ব্রহ্মজাল সূত্রের মত দীর্ঘ নিকায়ের দ্বিতীয় সূত্র শ্রামণ্যফল সূত্র। মগধরাজ অজাতশত্রুর মনে শ্রামণদের লভ্য দর্শনীয় ফল সর্ম্পকে প্রশ্ন উৎপন্ন হলে তিনি উত্তরের আশায় একে একে পূরন কশ্যপ, মক্খলি গোসাল, অজিত কেশকম্বলী, পকুধ কাচ্চায়ন, নিগ্রন্থ নাথপুত্র ওসঞ্জয় বেলটটি পুত্রের নিকট গমন করেন। কিন্তু কোন সদুত্তর না পেয়ে অবশেষে জীবকের পরামর্শে বুদ্ধের নিকট গমন করে বুদ্ধের কাছ থেকে কাঙিখত প্রশ্নের যথাযথ উত্তর লাভ করেন। তখন বুদ্ধ শ্রামণ্যফল সূত্র দেশনা করেন।
শ্রামণ্যফল এর অর্থ
সাংদৃষ্টিক অর্থে স্বয়ং দৃষ্ট বা দর্শনীয়। অর্থাৎ ইহ জীবনে প্রত্যক্ষ ফলদায়ক। বুদ্ধ শিষ্যদের ত্যাগী জীবনকে বলা হয় শ্রামণ্য বা শ্রমণ জীবন। কোন ভিক্ষু বা শ্রমণ এই জীবন গ্রহণের দ্বারা যে সকল উপকার বা ফল প্রাপ্ত হন সে সব ফল প্রাপ্তিকে সাংদৃষ্টিক শ্রামণ্য ফল বা দর্শনীয় শ্রামণ্য ফল বলা হয়। যেমন, যে কোন শিল্পবিদ্যা গ্রহণকারী প্রত্যক্ষ জীবনে স্বয়ং দর্শনীয় ফল প্রাপ্ত হয়। যা দ্বারা সে নিজেকে সুখী ও শক্তিশালী করে এবং পিতামাতা অথবা স্ত্রীপুত্রাদির ভরন পোষণ। শ্রামণদের সেবা বা ধর্মীয় কার্যাদির সম্পাদন করে। তদ্রুপ শ্রমণ বা ভিক্ষুদের জীবনে প্রত্যক্ষ প্রাপ্তিকে সাংদৃষ্টিক শ্রামণ্য ফল বলা হয়।
আরও পড়তে পারেন:
দীর্ঘ নিকায়ের পরিচয় দাও। বুদ্ধের ধর্ম প্রচারে দীর্ঘ নিকায়ের ভূমিকা তুলে ধর
পুদগল শব্দের তাৎপর্য ব্যাখ্যা কর। পুদগলের বিশেষত্ব সম্পর্কে আলোচনা কর
শ্রামণ্যফল সূত্রের গুরুত্ব
দীর্ঘ নিকায়ে শ্রামণ্যফল সূত্রে মগধরাজ অজাতশত্রুকে ভগবান বুদ্ধ ১৪ প্রকার শ্রামণ্যফলের বিবরণ দিয়েছেন। রাজাকে সম্বোধন করে ভগবান বললেন-
১.কোন দাস যদি শ্রমন হয়, তবে রাজা কর্তৃকও পূজ্য। মহারাজ! আপনার এক অনুগত ও বাধ্য কমচারীর হঠাৎ একদিন মনে হল যে, পূণ্যসমূহের বিপাক বড়ই আশ্চর্য ও অদ্ভুদ। রাজাও মনুষ্য, আমিও মনুষ্য। কিন্তু আমি রাজার দাস আর রাজা দেবতুল্য সুখ বিলাসে মত্ত ও চিন্তা গ্রহণ করে অনাগরিক প্রব্রজ্যা গ্রহণ করতঃ কায়, বাক্য ও মন সংযমতার সাথে বিহার করেন। যদি কোন সময় তাকে দেখেন আপনি কি করবেন?
ভন্তে! আমি শয়নাসন ও দুধ ও পথ্য চীবন দান আমি তাকে অভিবাদন ও শ্রদ্ধা প্রদর্শন করব এবং চর্তুপ্রত্যয় দান দ্বারা সেবা করব।
তখন বুদ্ধ রাজাকে বললেন, এটাই সাংদৃষ্টিক শ্রামণ্য ফল।
২.শ্রামণ্য ফলের উন্নত ব্যাখ্যা: কোন প্রব্রজিত কুল পুত্র চারি ঈর্ষাপথে শয়নে, গমনে উপবেশনে ও স্থিতিতে সর্বদা স্মৃতিমান থেকে পঞ্চনীবরণ প্রহীন হয়ে চিত্তকে পরিশুদ্ধ করেন। এরূপ নীবরণহীন ধ্যানমগ্ন ভিক্ষুর চিত্ত সমাধিস্ত হয় এবং তিনি প্রথম ধান লাভ করে দেহকে সবিতর্ক, সবিচার, বিবেকজ, প্রীতিসুখে অভিসিক্ত করেন। এই সাংদৃষ্টিক শ্রামণ্যফল পূর্বোক্ত শ্রামণ্যফলের চেয়ে আরও মনোহর ও উন্নততর।
৩.প্রীতি সুখ: ভিক্ষু বিতর্ক, বিচার উপশমে সম্প্রবাদী চিত্তের একাভাব আনয়ন করে অবিতর্ক, অবিচার, সমাধিজ, প্রীতি সুখে ও দেহকে অভিস্নিগ্ধ পরিপূর্ণ ও পরিস্ফুটিত করেন। এটা অন্যান্য সাংদৃষ্টিক শ্রামন্য ফল থেকে আরো মহৎ ও উন্নতর।
৪.প্রীতি ও নিরপেক্ষ সুখ: জলজ উদ্ভিদ যেমন পদ্ম ও শেওলা সরোবরে উৎপন্ন হয়ে সরোবরের জলেই সংবর্ধিত, জলানুগত এবং জলমগ্ন ও পরিস্ফুটিত করে। সেরুপ তৃতীয় ধ্যান লাভী ভিক্ষু সমগ্র দেহকে প্রীতি ও নিরপেক্ষ সুখে অভিস্নিগ্ধ, পরিস্নিগ্ধ ও পরিস্ফুটিত করেন।
৫.পরিষ্কৃত ও পরিশুদ্ধ চিত্ত: যেমন কোন ব্যক্তি পরিষ্কৃত শুভ্র বস্ত্রে আপাদমস্তক আবৃত করে উপবেশন করলে তার দেহের সমগ্ৰ অংশের কোন অংশ যেমন অনাবৃত থাকে না, তেমনি চতুর্থ ধ্যানে লাভী ভিক্ষু পরিষ্কৃত ও পরিশুদ্ধ চিত্তের দ্বারা তার সর্বাঙ্গ দেহকে আবৃত করে। তখন কোন অংশই অপরিশুদ্ধ থাকে না। যেরূপ দক্ষ কুম্ভকার মৃত্তিকা হতে ইচ্ছামত পাত্রাদি নির্মাণ করেন।
৬.বিবিধ ঋদ্ধি জ্ঞান: কোন সুদক্ষ স্বর্ণাকার সুপরিকল্পিতভাবে ইচ্ছামত স্বর্ণের অলঙ্কারাদি নির্মাণ করতে পারেন, তেমনি বিবিধ ঋদ্ধি জ্ঞান প্রাপ্ত ভিক্ষু এরূপে সমাহিত চিত্তের সেই পরিশুদ্ধ, উপকলুষ বিগত ও অনেজ্ঞাবস্থায় বহু ঋদ্ধি প্রাপ্ত হন।
৭.বিদর্শন জ্ঞান লাভ: ভিক্ষু চিত্তের সমাহিত পরিশুদ্ধ উপকলুষ বিগতাবস্থায় বিদর্শন জ্ঞানের অভিমুখে চিত্তকে নমিত করেন এবং প্রকৃষ্ট রুপে জানেন। যে তার দেহরূপী চার মহাভূত (মাটি, অগ্নি, জল, বায়ু ) মাতা পিতা সম্ভূত, অন্ন ব্যঞ্জন পু,ষ্ট পরিমর্দন স্বভাব, অনিত্য ও বিনাশশীল। চারি বিজ্ঞান সেখানেই আশ্রিত ও প্রতিবদ্ধ। এটাও সাংদৃষ্টিক শ্রামাণ্যফল।
৮.মনোময় কায় নির্মাণ: কোন ব্যক্তি কোষ থেকে অসি নির্গত করলে তার এরূপ মনে হয় এটা কোষ, এটা অসি। কোষ অন্য অসিও অন্য তেমনি মনোময় কায় সম্পন্ন প্রব্রজিতেরা চিত্তের সমাহিত, পুরিশুদ্ধ নির্মল, স্থির ও আনেজ্ঞাবস্থায় এই কায় হতে একই রূপী মনোময় অপর কায় নির্মাণ করেন। এটাও স্বীয় জীবনে উপলব্ধি শ্রামন্য ফল।
৯ দিব্য শোত্র জ্ঞান: দীর্ঘ পথচারী ব্যক্তি ভেরী মৃদঙ্গঁ শব্দ, শঙ্খ শব্দ শ্রবণ করে এটা ভেরীর শব্দ অনুরূপ দিব্য শ্রোত্র জ্ঞান লাভী ভিক্ষু সমাহিত পরিশুদ্ধ, উপক্ষেশ বিগত এবং অনেজ্ঞাবস্থায় চিত্তকে নমিত করে।
১০.চিত্ত পর্যায় জ্ঞান: কোন যুবক-যুবতী পরিশুদ্ধ স্বচ্ছ দর্শনে মুখ প্রতিবিম্বিত করে বলতে পারেন, তার মুখের উপর কোথায় দাগ পরেছে। অনুরূপ চিত্ত পর্যায় জ্ঞান লাভী ভিক্ষু পরিশুদ্ধ, উপক্লেশ বিগত ও পরচিত্ত জ্ঞান স্বচ্ছ চিত্তের দ্বারা সত্ত্বগণের ভাল মন্দ, উৎকৃষ্ট ইত্যাদি বিবিধ চিত্ত পর্যায়ের কথা বলতে পারেন।
১১.জাতিস্মর জ্ঞান লাভ: কোন ব্যক্তি স্বগ্রাম থেকে বহু গ্রাম ভ্রমণ শেষে বলতে পারেন যে, অন্য গ্রামে গিয়ে কোথায় বিশ্রাম করেছি। কার কার সাথে, কি কি বিষয়ে আলাপ হয়েছিল ইত্যাদি। ঠিক তেমনি জাতিস্মর জ্ঞান লাভী ভিক্ষু পরিশুদ্ধ সমাহিত ও উপকলুষ বিগত চিত্তের দ্বারা পূর্ব জন্মের কথা সবিস্তারে বলতে পারেন।
১২.চ্যুতি উৎপত্তি জ্ঞান: কোন চক্ষুষ্মান ব্যক্তি চতুর্থ পথের সন্ধিস্থলের প্রাসাদের উপর দাড়িয়ে বলতে পারেন যে, কোন লোক প্রাসাদে প্রবেশ করেছে, কে বের হচ্ছে, কে বা কারা কোন পথ দিয়ে গমন করেছে। ঠিক তেমনি ভিক্ষু পরিশুদ্ধ, সমাহিত ও উপকলুষ বিগত চিত্তের দ্বারা সত্ত্বগণের উৎপত্তি ও চ্যুতি সর্ম্পকে জানতে পারেন।
১৩. আসবক্ষয় জ্ঞান: কোন চক্ষুষ্মান ব্যক্তি স্বচ্ছ, প্রসন্নোদক হৃদের তীরে দাড়িয়ে অবলোকন করে বলতে পারেন যে, কিরুপে শামুক, ঝিনুক, কাঁকড়া ও মাছের ঝাক জলে বিচরণ বা অবস্থান করছে। ঠিক তেমনি ভিক্ষু তার সমাহিত, অনাবিল, পরিশুদ্ধ ও আসবক্ষয় জ্ঞানচিত্তে প্রকৃষ্টরূপে বলতে পারেন যে, এটা দুঃখ, এটা দুঃখ সমুদয়, এটা দুঃখ নিরোধ এবং এটা দুঃখ নিরোধের উপায়।
এভাবে ভগবান বুদ্ধ সম্রাট অজাতশত্রুর নিকট শ্রামণ্যফলের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় সম্পর্কে বিশ্লেষন করেছেন।
বি:দ্র: – শ্রামণ্যফলের ১৪ নাম্বার বিবরণটি আমার কাছে নেই। যদি কারো কাছে থাকে তবে কাইন্ডলি আমাকে জানানোর জন্য অনুরোধ রইলো।