ব্রহ্মজাল সূত্র দীর্ঘ নিকায়ের প্রথম সূত্র। এটা শীলস্কন্ধ বর্গেরও প্রথম সূত্র। বৌদ্ধ ধর্মের ইতিহাসে এ সূত্রের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। এতে বুদ্ধ তথাগত একদিকে যেমন তার ধর্মের অন্যতম বিষয় শীল, সমাধি ও প্রজ্ঞার আলোচনা করেছেন, অন্যদিকে তেমনি প্রাচীন ভারতীয় দর্শন, ধর্ম সম্প্রদায় ও তাদের ৬২ প্রকার দৃষ্টির অসারত্ব প্রমাণ করেছেন। এসব দৃষ্টি দ্বারা সম্যক জ্ঞান লাভ সম্ভব নয়। এগুলো মিথ্যাদৃষ্টির নামান্তর। একারনে এর নামকরণ করা হয়েছে ব্রক্ষ্মজাল সূত্র।
ব্রহ্মজাল অর্থ
ব্রহ্মজাল শব্দের অর্থ অর্থজাল, ধর্মজাল, দৃষ্টি জাল অথবা অনুত্তর সংগ্রাম বিজয়। এ প্রসঙ্গে রীচ ডেভিডস বলেন ব্রহ্মজাল শব্দের অর্থ উত্তমজাল, পরিপূর্নজাল অথবা পরিশুদ্ধ জাল। যে জালের ছিদ্রগুলি এতই সূক্ষ্ম ও ঘন যে ছোট বড় কোন মাছ তা হতে বের হয়ে যেতে পারে না। তথাগত বুদ্ধের উপদেশ ও বাণীগুলো ব্রহ্মাজাল সদৃশ। যে ধর্মোপদেশ ও বাণীগুলোর মাধ্যমে মানুষের জীবনের ব্যাপক পরিবর্তন সাধিত হয় এবং নিবান লাভের হেতু উৎপন্ন হয়।
আরও পড়ুন:
শ্রামণ্যফল বলতে কি বুঝ? শ্রামণ্যফল সূত্রের গুরুত্ব আলোচনা কর
দীর্ঘ নিকায়ের পরিচয় দাও। বুদ্ধের ধর্ম প্রচারে দীর্ঘ নিকায়ের ভূমিকা তুলে ধর
পুদগল শব্দের তাৎপর্য ব্যাখ্যা কর। পুদগলের বিশেষত্ব সম্পর্কে আলোচনা কর
ব্রহ্মজাল সূত্রের গুরুত্ব
ব্রক্ষ্মজাল সূত্রে প্রাচীন ভারতের বহু নিদর্শন পাওয়া যায়। এতে শীল, সমাধি, প্রজ্ঞা ছাড়া প্রাচীন ভারতীয় দর্শন ও ধর্ম সম্প্রদায় সম্পর্কে বিস্তৃতভাবে আলোচনা করেছেন। বুদ্ধ তার দর্শন সর্ম্পকে আলোচনা করার পূর্বে তৎকালীন প্রচলিত ধর্মমত সমূহের পরিচয় ও তার সাথে বৌদ্ধ দর্শনের পার্থক্য নিরুপন করার প্রয়াস পেয়েছেন। সে সময়ে প্রচলিত ধর্মমত সমূহকে বুদ্ধ ৬২ প্রকার দৃষ্টিতে বিভক্ত করেছেন। সে দৃষ্টিসমূহকে আট ভাগে ভাগ করা যায়। যথাঃ- ১. শাশ্বতবাদ, ২. একাংশ শাশ্বত ৩.অন্তানন্তিক, ৪.অমরা বিক্ষেপিকা, ৫.অধিচ্ছ সমুপ্পন্নিকা, ৬.উর্দ্ধমাঘনিকা, ৭.উচ্ছেদবাদ, ৮.দৃষ্টধর্ম নিবার্ণবাদ।
১.শাশ্বতবাদ: এ সূত্রানুসারে শাশ্বতবাদ চার প্রকার। যথা- আত্মা নিত্য, ধ্রুব, শাশ্বত ও অপরিবর্তনশীল।শাশ্বরবাদীদের মতে জগতের বস্তু সমূহ অনিত্য, কালে মানুষের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ জীব জগৎ সব ধ্বংস হয়ে যায়। কিন্তু আত্মার ধ্বংস নেই। জন্ম মৃত্যু প্রভৃতি সর্বপ্রকার পরিবর্তনের মধ্যে এটা অপরিবর্তনীয়। এটি অচঞ্চল পর্বতশৃঙ্গ অথবা দৃঢ়ভাবে প্রোথিত স্তম্ভের ন্যায় সুদৃঢ়। এ সূত্রে বলা হয়েছে দুটি কারণে শাশ্বতবাদীগণ একমত পোষন করেন। প্রথমত: প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা এবং দ্বিতীয়ত: যুক্তি বা তর্কের খাতিরে। প্রথমোক্ত যুক্তির ভিত্তি এক প্রকার যৌগিক অনুভূতি, যোগী দীর্ঘদিন ধ্যানানুশীলনের পর চিত্তে একাগ্রতার উৎপন্ন হয়। একাগ্রচিত্তে বার বার অনুশীলনের দ্বারা যোগী তার পূর্বজন্ম বৃত্তান্ত ধারন করতে সক্ষম হন।
২.একাংশ শাশ্বত: এটা চার প্রকার। এর ভিত্তিও যৌগিক অভিজ্ঞতা। এই বাদীদের মতে, তিন প্রকার দেবতার মধ্যে এক প্রকার দেবতা নিত্য, শাশ্বত ও অপরিবর্তনশীল। অপর সকল প্রাণী পরিবর্তনশীল ও পরিনাম ধর্মী। তারা আরও বলেন কেবল চিত্ত, মন বা বিজ্ঞানই অপরিবর্তনীয়, শরীরের অন্যান্য অঙ্গ প্রত্যঙ্গ সমূহ পরিবর্তনশীল। কালচক্রে সব বিষয় বস্তুর পরিবর্তন হয়।
৩.অন্তানন্তিকবাদ: এটিও ৪ প্রকার। অন্ত ও ন-অন্ত উভয়ের সমন্বয়ে বলা হয় অন্তানন্ত। এর উৎপত্তি ৪ প্রকার রূপ ধ্যানের অভিজ্ঞতা হতে। এদের মধ্যে যারা পৃথিবীকে ধানের বস্তু হিসেবে গ্রহণ করেন, তাদের মতে পৃথিবীর আকার গোলাকার, আবার যারা উচ্চ ও নিচুকে অবলম্বন করে ধ্যান করেন, তাদের মতে পৃথিবীর আয়তন অনন্ত এবং এর উভয় পার্শ্ব বিস্তৃত। কোন কোন সময় কেবল যুক্তির খাতিরেও কেউ কেউ অন্তানন্তিকবাদের পক্ষে মত প্রকাশ করেন।
৪.অমরাবিক্ষেপিকা: এই মত ও ৪ প্রকার। সংশয়বাদের অপর নাম অমরাবিক্ষেপিকা। এ মতের অনুসারীরা ভাল-মন্দ কোনটার পক্ষে বা বিপক্ষে মত প্রকাশ করলে একদল অসন্তষ্ট হতে পারে। সঞ্জয় বেলটটি পুত্র এ মতের অনুসারী ছিলেন। কথিত আছে, অপরে আঘাত পাবে বা অপবাদ করবে এ ভয়ে তিনি কোনরুপ মন্তব্য করতেন না। এ সংশয়ের ৪টা কারণ এ সূত্রে দৃষ্ট হয়। যথা: ১ যথাযথ জ্ঞানের অভাব ২.বিদ্বেষ বা ঝগড়া বৃদ্ধির ভয়, ৩.জ্ঞানী ব্যক্তিদের দ্বারা নিন্দনীয় হবার ভয়, ৪.পান্ডিত্য অথবা অভিজ্ঞতার অভাব। বুদ্ধের মতে এদের দ্বারা পরমার্থ লাভ অসম্ভব, কারন অসত্য বা অকুশল ত্যাগ করবার মত মনোবল তাদের নেই।
৫.অধিচ্ছসমুপ্পন্নিকা: এটাকে অদৃষ্টবাদও বলা যায়। বুদ্ধঘোষ এটাকে অকরণ সমুৎপাদ বা যছচ্ছা সমুৎপাদ নামেও অভিহিত করেছেন। এটা প্রতীত্য সমুৎপাদের বিপরীত দর্শন। এই মতবাদীদের মতে জগৎ সৃষ্টির কোন কার্যকারণ সম্পর্ক নেই। অহেতু বা অকারণ বশতঃ এটা উৎপন্ন হয়েছে। কিন্তু বুদ্ধের মতে কোন বস্তু অকারণ সম্ভূত নয়, প্রতীত্য সমুৎপাদের মূল বক্তব্য ইহার কারণে উহা হয়। ইহার উৎপত্তিতে উহা উৎপন্ন হয়। ইহার অভাবে উহা হয় না, ইহার বিনাশে উহা বিলুপ্ত হয়।
৬.উর্ধ্বমাঘতনিকা: এটা ৩২ প্রকার। এই ৩২ প্রকারকে আবার ৩ ভাগে ভাগ করা যায়। ১.সংজ্ঞীবাদ (১৬ প্রকার), ২.অসংঙ্গীবাদ (৮ প্ৰকার) এবং ৩.নৈবসংজ্ঞা না সংঙ্গীবাদ (৮ প্রকার)। বুদ্ধ ঘোষের মতে আঘতন শব্দের অর্থ মৃত্যু, চ্যুতি বা লয়। অতএব, উর্ধ্বমাঘতন শব্দের অর্থ মৃত্যুর পর আত্মার সহিত সম্পর্কযুক্ত কোন অবস্থা বা মত।
মতসমূহ নিম্নরূপ: কারো কারো মতে মৃত্যুর পর আত্মা সংজ্ঞাযুক্ত থাকে, এর কোন পরিবর্তন হয় না। এরা বলেন, আত্মা ১.রূপী, ২.অরূপী, ৩.রুপী- অরুপী, ৪.রুপীও নয়, অরুপীও নই।
৭.উচ্ছেদবাদ: উচ্ছেদ মানে ধ্বংস বা অস্তিত্বের বিলোপসাধন। অজিত কেশ কম্বলী এ মতের পরিপোষক ছিলেন। ভারতের সমস্ত প্রকার দার্শনিক মতই ধান প্রাপ্তির উপর ভিত্তি করে প্রচারিত। উচ্ছেদবাদ নীতিতে এর কোন ব্যতিক্রম নেই। তাদের মতে, পাপ-পুণ্যের কোন ভেদ নেই। ভালমন্দ কেবল ইহলোকে সুখে স্বাচ্ছন্দ্যে থাকার জন্য। মৃত্যুর পর মানুষের কোন অস্তিত্ব থাকে না। এ সূত্রে ৭ প্রকার উচ্ছেদবাদের উল্লেখ দৃষ্ট হয়। কেউ কেউ বলেন মৃত্যুর পর আর কোন জন্ম নেই, আবার কেউ কেউ বলেন মৃত্যুতে সবকিছু শেষ নয়, কর্ম বিপাক শেষ না হওয়া পর্যন্ত মানুষকে জন্ম-মৃত্যুর অধীন হতে হয়। কর্ম বিপাক শেষ হলে মানুষ মুক্ত হয়।
৮.দৃষ্টধর্ম নির্মাণবাদ: ইহ জীবনে নির্বান লাভকে দৃস্ট ধর্ম নিবার্ণবাদ বলা হয়। তাদের মতে মানুষ ইহ জীবনে নির্বাণ লাভ করতে পারে। এ সূত্রে ৫ প্রকার দৃষ্ট ধর্ম নির্বানের উল্লেখ দৃষ্ট হয়। জাগতিক ভোগ সুখের পূর্ণমাত্রায় তৃপ্তি সাধনই প্রথম প্রকার নির্বাণ। অপর ৪ প্রকার নির্বাণের সাথে জাগতিক ভোগ সুখের সম্পর্ক খুব কম। প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় চতুর্থ ধ্যানারুঢ় ব্যক্তিই এটা থাকে সমর্থ।
ভগবান বুদ্ধ বলেছেন, লোকচিন্তা ভিক্খবে অচিন্তেয্য, ন চিন্তে তব্বো মানি চিন্তে, না উম্মদস্স বিঘাতস্স ভাগী অস্স। অর্থাৎ হে ভিক্ষুগণ! লোকচিন্তা বা জগৎ সম্বন্ধে চিন্তা করা উচিত নয়। কারন এটা অচিন্তনীয় ব্যাপার।
উপসংহার
পরিশেষে বলা যায় ব্রক্ষ্মজাল সূত্রের গুরুত্ব অপরিসীম। এই ব্রহ্মজাল ৬২ প্রকার ধারণা বা মতবাদ মিথ্যাদৃষ্টির কারণ। শীল, সমাধি ও প্রজ্ঞার অসম্পূর্ণতার হেতু তারা বিবিধ দৃষ্টি-দীপক বাক্য দ্বারা আত্মা, জগৎও লোককে শাশ্বত ঘোষনা করেন। কারা পঞ্চ কামগুন সম্পন্ন বলে তাদের দৃষ্টি অবিশুদ্ধ। বুদ্ধ প্রবর্তিত আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গই নির্বাণ লাভের প্রকৃষ্ট উপায়।