Home » অনিত্য শব্দের অর্থ কি? বৌদ্ধ দর্শন কি অনিত্য দর্শন? – ব্যাখ্যা কর

অনিত্য শব্দের অর্থ কি? বৌদ্ধ দর্শন কি অনিত্য দর্শন? – ব্যাখ্যা কর

by TRI

ভূমিকা

মহামানব গৌতম বুদ্ধের বাণী ও উপদেশের উপর ভিত্তি করে জগৎ ও জীবন সম্পর্কে যে মতবাদ গড়ে উঠেছে সেই মতবাদই “বৌদ্ধ দর্শন” বা “ বৌদ্ধ ধর্ম”। ত্রিপিটক হল বুদ্ধবাণী। মানবের দুঃখ – মুক্তির পথ প্রদর্শনই এ মহান বানীর মুখ্য উদ্দেশ্য। এটা কোন কল্পিত মুক্তি নয় অথবা প্রত্যাদেশও নয়। এটা মহান গৌতম বুদ্ধের অধিগত মুক্তি, এটা সম্পূর্ণ তারই অভিজ্ঞতা প্রসূত। নিরীশ্বরবাদ ও অনাত্মবাদ বৌদ্ধ দর্শনের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বুদ্ধের কোন মৌলিক শক্তি ঈশ্বর বা অদৃষ্টবাদ এর উপর আস্থা ছিল না কারো উপর নির্ভর না করে নিজ প্রচেষ্টায় দুঃখ কষ্ট দূর করার উপর বুদ্ধ জোর দিয়েছিলেন। বৌদ্ধধর্ম মতে, এ জগত ত্রিলক্ষণাত্মক- অনিত্য, দুঃখ ও অনাত্ম।

অনিত্য শব্দের অর্থ

অনিচ্চা বা অনিত্য শব্দের অর্থ অস্থায়ী, নশ্বর, যা নিত্য নয়। পরিবর্তনশীলতাই অনিত্যতা। ইহা বস্তুজগতের সকল সত্ত্বার অপরিহার্য বৈশিষ্ট্য। জীব-জড়-জৈব-অজৈব কোনো কিছুকেই আমরা চিরস্থায়ী বলতে পারি না। সকলের ক্ষেত্রে ইহা সত্য। মানুষের ক্ষেত্রেতো বটেই। মানুষের জন্য ইহা যেমন সত্য, তেমনি আমাদের চারপাশে দৃশ্যমান যা কিছু আছে প্রত্যেকটি বস্তুর জন্যও তা সমানভাবে সত্য। কোনো জিনিসই চিরকাল স্থায়ী হয় না। সবকিছুই নশ্বর। সবকিছুই নিয়ত অন্যরূপে রূপান্তরিত হচ্ছে কিংবা ধ্বংস হচ্ছে। হয়তো ধ্বংসের পর পুনরায় সৃষ্টি হচ্ছে। আসলে জগতের কোনো কিছুই নিত্য নয়- সবকিছুই অনিত্যতার অধীন।

আরও পড়ুন:

চৈতসিক বলতে কি বুঝ? চৈতসিক কত প্রকার ও কি কি? সর্বচিত্ত সাধারণ চৈতসিক কত প্রকার ও কি কি?

ব্রহ্মজাল বলতে কি বুঝায়? ব্রহ্মজাল সূত্রের গুরুত্ব আলোচনা কর।

শ্রামণ্যফল বলতে কি বুঝ? শ্রামণ্যফল সূত্রের গুরুত্ব আলোচনা কর

বৌদ্ধ দর্শন অনিত্য দর্শন কিনা

বৌদ্ধ দর্শনের অন্যতম প্রধান গুরুত্বপূর্ণ বিষয় অনিত্যবাদ। সকল জীবের জীবন বা অস্তিত্বের অপর দুটি প্রধান বৈশিষ্ট্য দুঃখ এবং অনাত্ম এর মূল ভিত্তি। অনিত্য-দুঃখ-অনাত্ম এই ত্রি-লক্ষণ একই সূত্রে গ্রথিত। অনিত্যসত্যের প্রকৃত অর্থ হলো বিশ্বজগত স্থির নয়; নিয়ত গতিশীল। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সবকিছুই পরিবর্তনশীল। আধুনিক বিজ্ঞানীরাও দ্বিধাহীনভাবে বিশ্বজগতের এই মৌলিক প্রকৃতিকে মেনে নিয়েছেন। গতিশীল জগৎ-সংসারের সবকিছুই অনিত্যÑ তথাগত বুদ্ধ এ শিক্ষা মানবজাতিকে দিয়েছেন। এই পরম সত্যের উপর ভিত্তি করে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড তার আপন গতিপ্রবাহে চলমান। মানব- সভ্যতার কথা ধরলেও এ সত্য উপলব্ধ হয়। তবে মানুষের বস্তুগত অর্জনের ক্ষেত্রে তথা বস্তুজগতের ক্ষেত্রে এ পরিবর্তনশীলতা বেশি কার্যকর।

জীবনের তিনটি অপ্রতিরোধ্য সত্য হলো অনিত্য, দুঃখ ও অনাত্ম। এ বিষয়গুলো আমাদের কাছে আপাতভাবে দৃশ্যমান নয়। কিন্তু এগুলোর প্রকৃত স্বরূপ তথাগত সম্যক সম্বুদ্ধ আমাদের সামনে উপস্থাপন করেছেন। অনিত্য-দুঃখ-অনাত্ম এই তিনের সম্যক উপলব্ধিতে প্রকৃত মুক্তি অর্জন সম্ভব। এই তিনের প্রকৃত অনুধাবনই হচ্ছে বুদ্ধের মহান শিক্ষা। অনিত্যদর্শন বুদ্ধের ধর্মদর্শন তথা বৌদ্ধদর্শনের মৌলিক বিষয়াবলির অন্যতম। বুদ্ধ বলেছেন- সব্বে সংখারা অনিচ্চা’ তি যদা পঞঞায় পস্সতি অথ নিব্বিন্দতি দুকেখ এস মগ্গো বিসুদ্ধিয়া। কার্য-কারণ এর অধীন এ জগতের সকল সংস্কার অনিত্য- একথা যদি প্রজ্ঞাদৃষ্টিতে দেখা যায় তাহলে দুঃখ থেকে মুক্তি লাভ করা সম্ভব। বস্তুত অনিত্যদর্শন বিশুদ্ধির মার্গ। ব্যবহারিক ও আধ্যাত্মিক উভয় দৃষ্টিকোণেই ইহা বাস্তব আমাদের ব্যবহারিক জীবনের প্রতিটি ঘটনা বিচার-বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় কোনো জিনিসেরই শাশ্বতকাল ধরে স্থায়িত্ব নেই। সব অস্তিত্বের পরিবর্তন ঘটছে নিয়ত। মানুষ, পশু- পাখি, কীটপতঙ্গ, বৃক্ষ-গুল্ম, লতাপাতা, তৃণ, জড়- চেতন সব সত্তাই প্রতি মুহূর্তে এক অবস্থা থেকে অন্য অবস্থায় পরিবর্তিত হচ্ছে। একটি বৃক্ষ বীজ থেকে চারা, চারা থেকে পূর্ণাঙ্গ গাছ, গাছ থেকে ফুল ও ফল ধরা পর্যন্ত কত ধরনের পরিবর্তন হয়! তবে সে পরিবর্তন আমরা তাৎক্ষণিক বুঝতে পারি না। পরিবর্তন কিন্তু থেমে নেই। ইহা প্রতি মুহূর্তে ঘটে চলেছে। জগতের সকল বস্তু বা জিনিসের ক্ষেত্রে অনিত্যতা প্রযোজ্য হলেও বুদ্ধ প্রাণীর ক্ষেত্রে এর প্রয়োগ এবং উপলব্ধির উপর গুরুত্বারোপ করেছেন বেশি। প্রাণীর জীবনের ক্ষেত্রে অনিত্যতার প্রয়োগ নিয়ে বেশি তৎপর হয়েছেন। বিশ্বচরাচরের সবকিছুই বিলয়ধর্মীÑ এ সত্য আবিষ্কার করতে গিয়ে বুদ্ধ উদঘাটন করেছেন মানবজীবনের আসল রহস্য। বুদ্ধের মতে মানবজীবন পঞ্চস্কন্ধ নিয়ে গঠিত। পঞ্চস্কন্ধ হলো রূপ, বেদনা, সংজ্ঞা, সংস্কার ও বিজ্ঞান। বুদ্ধ বলেছেন- এই পঞ্চস্কন্ধই অনিত্য। দীর্ঘনিকায়ের মহাসতিপটঠান সূত্রে ইহা উল্লিখিত হয়েছে। রূপ, বেদনা, সংজ্ঞা, সংস্কার ও বিজ্ঞান উৎপন্ন হয়ে বিলীন হয়।

মহাপরিনির্বাণ সূত্রে উল্লেখ আছে, সংস্কার সমূহ উৎপত্তি ও বিনাশশীল। উৎপন্ন হয়ে তারা নিরুদ্ধ হয়। তাদের উপর আসক্তি ও মোহকে উপশম করতে পারলেই প্রকৃত সুখ। অঙ্গুত্তর নিকায়ে বুদ্ধ বলেছেন, হে ভিক্ষুগণ! কিছুই চিরস্থায়ী নয়, সংস্কারসমূহ অনিত্য, অধ্রুব, অসুখ- এটা জেনে এতে বিরাগ উৎপাদন করা উচিত, উহা হতে বিবিক্ত ও বিমুক্ত হওয়া উচিত।’ আপাতদৃষ্টিতে কোনো কিছুকে স্থায়ী মনে হলেও প্রকৃতপক্ষে তা উদয় ও বিলয়ধর্মী। সবকিছুই প্রতীত্যসমুৎপন্ন- কার্যকারণ শৃঙ্খলায় দ্বারা যুক্ত। কারণ বিনা কার্য হয় না। কোনো কারণই ধ্রুব নয়। অনিত্যদর্শন তথা অনিত্যতার তত্ত্ব অনুসারে এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডেরও শেষ আছে। সংযুক্ত নিকায়ে বলা হয়েছে- ধৰ্ম্মং যং ভূতং তং নিরোধ- যা উৎপন্ন হয়েছে তা নিরোধধর্মী। জড়-জীব কেউ এ নিয়মের বাইরে নয়।

গ্রিক দার্শনিক হেরাক্লাইটাস পৃথিবীর অন্তহীন পরিবর্তনে বিশ্বাস করতেন। তাঁর পরিবর্তনশীলতার একটি মতবাদও রয়েছে। হেরাক্লাইটাস এর মতে বিশ্বজগতের সবকিছুই পরিবর্তনশীল। তিনি মনে করেনÑসবকিছুই প্রবাহিত হচ্ছে। বুদ্ধের অনিত্যদর্শনের সাথে হেরাক্লিটাসের মতবাদের যথেষ্ট সাযুজ্য লক্ষণীয়। জগতের নশ্বর ধর্মের কথাই গ্রিক দার্শনিকের মতবাদে প্রতিধ্বনিত হয়েছে। মরমীবাদী দার্শনিকগণ স্বীকার করেন- কালের মধ্যে বিদ্যমান অর্থাৎ সময়ের আবর্তে বিরাজমান সবকিছুই নশ্বর- অনিত্য। এগুলো বৌদ্ধদর্শনের অনিত্যবাদেরই নামান্তর।

উপসংহার

উপরিউক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, বুদ্ধদর্শনই অনিত্য দর্শন। পৃথিবীর সবকিছুই অনিত্য বা পরিবর্তনশীল। এই পরিবর্তনশীলতা ও নশ্বরতাকে রুখবার সাধ্য কারো নেই। কাজেই আমরা সবাই অনিত্যতার অধীন। ইহা আমাদের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা। এই প্রত্যজ্ঞ অভিজ্ঞতার মাধ্যমেই প্রমাণিত হয় – জগতের সকল ক্ষেত্রে অনিত্যতা বিরাজমান। সব সত্তাই অশাশ্বত, সবকিছুই ক্ষণস্থায়ী, সবকিছু একটা নির্দিষ্ট সময়কালের। জড় জীব সবার জন্য এ সত্য প্রযোজ্য।

Related Posts