Home » প্রসেনজিৎ কে ছিলেন? বৌদ্ধ ধর্ম প্রচার ও প্রসারে তাঁর ভূমিকা আলোচনা কর

প্রসেনজিৎ কে ছিলেন? বৌদ্ধ ধর্ম প্রচার ও প্রসারে তাঁর ভূমিকা আলোচনা কর

by TRI

ভূমিকা

তথাগত গৌতম বুদ্ধ বৌদ্ধধর্মের প্রবর্তক। তিনি সর্বজীবের হিতার্থে ও মঙ্গল কামনায় তাঁর ধর্ম প্রচার করেন। বুদ্ধের জীবদ্দশায় বেশ কয়েকজন রাজা বুদ্ধের প্রচারিত ধর্ম প্রচার ও প্রসারে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। সর্ব জীবের মঙ্গলের জন্য বুদ্ধের সহজ সরল আহ্বান “বহুজনহিতায় বহুজনসুখায়” জনসাধারণের পাশাপাশি রাজন্যবর্গকেও আকর্ষণ করে এবং ফলস্বরূপ বৌদ্ধধর্মের উত্থানের সঙ্গে সঙ্গেই মগধরাজ বিম্বিসার ও কোসলরাজ প্রসেনজিৎ বুদ্ধের অনুগামী হয়ে পড়েন। রাজন্যবর্গ গতানুগতিক ধারাবাহিকতার বহির্ভূত নতুনত্বের সন্ধান পেয়ে বুদ্ধের ধর্মের অন্যতম পৃষ্ঠপোষক রূপে পরিগণিত হন।

প্রসেনজিতের পরিচয়

প্রসেনজিৎ কোসল রাজ্যের রাজা ছিলেন। শ্রাবস্তী ছিল কোসলের রাজধানী এবং খুবই সমৃদ্ধশালী নগরী। তিনি ছিলেন বুদ্ধের সমবয়সী। দিব্যবদান অনুসারে তাঁর প্রকৃত নাম ছিল অগ্নিদত্ত। Rhys Davids এর মতে, সম্ভবতঃ পসেনদি কোসল রাজাদের একটি সম্মানসূচক উপাধি মাত্র, প্রকৃত নাম নই। রাজা প্রসেনজিৎ তক্ষশীলায় শিক্ষা গ্রহণ করেন এবং বিভিন্নরকম বিদ্যা ও শিল্পকলা শিখে তক্ষশীলা থেকে কোসল রাজ্যে প্রত্যাবর্তন করলে তাঁর পিতা তাঁর বুদ্ধিমত্তার পরিচয় পেয়ে তাকে তার উত্তরাধিকারী রূপে নির্বাচিত করেন। রাজ্যভার গ্রহণ করে তিনি খুবই নিয়ম নিষ্ঠার সঙ্গে রাজ্য শাসন করতেন। তিনি জ্ঞানী ও সাধু ব্যক্তিদের খুব ভালোবাসতেন এবং তাদের সঙ্গ উপভোগ করতেন। প্রসেনজিতের প্রধান মহিষী ছিলেন মল্লিকা। মল্লিকা দেবীই রাজাকে সর্বপ্রথম বুদ্ধের নিকট নিয়ে যান। তথাগত বুদ্ধের সার্বজনীন উপদেশ রাজাকে নিবিড়ভাবে আকৃষ্ট করে। তিনি সেই থেকেই বুদ্ধের উপাসকত্ব গ্রহণ করেন। বৌদ্ধধর্মে দীক্ষিত হবার পর তিনি বুদ্ধের একনিষ্ঠ ভক্ত হয়ে পড়েন এবং বৌদ্ধধর্মের পৃষ্ঠপোষকতা করেন।

বৌদ্ধধর্ম প্রচার ও প্রসারে প্রসেনজিতের ভূমিকা

বুদ্ধের সমসাময়িক রাজন্যবর্গের মধ্যে কোসলের রাজা মহাকোসলের পুত্র প্রসেনজিৎ বুদ্ধের পৃষ্ঠপোষকদিগের মধ্যে অন্যতম। বৌদ্ধধর্মের বিস্তৃতিতে ষোঢ়শ মহাজনপদগুলোর মধ্যে মগধের পরেই কোসলের স্থান। তিব্বতীয় উপাদান অনুযায়ী প্রসেনজিৎ বুদ্ধের ধর্মপ্রচারের দ্বিতীয় বর্ষে বৌদ্ধধর্মে দীক্ষিত হন। মজ্জিম নিকায়েও উক্ত হয়েছে যে, প্রসেনজিৎ বুদ্ধের সাক্ষাৎ কালে সর্বদা বুদ্ধের পাদ বন্দনা করতেন। বস্তুতঃ প্রসেনজিৎ ও বুদ্ধের কথোপকথন গুলো কোসলসংযুক্তে লিপিবদ্ধ আছে। প্রসেনজিৎ বুদ্ধের প্রতি এতই শ্রদ্ধাশীল ছিলেন যে সমগ্র শাক্যকুলকেই তিনি অত্যন্ত শ্রদ্ধার চোথে দেখতেন। রাজা স্বয়ং শাক্যকন্যা বিবাহ করে শাক্যদিগের সাথে সম্পর্ক সুদৃঢ় করতে চেয়েছিলেন।

আরও পড়ুন:   কণিষ্ক কে ছিলেন? শাসক ও বিজেতা হিসেবে কণিষ্কের কৃতিত্ব মূল্যায়ন কর

কথিত আছে রাজা প্রসেনজিৎ বুদ্ধ ও তার শিষ্যদের জন্য রাজাকারাম নামক একটি সংঘারাম নির্মাণ করে দেন। চীনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙ তার ভ্রমণ বৃত্তান্তেও মহাপ্রজাপতি গৌতমীর জন্য রাজা প্রসেনজিৎ নির্মিত একটি বিহারের উল্লেখ করেছেন। প্রসেনজিৎ তার পত্নী মল্লিকা দেবীর পরামর্শে বৌদ্ধ সংঘকে প্রতিনিয়ত দান করতেন। রাজা প্রসেনজিতের বোন সুমনা সঙ্ঘে প্রবেশ করে ভিক্ষুণী হন এবং বুদ্ধের ধর্মোপদেশ শ্রবণ ও অনুসরণ করে অর্হত্ব লাভ করেন। রাজা প্রসেনজিৎ ও তাঁর পত্নী মল্লিকাদেবী বুদ্ধ ও সংঘকে দান করতে খুবই ভালোবাসতেন। বৌদ্ধ সাহিত্যে তাঁর দানকে অসদিস দান বা অতুলনীয় দান হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। শ্রাবস্তীতে তাঁর প্রধান মহিষী মল্লিকা দেবীর অনুরোধে একটি অথিতিশালা নির্মাণ করেন। এটি “মল্লিকারাম” নামে খ্যাত। এখানে বসে বুদ্ধ ধর্ম দেশনা করেছিলেন। প্রসেনজিৎ অত্যন্ত দান পরায়ণ ছিলেন। একবার তিনি বুদ্ধকে পাঁচশত শিষ্য সহ জেতবনে নিমন্ত্রণ করেন। তিনি নগরবাসীদেরকে ডেকে বললেন, “তোমরা এসে আমার দান দেখ”। তারপর নগরবাসীরা রাজার দান দেখে তারাও সশিষ্য বুদ্ধকে নিমন্ত্রণ করে দান করেন। এভাবে রাজা ও প্রজাদের মধ্যে দানের প্রতিযোগিতা হলে রানি মল্লিকা তা জ্ঞাত হয়ে একটি মহাদানের আয়োজন করেন। সেই দানানুষ্ঠানে রাজা নিজের হাতে ভিক্ষুসঙ্গকে দান করেন। এ মহাদানে প্রায় চৌদ্দ কোটি মুদ্রা ব্যয় হয়েছিল।

কথিত আছে প্রসেনজিৎ এক অমাত্য রাজার বিশাল পরিমাণ দানের সমর্থন না করলে প্রসেনজিৎ উক্ত ব্যক্তিকে মন্ত্রীত্ব হতে চুত্য করেন। অপর দিকে মন্ত্রী জুগ্হ রাজার বৌদ্ধসংঘকে দান করার বিষয়টি সমর্থন জানালে প্রসেনজিৎ জুগ্হকে তাঁর রাজত্ব এক সপ্তাহের জন্য শাসন করতে অনুমতি দান করেন। এর দ্বারাই বুদ্ধ এবং ভিক্ষু সঙ্গের প্রতি প্রসেনজিতের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা পরিমাপ করা যায়। মজঝিম নিকায়ে বুদ্ধের সাথে প্রসেনজিতের শেষ সাক্ষাৎকারটি লিপিবদ্ধ রয়েছে। উক্ত ঘটনাটির পরেই প্রসেনজিৎ রাজ্যচুত্য হয়ে প্রাণত্যাগ করেন। প্রসেনজিতের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই কোসল রাজ্যের ইতিহাস প্রায় শেষ হয়ে যায়। কারণ তার পুত্র বিড়ুড়ভের শাক্যকুল ধ্বংস করার পরবর্তী ঘটনা অজ্ঞাত। অনাগত বংসে প্রসেনজিৎকে বোধিসত্ত্ব বলে উল্লেখ করা হয়েছে। উদানের বর্ণনা অনুযায়ী তিনি অন্যান্য ধর্মালম্বীদের প্রতিও শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। বৌদ্ধধর্মের ইতিহাসে মগধরাজ বিম্বিসারের পরই রাজা প্রসেনজিতের স্থান। কেননা, তাঁর পৃষ্ঠপোষকতায় বৌদ্ধধর্ম ভারতবর্ষে প্রভূত প্রতিপত্তি লাভ করেছিল।

উপসংহার

পরিশেষে বলা যায়, বৌদ্ধধর্মের ইতিহাসে প্রসেনজিতের স্থান অতি উচ্চে। তাঁর পৃষ্ঠপোষকতায় বৌদ্ধধর্ম কোসল রাজ্যে বিস্তৃতি লাভ করে। তিনি সুশাসকের পাশাপাশি বুদ্ধের একজন একনিষ্ঠ ভক্ত ছিলেন। সুতরাং, বৌদ্ধধর্মের প্রচার, প্রসার, বুদ্ধ ও ভিক্ষুসংঘের সেবা, সুশাসন এবং মহতী দানকর্মের জন্য রাজা প্রসেনজিৎ বৌদ্ধধর্মের ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন।

Related Posts