমত: তাঁর মতে আত্মা অক্রিয়াশীল। দেহের প্রভাবে কর্ম করা হয় বলে আত্মা দেহের ভাল-মন্দ কর্মের ফলাফল থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত। তাই স্বহস্তে করলে বা আদেশ দিয়ে করালে, ছেদন করলে বা করালে, দন্ড দ্বারা পীড়ন করলে বা করালে, সিঁদ্ কাটলে বা কাটালে, চুরি, প্রাণীহত্যা, ব্যভিচার, মিথ্যা ইত্যাদি সর্ববিধ পাপ কাজে লিপ্ত থাকলে অথবা কারও দ্বারা সম্পাদন করালে কোন পাপ নেই। পাপ করছি জেনে পাপ করলেও পাপ হয় না। দান, ইন্দ্রিয় দমন, শীল সংযম এবং সত্যবাক্য বলার দ্বারাও কোন পুণ্য হতে পারে না। মোট কথা তার মতে পাপ-পুণ্য কিছুই নেই। অকুশল করলেও পাপ হয় না, কুশল করলেও পুণ্য হয় না।
২. মোক্খলি গোসাল: তাঁর প্রকৃত নাম মস্করি। গোশালায় এক দাসীর গর্ভে জন্ম হওয়ায় তাঁর নাম মস্করী গোসাল হয়। জৈন ভগবতী সূত্রের মতে তাঁর পিতা ও মাতা “মংখ” পেশাজীবী ছিলেন। এজন্য তিনি মংখলি পুত্র নামেও পরিচিত হন। একদিন তিনি তাঁর প্রভুর আদেশ মত একটি ঘৃত-কুম্ভ মস্তকে করে যেতে হঠাৎ পদস্থলন হয়ে সমস্ত ঘৃত মাটিতে পড়ে যায়। ভয়ে পলায়ন করতে প্রভু তাঁর বস্ত্র ধরে ফেলেন। তিনি বিবস্ত্র হয়ে বনে প্রবেশ করেন। এরপর নিকটস্থ গ্রামে গিয়ে লোকজনকে প্রতারিত করেন। কালে তাঁরও পাঁচশ জন প্রধান শিষ্য হয়। অশীতি সহস্র লোক তাঁর মতের অনুসরণ করে। জৈন ধর্মের ঐতিহ্যগত প্রবর্তক পার্শ্বনাথের প্রথম অনুসারী হিসেবে তিনি আজীবক ধর্ম প্রচার করেন।
ধর্মমত: তাঁর মতে সত্ত্বগণের সংক্লেশের বা পাপের কোন হেতু বা প্রত্যয় নেই। অহেতু ও অপ্রত্যয় বশতঃ প্ৰাণীগণ সংশ্লিষ্ট হয়। সেরূপ সত্ত্বগণের বিশুদ্ধিরও কোন হেতু বা প্রত্যয় নেই। অহেতু-অপ্রত্যয় বশতঃ প্রাণিগণ বিশুদ্ধ হয়। স্বীয় পরাক্রমে কর্ম করলেও কোন ফল নেই। পরের উপদেশ পালনেও কোন লাভ নেই। বল, বীর্য, পুরুষ-শক্তি, পুরুষ-পরাক্রম বা পুরুষকার বলতে কিছু নেই। সর্বসত্ত্ব, সর্বপ্রাণী, সর্বজীব অধীন, অবল, অবীর্য, নিয়তি, সঙ্গতি ও স্বভাবে তারা নানা প্রকার গতিপ্রাপ্ত হয়। অর্থাৎ যা হবার তা হয়, যা না হবার তা হয় না। চুরাশী মহা কল্পকাল ক্ষেপণান্তে জ্ঞানী ও অজ্ঞানী সকলে দুঃখের অন্তসাধন করবে। এতে অন্যের সাহায্যের কোন প্রয়োজন নেই।
৩. অজিত কেশকম্বল: প্রভুর ভর্ৎসনা সহ্য করতে না পেরে তিনি সন্ন্যাস অবলম্বন করেন। তিনি কেশ নির্মিত বস্ত্র দ্বারা গাত্র আচ্ছাদিত করতেন এবং সর্বদা মস্তক মুণ্ডন করতেন। তাই তাঁর প্রকৃত নাম অজিত এর সাথে কেশকম্বল যোগ করে অজিত কেশকম্বলী বলে পরিচিত হন। তাঁকে ইতিহাস প্রসিদ্ধ ”ন” সন্তি পরি লোকবাদী, নাস্তিক বা উচ্ছেদবাদী বলা হয়।
ধর্মমত: তাঁর মতে দানের, যজ্ঞের, অতিথি সৎকারের, সুকৃত-দুষ্কৃত কর্মের কোন ফল বা বিপাক নেই। ইহলোক, পরলোক, মাতাপিতা ও ঔপপাতিক সত্ত্ব নেই। পৃথিবীতে সম্যক প্রতিপন্ন বা সম্যক মার্গলাভী এমন কোন শ্রমণ-ব্রাহ্মণ নেই, যারা স্বয়ং অভিজ্ঞা বলে ইহলোক ও পরলোক প্রত্যক্ষ করে বলতে পারেন। পুরুষ চার মহাভূত হতে উৎপন্ন। মরে গেলে মাটীর অংশ মাটীর সাথে, জল জলের সাথে, তেজ তেজের সাথে এবং বায়ু বায়ুর সাথে মিশে যায় এবং ইন্দ্ৰিয় সমূহ আকাশে গমন করে। যারা বলে দানের ফল আছে তাদের বাক্য তুচ্ছ, মিথ্যা প্রলাপ মাত্র। পন্ডিত ও মূর্খ উভয়েই দেহাবসানে উচ্ছেদ প্রাপ্ত হয়। বিনষ্ট হয়ে এর মরণান্তে কোন অস্তিত্ব থাকে না।
৪. পকুধ কচ্চায়ন: এ ব্যক্তি ব্রাহ্মণ বংশে এক বিধবার গর্ভে জন্ম গ্রহণ করেন। পকুধ বৃক্ষমূলে তাঁর জন্ম হওয়ায় পকুধ কচ্চায়ন নামে প্রসিদ্ধি লাভ করেন। জনৈক ব্রাহ্মণ তাকে প্রতিপালন করেন। ব্রাহ্মণের মৃত্যু হলে জীবিকা নির্বাহের উপায় না দেখে সন্ন্যাস অবলম্বন করেন।
ধর্মমত: তাঁর মতে পৃথিবীকায়, আপকায়, তেজকায়, বায়ুকায়, সুখ, দুঃখ ও জীব (আত্মা) এই সাতটি কায় অকৃত, অকারিত, অনির্মিত, বন্ধ্য, কুটস্থ, ইন্দ্ৰখিল সদৃশ স্থিত। তারা কম্পিত হয় না, বিপরিণাম প্রাপ্ত হয় না, পরস্পরের বাধা জন্মায় না, পরস্পরের সুখ-দুঃখের হেতুও নহে। কোন হন্তা নেই, হনন করাবারও কেহ নেই। শ্রোতা, বক্তা, বিজ্ঞাতা কেহ নেই, বিজ্ঞাপন কর্তাও নেই । তীক্ষ্ণ অসি দ্বারা শিরচ্ছেদ করলেও কেহ কারও জীবন হত্যা করতে পারে না। অপিচ এ সাত কায়ের অন্তরে, বিবরে শস্ত্র প্রবেশ করে মাত্র ।
আরও পড়ুন: প্রসেনজিৎ কে ছিলেন? বৌদ্ধ ধর্ম প্রচার ও প্রসারে তাঁর ভূমিকা আলোচনা কর
৫. নিগ্রন্থ নাতপুত্র: ইনি জৈনধর্ম প্রবর্তক ইতিহাস প্রসিদ্ধ মহাবীর। তিনি নাত নামক কৃষকের পুত্র। নিগষ্ঠ বা নির্গ্রন্থ বলা হয় এ কারণে যে তিনি বলতেন “এমন কোন গ্রন্থ নেই আমি পাঠ করিনি।” এ কারণে তিনি নির্গ্রন্থ নাতপুত্র নামে পরিচিত। তিনি পার্শ্বনাথের জৈনধর্মের প্রবক্তা। তাঁর পঞ্চশত প্রধান শিষ্য ছিল।
ধর্মমত: তাঁর মতে শীতল জলও প্রাণী বিশেষ। এ হেতু শীতল জলও ব্যবহার করতে নেই। তিনি সর্ব পাপ হতে বিরত, সমস্ত পাপ-বিধৌত ও সর্বপাপ দূরীকরণে লগ্ন চিত্ত। এহেতু তিনি অন্তপ্রাপ্ত চিত্ত, সংযত ও সুপ্রতিষ্ঠিত।
উল্লেখ্য যে, ষড়তাত্ত্বিক গুনাচার্যদের মধ্যে একমাত্র মহাবীরের ধর্মমত ব্যতীত অপর কোন ধর্মমত বিস্তৃতভাবে পাওয়া যায়নি।
৬. সঞ্জয় বেলট্ঠিপুত্র: বেলাস্থি নাম্নী দাসীর গর্ভে তাঁর জন্ম হয় বলে তিনি বেলট্ঠি পুত্র বলে পরিচিত হন। তাঁর মস্তকে সঞ্জয় (Wood apple) ফলের ন্যায় মাংসপিণ্ড বিদ্যমান থাকায় তিনি সঞ্জয় বেলাস্থি পুত্র নামে প্রসিদ্ধ হন। তিনি বুদ্ধের সমসাময়িক বিখ্যাত সংশয়বাদী। তাঁরও অনেক শিষ্য ছিল।
ধর্মমত: তাঁর মতবাদ হল অমরা বিক্ষেপবাদ। তিনি কিছুতেই ধরা দিতেন না। প্রশ্ন জিজ্ঞাসিত হলে বলতেন, “এরূপও আমি বলিনা, সেরূপও আমি বলি না, অন্যথাও আমি বলি না, না বলেও আমি বলি না।” এরূপ উত্তর দিয়ে তিন বাক্য বিক্ষেপ করতেন। এরূপ করার কারণ হল যে মিথ্যা ধরা পড়ার ভয়, যেহেতু তিনি কিছুই সঠিক জানতেন না। এভাবেই তিনি তাঁর মতবাদকে বাঁচিয়ে রাখতেন। তাঁর ভ্রান্ত ধারণা ছিল বিধায় কর্মের ফলাফলকে তিনি প্রাধান্য দিতেন না। তাঁর ধারণা যে ইহজন্মে যে যেভাবে আছে অর্থাৎ দ্বিপদ, চতুষ্পদ ইত্যাদি বহুবিধ প্রাণী, তারা পরজন্মেও ঠিক সেই অবয়ব প্রাপ্ত হবে ।
উপসংহার
বুদ্ধের সমসাময়িক এই ছয়জন ছিলেন খুবই তাত্ত্বিক। তাঁরা একজনের ভাষিত ধর্ম অপর জন বিচার- বিশ্লেষণ দ্বারা খণ্ডন এবং স্বীয় মত প্রতিষ্ঠার প্রয়াস চালাতেন। তাঁদের বহু শিষ্য প্রশিষ্য বুদ্ধের তার শিষ্যদের সান্নিধ্যে এসে বহুবিধ বাক্যালাপ এবং তর্ক করতে আসতেন পরাজিত করার মানসে, কিন্তু অনেকে তর্কে পরাজিত হয়ে সম্যক দৃষ্টি সম্পন্ন হয়ে বুদ্ধের শিষ্যত্বও গ্রহণ করতেন।