বাংলাদেশে বিদ্যুৎ ঘাটতির কারণ
স্বাধীনতার ৫২ বছর পরও বাংলাদেশের বিদ্যুৎ সরবরাহ খুবই অপ্রতুল। প্রত্যন্ত অঞ্চলে ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছানোর যে লক্ষ্য, সরকার তা বাস্তবায়নে ব্যর্থ হয়েছে। যারা বিদ্যুৎ সরবরাহের আওতায় এসেছে তারাও নিয়মিত বিদ্যুৎ পাচ্ছে না। প্রতিদিনই ৫/৬ ঘণ্টা করে গড়ে লোডশেডিং করতে হয়। কারণ হচ্ছে চাহিদার তুলনায় বিদ্যুৎ উৎপাদন কম অর্থাৎ বিদ্যুৎ ঘাটতি। বাংলাদেশে বিদ্যুৎ ঘাটতির কারণ সমূহ নিচে সংক্ষেপে বর্ণনা করা হলো :
১। বিদ্যুতের চাহিদা বৃদ্ধি
অর্থনৈতিক উন্নয়ন, শিল্পায়ন, নগরায়ন ও জনসংখ্যা নানাবিধ কারণে বিদ্যুতের চাহিদা বহুলাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে । কিন্তু চাহিদার সাথে পাল্লা দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ে নি বলে বিদ্যুৎ ঘাটতি ক্রমাগত বাড়ছে।
২। বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা হ্রাস
বাংলাদেশে ৬০/৭০ বছর আগে স্থাপিত বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর বেশি ভাগেরই আয়ু শেষ হবার পথে । ফলে উৎপাদন ক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে। বর্তমানে দেশে ক্যাপটিভ এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানিসহ মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ২৭ হাজার ৩৬১ মেগাওয়াট। এ পর্যন্ত গত ১৯ এপ্রিল ২০২৩ তারিখে সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয়েছে ১৫ হাজার ৬৪৮ মেগাওয়াট। ফলে বিদ্যুৎ উৎপাদনে মারাত্মক ঘাটতির সৃষ্টি হয়েছে।
৩। প্রাকৃতিক গ্যাসের অভাব
বিদ্যুৎ উৎপাদনের অন্যতম উপাদান হলো প্রাকৃতিক গ্যাস। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে প্রাকৃতিক গ্যাসের উৎপাদন ও সরবরাহ কমে যাওয়ায় গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্পগুলোতে বিদ্যুতের উৎপাদন কমে যায়। ফলে বিদ্যুৎ সংকট ঘনীভূত হয়।
আরও পড়ুন: কৃষি ঋণ কি? বাংলাদেশের কৃষি ঋণের উৎসগুলো কি কি?
৪। বিদ্যুৎ চুরি
বাংলাদেশের বিদ্যুৎ সমস্যার জন্য দায়ী কারণগুলোর মধ্যে শিল্পকারখানায় ও বস্তিতে বিদ্যুৎ চুরি অন্যতম । শিল্পকারখানার মালিকেরা বিভাগের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যোগসাজশে মিটার টেম্পারিং করে বিদ্যুৎ চুরি করে। ফলে বিদ্যুৎ ঘাটতি তৈরি হয় এবং সরকার রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হয়।
৫। অদক্ষতা ও দুর্নীতি
বিদ্যুৎ উৎপাদন, বিতরণ ও বিদ্যুৎ বিল আদায়ের সাথে জড়িত কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের অদক্ষতা ও দুর্নীতি বিদ্যুৎ ঘাটতির জন্য অনেকাংশে দায়ী। বাংলাদেশে সর্বাধিক দুর্নীতিগ্রস্ত খাতগুলোর মধ্যে বিদ্যুৎ খাত অন্যতম দুর্নীতিগ্রস্ত ।
৬। প্রশিক্ষণের অভাব
বিদ্যুৎ বিভাগে কর্মরত কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের নিয়মিত প্রশিক্ষণ দেয়া হয় না। কিন্তু প্রশিক্ষণ না দিলে তাদের মেধার বিকাশ ঘটবে না এবং বিদ্যুৎ পরিস্থিতিরও তেমন কোন উন্নতি হবে না।
৭। সিস্টেম লস
উৎপাদনের পর যে পরিমাণ বিদ্যুৎ ভোক্তাদের/গ্রাহকের কাছে পৌঁছায় না তাকে বলা হয় বিদ্যুতের সিস্টেম লস। বিদ্যুতের পরিচালন ও সঞ্চালন ক্ষেত্রে বিভিন্ন দুর্বলতার কারণে উৎপাদিত বিদ্যুতের পুরোটা ভোক্তাদের কাছে পৌঁছায় না। বাংলাদেশে বিদ্যুৎ ঘাটতির অন্যতম কারণ হিসেবে বিবেচনা করা হয় সিস্টেম লসকে। বর্তমানে বাংলাদেশে বিদ্যুতের সিস্টেম লসের পরিমাণ ১০%-এর উপরে।
৮। বিদ্যুৎ ইউনিট বন্ধ
আমাদের বেশকিছু বিদ্যুৎ কারখানা বা ইউনিট বন্ধ হয়ে গেছে। আবার চালু ইউনিটগুলোর কোনটি বছরের কোন কোন সময় যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে কিংবা জ্বালানির অভাবে বন্ধ থাকে। তাই উৎপাদন কম হয় এবং বিদ্যুতের ঘাটতি তৈরি হয়।
৯। ফারনেস অয়েলের অভাব
বাংলাদেশে কুইক রেন্টাল পাওয়ার প্রকল্প এবং অন্যান্য বিদ্যুৎ প্রকল্পগুলোর বেশ কয়েকটিতে জ্বালানি হিসেবে ফারনেস অয়েল ব্যবহার করা হয়। বিগত বছরগুলোতে দাম বাড়ার কারণে ফারনেস অয়েল সরবরাহ কমে যায় এবং বিদ্যুৎ উৎপাদনও কমে যায় বলে বিদ্যুৎ ঘাটতি ত্বরান্বিত হয়েছে।
১০। ত্রুটিযুক্ত মিটার
বাংলাদেশে বিদ্যুতের মিটারগুলো পুরাতন ও ত্রুটিযুক্ত। এরূপ মিটারের মাধ্যমে অনেক অসাধু গ্রাহক খুব সহজেই বিদ্যুৎ চুরি করতে পারে। তাছাড়া এসব মিটারের মাধ্যমে রিডিং সমস্যা হয় বলে বিদ্যুতের মিটারগণ বিদ্যুৎ বিলে কারসাজি করতে পারে।
১১। বিদেশি বিনিয়োগ হ্রাস
বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনে প্রচুর অর্থ দরকার। কিন্তু দাতা ও বিদেশি সংস্থাগুলো নতুন করে কোন বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনে এগিয়ে আসছে না। যেসব কোম্পানি আগ্রহ দেখিয়েছে তারা আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও সরকারের সিদ্ধান্তের দীর্ঘসূত্রিতায় পিছিয়ে গেছে। ফলে বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানো যাচ্ছে না। তাই বিদ্যুৎ ঘাটতি অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছে গেছে ।
১২। বণ্টন ব্যবস্থার ত্রুটি
বাংলাদেশে বিদ্যুতের বণ্টন ব্যবস্থার যথেষ্ট ত্রুটি রয়েছে। ফলে বিদ্যুতের সরবরাহ মাঝে মাঝে বিঘ্ন ঘটে।
১৩। কাপ্তাই হ্রদের পানি প্রবাহ হ্রাস
বর্তমানে কাপ্তাই হ্রদের পানির উচ্চতা কমে যাওয়ায় কর্ণফুলি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বিদ্যুৎ কেন্দ্রে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন কম হয় এবং বিদ্যুৎ ঘাটতি দেখা যায়। সবগুলো ইউনিট একত্রে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারে না। তাই দেশের একমাত্র পানি বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী কর্ণফুলি
১৪। অনুন্নত ক্যাবল
আমাদের দেশের বিদ্যুতের ক্যাবলগুলো অনেক পুরাতন ও নিম্নমানের। অনুন্নত ও পুরাতন ক্যাবলের কারণে বৈদ্যুতিক সর্ট-সার্কিটের ক্যাবল পুড়ে যায় এবং দুর্ঘটনা ঘটে। মাঝে মাঝে দুর্ঘটনার ফলে জানমালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়।
১৫। বিশেষজ্ঞের অভাব
বাংলাদেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন ও বিতরণে বিশেষজ্ঞের অভাব রয়েছে। এ কারণে বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোতে প্রায়ই যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে বিদ্যুৎ উৎপাদন ও সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়।