কুষাণ রাজবংশের শ্রেষ্ঠ নৃপতি ছিলেন কণিষ্ক। কণিষ্কের রাজত্বকাল ভারতের ইতিহাসে এক গৌরবময় অধ্যায়।তার রাজত্বকালে একদিকে যেমন কুষাণ সাম্রাজ্য বিস্তৃত হয়েছিল তেমনি অন্যদিকে সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে এদেশ উন্নতির চরম শিখায় আরোহন করেছিল। কণিষ্কের আমলে ভারতে কুষাণ সাম্রাজ্য গঙ্গা-যমুনা উপত্যকা থেকে উত্তর পশ্চিম ভারত হয়ে মধ্য এশিয়া পযর্ন্ত বিস্তৃত ছিল। এই বিশাল ভূ-ভাগ কুষাণদের হস্তগত হওয়ার পর ভারতে শিম্র সভ্যতা সূচনা হয়। মৌর্যদের শাসনের পর ভারতে যে অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছিল কণিষ্ক তা দূর করে ভারতে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেন।
কণিষ্কের পরিচয়
কণিষ্ক ছিলেন কুষাণ বংশের শ্রেষ্ঠ সম্রাট।কুষাণ বংশের শ্রেষ্ঠত্ব এবং ভারতের ইতিহাসে কুষাণ বংশের গুরুত্ব তাঁর কার্যকলাপের দ্বারাই অর্জিত হয়েছিল। বিম কদফিসেসের মৃত্যুর পর কণিষ্ক সিংহাসনে বসেন। তবে অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন যে,কণিষ্ক কদফিসেস রাজাদের পূর্বেই সিংহাসনে বসেছিলেন। কণিষ্কের সিংহাসনে আরোহনের তারিখ নিয়ে বিভিন্ন ঐতিহাসিক বিভিন্ন মত প্রকাশ করেছেন।
ড. ফ্লিট মনে করেন , কণিষ্ক ৬৮ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে সিংহাসনে বসেছিলেন এবং একটি সম্বতের প্রচলন করেছিলেন।যা পরবর্তীকালে বিক্রম সম্বৎ নামে পরিচিতি লাভ করে।
অ্যালানের মতে, কণিষ্কের স্বর্ণমুদ্রা রোমান মুদ্রা দ্বারা প্রভাবিত ছিল। সুতরাং কণিষ্কের রাজত্বকালকে রোম সম্রাট টিটাস (৭৭-৮১ খ্রি:) এবং ট্রাজানের (৯৮- ১১৭খ্রি:) আগে স্থান দেওয়া অনুচিত মনে হয়।
মার্সাল, স্টেনকোনো, স্মিথ প্রমূখ পন্ডিত মনে করেন যে, কণিষ্ক ১২৫-১২৯খ্রি: মধ্যে তাঁর রাজত্ব শুরু করেছিলেন।
আরও পড়ুন: অশোকের শিলালিপি সম্পর্কে বর্ণনা দাও
কণিষ্কের রাজ্য বিস্তৃতি
কণিষ্ক যখন সিংহাসনে আরোহন করেন তখন তার রাজ্য আফগানিস্তান, সিন্দু ও পান্জাব নিয়ে গঠিত ছিল। তিনি কাশ্মির জয় করে স্বীয় সাম্রাজ্য ভূক্ত করেন।
পাটলিপুত্র দখল ও রাজধানী স্থানান্তর: চৈনিক ও তিব্বতীয় কিংবদন্তী অনুসারে কণিষ্ক মগধ আক্রমণ করে পাটলিপুত্র দখল করেন। বৌদ্ধ কিংবদন্তী অনুসারে কণিষ্কের পাটলিপুত্র দখলের সময় বৌদ্ধ দার্শনিক অশ্বঘোষ কণিষ্কের হাতে বন্দি হন। পরবর্তী দীর্ঘকাল তিনি কণিষ্কের রাজসভা অলংকৃত করেন। হিউয়েন সাং এর মতে, কণিষ্ক গান্ধারকে স্বীয় সাম্রাজ্যভূক্ত করেন এবং তার রাজধানী পেশোয়ারে স্থাপন করেন।
কণিষ্কের ধর্মমত
বৌদ্ধ গ্রন্থ থেকে জানা যায় যে,কণিষ্ক বৌদ্ধ ধর্মালম্বী ছিলেন। বৌদ্ধ গ্রন্থাকারদের মতে, বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করার পূর্বে কণিষ্কের কোন বিশেষ ধর্ম বিশ্বাস ছিল না।কিন্তু এ মতবাদ গ্রহণযোগ্য নয়। বস্তুত: বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করার পূর্বে কণিষ্ক বহু দেব-দেবীতে বিশ্বাসী ছিলেন।
কণিষ্কের কৃতিত্ব
মৌর্য সাম্রাজ্যের পতনের পর প্রতিষ্ঠিত কুষাণ সাম্রাজ্যের অন্যতম নৃপতি ছিলেন কণিষ্ক। নিম্নে তার কৃতিত্ব সমূহ আলোচনা করা হল:
রাজনৈতিক ঐক্য ও সাম্রাজ্য স্থাপন: পৈতৃক বা উত্তরাধিকার সূত্রে রাজ্য পাওয়ার পর ও কণিষ্ক নিজস্ব শক্তি বলে তার রাজ্যের বিস্তৃতি ঘটান। কার রাজত্বকালে কুষাণরা তাদের রাজ্যকে সাম্রাজ্যে পরিণত করে। কণিষ্কের সময় রাজ্য পশ্চিমে খোরাসান থেকে পূর্বে বিহার এবং উত্তরে খোটান থেকে দক্ষিণে কোন্ধক পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল।কণিষ্কের পূর্বে কোন ভারতীয় নৃপতি মধ্য এশিয়ায় এত বিস্তীর্ণ অঞ্চলে কখনও সাম্রাজ্য বিস্তার করতে পারেনি। কণিষ্কের নেতৃত্বে এশিয়ার এক বিশাল ভূখন্ড জুড়ে বহুভাষাভাষী ও বহুজাতিক এক সংমিশ্রিত সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়। এর ফলে জাতিগত ও দেশগত ব্যবধান সত্ত্বেও ভারতের সঙ্গে মধ্য এশিয়ার এক বিচিত্র যোগসূত্র স্থাপিত হয়।
সুদক্ষ শাসক: কণিষ্ক ছিলেন একজন শ্রেষ্ঠ শাসক। প্রজাদের মঙ্গল সাধনই ছিল তার শাসনের লক্ষ্য।সাম্রাজের শান্তি ও স্থিতিশীলতা রক্ষায় তিনি দক্ষতার পরিচয় দেন। সাম্রাজ্যের পূর্ব প্রদেশগুলোর ক্ষত্রপ ও মহাক্ষত্রপ উপাধি দ্বারা রাজকর্মচারীদের মাধ্যমে শাসন হতো।
বৈদেশিক সম্পর্ক: কণিষ্কের আমলে বাইরের দেশগুলির সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক উন্নত হয়ে উঠে।বিশেষত ভারত-চীন ও ভারত-রোম সম্পর্কের উন্নতি ঘটে। এর পাশাপাশি জাপান, মিশর ও গ্রীসের সঙ্গেও ভারতের ঘনিষ্ট সম্পর্ক গড়ে ওঠে।
ধর্মীয় উদারতা: কণিষ্ক বৌদ্ধ ধর্মালম্বী হওয়া সত্ত্বেও তিনি গ্রীক, পারসিক,ভারতীয় ,সুমেরীয় প্রভৃতি দেবতাদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। তার সময়ে মুদ্রায় সকল দেবতাদের দৃশ্য অঙ্কন করে এদের যথার্থ মূল্যায়ন করেছিলেন।
শিল্প ও সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষকতা: কণিষ্ক শিল্প ও সাহিত্যের একজন বড় পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। বসুমিত্র,নাগার্জুন, অশ্বঘোষ, প্রমূখ বৌদ্ধগ্রন্থ রচয়িতাগণ কণিষ্কের রাজসভা অলংকৃত করেছিলেন।তার উদ্যোগে এসময়ে সংস্কৃত ভাষা হারানো গৌরব ফিরে পায়। সংস্কৃত ভাষাকে সাহিত্য ও ধর্মনিরপেক্ষ ভাষা হিসেবে গ্রহণ করায় এ সময় উৎকৃষ্ঠ মানের অনেক সংস্কৃত গ্রন্থ রচিত হয়। তার পৃষ্ঠপোষকতায় অশ্বঘোষ এ সময় বুদ্ধচরিত ও বজ্রসূচী গ্রন্থ রচনা করেন। নাগার্জুন রচনা করেন মাধ্যমিকা সূত্র ও প্রজ্ঞাপিারমিতা শত সহস্রিকা গ্রন্থ,চরক রচনা করেন চরক সংহিতা,সুশ্রুতরচনা করেন সুশ্রুত সংহিতা ইত্যাদি।
স্থাপত্য শিল্পের পৃষ্ঠপোষকতা: কণিষ্কের আমলে গ্রীক রোমান ভারতীয় শিল্পকলার অপূর্ব মিশ্রনে গান্ধার শিল্পের সৃষ্টি হয়। এই শিল্পের উল্লেখযোগ্য দিক হলো গ্রীক দেবতা প্র্যাপেলো, জিউস প্রভৃতি প্রতিকৃতি অনুকরণে বৌদ্ধমূর্তি নির্মাণ।
গান্ধার শিল্প: কণিষ্কের রাজত্বকাল থেকে ভারতীয়দের সাথে গ্রীক ও পাশ্চাত্য সভ্যতার যে সংমিশ্রণ ঘটেছিল তার পরোক্ষ ফলাফল হলো গান্ধার শিল্প। গান্ধার অঞ্চলে গ্রীক, রোমান ও বৌদ্ধ শিল্পের মিলনের মাধ্যমে এটি গড়ে উঠেছিল। এ শিল্পের প্রভাবে এ অঞ্চলে তখন অত্যন্ত সুদর্শন মূর্তি তৈরি হত।
বৌদ্ধধর্মের পৃষ্ঠপোষকতা: কণিষ্ক রাজ্যবিজেতা হিসেবে স্বীকৃত হলেও বৌদ্ধধর্মের পৃষ্ঠপোষক হিসেবে তিনি সমধিক পরিচিত। তার সময়ে বৌদ্ধধর্মের এক বিরাট বিবর্তন ঘটে। তিনি বৌদ্ধ সম্প্রদায় গুলোর মধ্যে ঐক্য ও সংহতি স্থাপন করে বিভিন্ন বৌদ্ধস্তুপ ও চৈত্য স্থাপনের মাধ্যমে বৌদ্ধধর্মকে পুনরুজ্জীবিত করেন। এছাড়া তিনি বৌদ্ধধর্মের মধ্যে মহাযান মতবাদ প্রবর্তন করেন।
কুষাণ সাম্রাজ্যের ভারতীয়করণ: কণিষ্ক তার রাজত্বকালে কুষাণ সাম্রাজ্যকে ভারতীয়করণ করেন।সমস্ত রাজ্যে সঠিকভাবে নজরদারীর জন্য তিনি তার রাজধানী পেশোয়ারে স্থাপন করেন। এভাবে কণিষ্ক তার সাম্রাজ্যকে ভারতীয় চরিত্র দান করেন।
আরও পড়ুন: অশোক কে ছিলেন? তিনি কিভাবে বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করেন?
কণিষ্কের মূল্যায়ন
কণিষ্ক ভারতের ইতিহাসে একজন বিখ্যাত রাজা।বিভিন্ন কারণে তিনি খ্যাতির শীর্ষে ছিলেন। তিনি একাধারে বিজয়ী রাজা,বৌদ্ধধর্মের পৃষ্ঠপোষক, শিল্পসিাহিত্য ও ভাস্কর্কযর উৎসাহদাতা।
তিনি বৌদ্ধধর্মের বিভেদ দূর করে প্রসার ও জনপ্রিয় করে তোলেন। তিনি কেবল কুষাণ বংশের শ্রেষ্ঠ রাজা ছিলেন না ভারতের ইতিহাসে অন্যতম শ্রেষ্ঠরাজাগণের মধ্যে একজন ছিলেন।
উপসংহার
উপরিউল্লিখিত আলোচনা হতে বলা যায, কণিষ্ক ছিলেন প্রাচীন ভারতের শ্রেষ্ঠ শাসকদের মধ্যে অন্যতম এবং বহিরাগত ভারতীয় শাসকদের মধ্যে শ্রেষ্ঠতম। কেবল সাম্রাজ্যের সংগঠন নয় সুশাসন, শিল্পসাহিত্য ও সংস্কৃতির বিকাশের মাধ্যমে সেই সাম্রাজ্য এক পরিপূর্ণতা লাভ করেছিল কণিষ্কের কৃতিত্বে।
টাইপিং সহযোগিতায়: মানিকা চাকমা (চবি)