পরিবেশ দূষণ কাকে বলে?
পরিবেশের সাথে মিলেমিশে মানুষ বা অপরাপর প্রাণীর জীবনের বিকাশ ঘটে। তারা নিজ নিজ পরিবেশ থেকেই বাঁচার উপকরণ সংগ্রহ করে। সেসব উপকরণ থেকে প্রয়োজনীয় অংশ ব্যবহারের পর পরিত্যক্ত অংশ ফিরে যায় সেই পরিবেশে। সেখান থেকে তা আবার মানুষ সংগ্রহ করে। এভাবে জীবজগৎ ও তার পরিবেশের মধ্যে বেঁচে থাকার উপকরণের আদান-প্রদান চলে । আদান-প্রদানের ভারসাম্যের উপর জীবনের অস্তিত্ব নির্ভরশীল। এই ভারসাম্য বিঘ্নিত হলে তাকে বলা হয় পরিবেশ দূষণ ।
এফ. এম. মনিরুজ্জামান বলেন, “পরিবেশের কোনো উপাদানের যখন ভৌত ও রাসায়নিক এবং জৈবিক ও তেজস্ক্রিয় পরিবর্তন ঘটে যা মানুষসহ পরিবেশের মধ্যে বসবাসকারীর উপর নেতিবাচক ও ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে চায় এরূপ অবস্থাকেই পরিবেশ দূষণ বলা হয়।”
আরও পড়ুন: পরিবেশ কি, পরিবেশের প্রকারভেদ ও পরিবেশ পরিবর্তনের কারণ
আবদুল্লাহ আল মুতি বলেছেন, “মাত্রাতিরিক্ত বর্জ্য পদার্থ যদি পরিবেশে মিশে যায় এবং মানুষ, প্রাণী ও উদ্ভিদকূলের ক্ষতিসাধন করে তবে তাকে আমরা পরিবেশ দূষণ বলতে পারি।”
পরিশেষে বলা যায় যে, বিভিন্ন কারণে পরিবেশের যখন বিভিন্ন পরিবর্তন ঘটে এবং আমাদের ক্ষতিসাধন করে, তখন তাকে আমরা পরিবেশ দূষণ বলি।
পরিবেশ দূষণের কারণ সমূহ
বাংলাদেশ নানাবিধ সমস্যায় জর্জরিত তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশ। পরিবেশগত সমস্যা এসব সমস্যার মধ্যে অন্যতম। বিভিন্ন কারণে পরিবেশ মারাত্মক অবনতি ঘটেছে, যা আমাদের জীবনের জন্য হুমকিস্বরূপ। বাংলাদেশে বিদ্যমান প্রধান প্রধান পরিবেশগত সমস্যা সম্পর্কে নিচে আলোচনা করা হলো :
১ । বিষাক্ত বায়ু
দেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে বাড়তি লোকের চাহিদা মিটানোর জন্য বৃদ্ধি পাচ্ছে যানবাহন এবং তৈরি হচ্ছে নতুন নতুন কলকারখানা। এসব গাড়ি ও কলকারখানা থেকে উদ্গত ধোঁয়া বাতাসকে করে তুলছে দূষিত। বিশেষ করে বাস, ট্রাকের কালো ধোঁয়া, ইটের ভাটার ধোঁয়া এবং রাস্তার ধূলোবালি পরিবেশকে দ্রুত বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
২। শব্দ দূষণ
বর্তমান সময়ে শব্দদূষণ এক মারাত্মক সমস্যা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। যানবাহনের হাইড্রোলিক হর্নের বিকট আওয়াজ প্রতিনিয়ত আমাদের কান বিষিয়ে তুলছে এবং ক্ষয় করে দিচ্ছে আমাদের শ্রবণ ক্ষমতাকে। শব্দ দূষণের ফলে আরও ভয়াবহ শারীরিক ও মানসিক ব্যাধিরও সৃষ্টি হচ্ছে। এ শব্দ দূষণ আমাদের পরিবশেগত বিপর্যকে আরও ঘনীভূত করছে।
৩ । পানি দূষণ
দেশে পানি দূষণের মাত্রা আশংকাজনক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ক্ষতিকর শিল্প বর্জ্যের কারণে বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, শীতলক্ষ্যা, রূপসা প্রভৃতি নদীর পানি মারাত্মকভাবে দূষিত হয়ে পড়ছে। বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয় এবং পরিবেশ অধিদপ্তরের সূত্রগুলো নদ-নদীর পানি দূষণের প্রধান কারণ হিসেবে শিল্প বর্জ্যকেই দায়ী করেছে।
৪। রাসায়নিক ও কীটনাশকের ব্যাপক ব্যবহার
ভালো ও উন্নত জাতের ফসল ফলানোর জন্য রাসায়নিক ও কীটনাশকের ব্যবহার প্রয়োজন। তবে কৃষকদের অপরিকল্পিতভাবে এবং ব্যাপক হারে রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহার করছে। এর ফলে জীবজগৎ, প্রাণিজগৎ এবং পরিবেশ মারাত্মক হুমকির সম্মুখীন হচ্ছে।
৫। বন উজাড়
যে কোনো দেশের পরিবেশে বনভূমি বিশেষ ভূমিকা পালন করে। বনভূমির উপর দেশের পরিবেশগত ধরসাম্য বহুলাংশে নির্ভরশীল । কোনো দেশে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় দেশের আয়তনের ২৫ শতাংশ বনভূমি থাকা দরকার। অথচ বাংলাদেশে বনভূমির পরিমাণ ৯ শতাংশেরও কম। বনভূমি উজারও আমাদের দেশের পরিবেশ দূষণের অন্যতম কারণ।
৬। প্লাস্টিক সামগ্রী
দেশে প্লাস্টিক সামগ্রীর ব্যবহার দিন দিন বাড়ছে। প্লাস্টিক সামগ্রী দীর্ঘকাল অক্ষত। মাটির জন্য এ প্লাস্টিক মারাত্মক ক্ষতিকর । এটি মাটির জন্য উপকারী ব্যাকটেরিয়াকে মেরে ফেলে। প্লাস্টিক পোড়ানোর সময় উৎপন্ন হাইড্রোজেন সায়ানাইট গ্যাস চামড়ার জন্য ক্ষতিকর।
৭। পলিথিন
বাংলাদেশে বিভিন্ন ধরনের পলিথিনের ব্যবহার দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। আশির দশকের গোড়ার দিকে এ বিপজ্জনক দ্রব্যাদি যাত্রা শুরু করে এ দেশে। বর্জ্য হিসেবে পলিথিন এই সভ্যতার এক ভয়াবহ শত্রু । বিশ্বজুড়ে পরিবেশ বিজ্ঞানীদের সাবধান বাণী থাকা সত্ত্বেও পলিথিন সামগ্রীর ব্যবহারও এ দেশে বাড়ছে আশঙ্কাজনকভাবে । এটি অবিনাসী বর্জ্য। একে যেখানেই ফেলা হোক না কেন এর শেষ নেই। এ পলিথিন পোড়ালে যে ধোঁয়া বের হয় তাও পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর।
৮। জনসংখ্যার আধিক্য
জনসংখ্যার আধিক্য পরিবেশের উপর মারাত্মক প্রভাব ফেলে। কেননা অপরিকল্পিতভাবে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেলে অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা এবং চিকিৎসাক্ষেত্রে সংকট দেখা দেয়। ফলে স্বাভাবিকভাবেই পরিবেশ দূষিত হয়। ক্রমবর্ধমান মানুষের চাপ একটি লোকালয়ের প্রকৃতি ও পরিবেশকে কতটা বিপন্ন করতে পারে তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত আমাদের রাজধানী শহর ঢাকা।
৯। প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রভাব
বাংলাদেশ প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণ একটি দেশ। এখানে প্রায় প্রতি বছরই নানা ধরনের ভারসাম্য মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়। সিডরের কারণে সুন্দরবনের গাছপালা বিনষ্ট হয়। ফলে পরিবেশ বিপর্যয়ের সম্মুখীন প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেখা দেয়। যেমন : বন্যা, খরা, জলোচ্ছ্বাস, ঘূর্ণিঝড় প্রভৃতি। এসব দুর্যোগের ফলে পরিবেশের হয়ে পড়ে।
১০। বৈশ্বিক উষ্ণতা
গ্রিন হাউস গ্যাস নির্গমনের ফলে ভূ-পৃষ্ঠের উপরিভাগে অবস্থিত ওজোন স্তর ছিদ্র হয়ে সূর্যের আর্ক তেজস্ক্রিয় বেগুনি রশ্মি পৃথিবীর পৃষ্ঠে বিনা বাধায় পতিত হচ্ছে এবং ধূলি, কার্বন ও অন্যান্য গ্যাসীয় পদার্থের সাথে ভূ- পৃষ্ঠে অধিক তাপ আটকা পড়ছে যার ফলে পৃথিবী পৃষ্ঠের তাপ বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলশ্রুতিতে দুই মেরু ও হিমালয় পর্বতশৃঙ্গে জমাট বাঁধা বরফ গলতে শুরু করেছে। এতে পরিবেশের চরম বিপর্যয় হবে।
১১। আর্সেনিক
আরেক ভয়াবহ পরিবেশগত সমস্যা হচ্ছে ভূ-গর্ভস্থ পানিতে দেখা গেছে, বাংলাদেশের ৬৪টি জেলার মধ্যে ৬০টি জেলার পানিতে আর্সেনিকের মাত্রা WHO স্বীকৃত মাত্রার (০.০৫ মিলিগ্রাম/লিটার) চেয়ে অধিক। ১৯৯৮ সালের জুন মাসের একটি রিপোর্ট অনুযায়ী বাংলাদেশের প্রায় ২.২০ লক্ষ আর্সেনিক দূষণে আক্রান্ত।