Home » অনুন্নত দেশ কাকে বলে? অনুন্নত দেশের বৈশিষ্ট্য আলোচনা কর
অনুন্নত দেশ কাকে বলে

অনুন্নত দেশ কাকে বলে? অনুন্নত দেশের বৈশিষ্ট্য আলোচনা কর

by TRI

Table of Contents

অনুন্নত দেশ

সাধারণত যে সকল দেশের জনগণের মাথাপিছু আয় খুবই কম, জীবনযাত্রার মান খুবই নিম্ন এবং বেকারত্বে জর্জরিত সে সব দেশকে অনুন্নত দেশ বলে । মূলত অনুন্নত দেশের জনগণ তাদের মৌলিক অধিকার যেমন: খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা প্রভৃতি থেকে পুরোপুরি বঞ্চিত হয়। তাছাড়া অনুন্নত শব্দটি একটি আপেক্ষিক অর্থে ব্যবহৃত হয়। তাই এর সর্বসত সংজ্ঞা প্রদান করা বেশ কঠিন। কারণ বিভিন্ন অর্থনীতিবিদ বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে এর সংজ্ঞা প্রদান করেছেন। নিচে বিভিন্ন অর্থনীতিবিদ কর্তৃক প্রদত্ত অনুন্নত দেশের সংজ্ঞা প্রদান করা হলো :

অধ্যাপক রাগনার নার্কস্-এর মতে, “অনুন্নত দেশ হচ্ছে সেসব দেশ যেসব দেশ উন্নত দেশের তুলনায় জনসংখ্যা ও প্রাকৃতিক সম্পদের দিক থেকে স্বল্প মূলধন সমৃদ্ধ দেশ।”

অধ্যাপক বুকাননএলিস-এর মতে, “অনুন্নত দেশ বলতে ঐ সব দেশ বুঝায় যার অধিবাসীরা উন্নত দেশের তুলনায় নিম্নমানের সম্পদ ভোগ করে।”

অধ্যাপক কলিন ক্লার্কের মতে, “অনুন্নত দেশ বলতে ঐসব দেশকে বুঝায় যেখানে প্রাথমিক পেশার প্রাধান্য রয়েছে।”

জাতিসংঘ বিশেষজ্ঞদের মতে, “যেসব দেশের প্রকৃত মাথাপিছু আয় যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া ও পশ্চিম ইউরোপীয় দেশসমূহের তুলনায় কম সেসব দেশকে অনুন্নত দেশ বলা হয়। ” সুতরাং বলা যায়, যেসব দেশের প্রকৃত মাথাপিছু আয় খুবই কম এবং উন্নত দেশের তুলনায় অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে পশ্চাৎপদ সেসব দেশকেই অনুন্নত দেশ বলা হয়। যেমন: মালদ্বীপ, ভুটান, ইথিওপিয়া ইত্যাদি ।

অনুন্নত দেশের বৈশিষ্ট্য সমূহ

যে সকল দেশের জনগণের মাথাপিছু আয় খুবই কম এবং জীবনযাত্রার মান খুবই নিম্ন সেসব দেশকে অনুন্নত দেশ বলে। এসব দেশের আর্থ-সামাজিক অবকাঠামো পর্যালোচনা করলে কতকগুলো সাধারণ বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। এগুলোই হলো অনুন্নত দেশের বৈশিষ্ট্য । অনুন্নত দেশের বৈশিষ্ট্যগুলো নিচে বিশদভাবে আলোচনা করা হলো :

১। কৃষির উপর অধিক নির্ভরশীলতা

অনুন্নত দেশের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো কৃষির উপর অধিক নির্ভরশীলতা। কৃষিই হলো অনুন্নত দেশের জনগণের জীবনধারণের একমাত্র উপায়। অনুন্নত দেশের প্রায় ৯০ ভাগ মানুষ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কৃষির উপর নির্ভরশীল । এমনকি এসব দেশের জাতীয় আয়ের সিংহভাগই আসে কৃষি হতে ।

২। খাদ্যের অভাব

অনুন্নত দেশের শিক্ষার হার কম থাকার দরুন জনসংখ্যা অধিক হারে বৃদ্ধি পায়। ফলে খাদ্য ঘাটতি আরও প্রকট আকার ধারণ করে। কারণ এসব দেশে প্রাচীন চাষ পদ্ধতি, উন্নত বীজের অভাব, আধুনিক সেচ ব্যবস্থার অভাবের জন্য একর প্রতি উৎপাদন কম হয়। ফলে খাদ্য ঘাটতি দেখা দেয়।

৩। দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধি

দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধি অনুন্নত দেশের আর একটি বৈশিষ্ট্য। অনুন্নত দেশের জনগণ শিক্ষার আলো। থেকে বঞ্চিত থাকার ফলে তারা বিভিন্ন কুসংস্কারে বিশ্বাসী হয়। ফলে বাল্য বিবাহ, বহুবিবাহ ইত্যাদি কারণে অনুন্নত দেশে দ্রুতগতিতে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পায়।

৪। বেকার সমস্যা

অনুন্নত দেশের প্রধান বৈশিষ্ট হলো ব্যাপক হারে বেকার সমস্যা। এসব দেশে মূলধনের পরিমাণ কম থাকায় বিনিয়োগও কম হয়। ফলে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয় না। এ কারণে মোট জনসংখ্যার বিরাট একটি অংশ বেকার হয়ে পড়ে। তাছাড়া অনুন্নত দেশগুলোতে বিকল্প কোন পেশা না থাকায় কৃষিক্ষেত্রে অতিরিক্ত শ্রমিক কাজ করে। ফলে কৃষিতে ছদ্মবেশী বেকারত্ব সৃষ্টি হয়।

৫। মূলধনের অভাব

অনুন্নত দেশের জনগণের মাথাপিছু আয় স্বল্প হওয়ার কারণে তাদের প্রয়োজনীয় অভাব পূরণ করবে পারে না। ফলে তাদের সঞ্চয় প্রবণতা কম হয়। আর স্বল্প সঞ্চয়ের জন্য মূলধন গঠনের হার খুবই কম থাকে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় উন্নত দেশে যেখানে জাতীয় আয়ের শতকরা ২০-২৫ ভাগ মূলধন গঠনের জন্য ব্যয় হয় অধ্য অনুন্নত দেশে জাতীয় আয়ের শতকরা ৫-১০ ভাগ মূলধন গঠনের জন্য ব্যয় করা হয়।

৬। স্বল্প মাথাপিছু আয়

অনুন্নত দেশের একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো স্বল্প মাথাপিছু আয় । অধিকাংশ অনুন্নত দে কৃষির উপর নির্ভরশীল। কিন্তু আজও তারা প্রাচীন পদ্ধতিতে কৃষিকাজ করে। ফলে একর প্রতি উৎপাদন অনেক বা হয় । এ কারণে অনুন্নত দেশের জনগণের মাথাপিছু আয় খুব কম হয় ।

৭। শিল্পে অনগ্রসরতা

প্রতিটি অনুন্নত দেশে প্রয়োজনের তুলনায় শিল্প কারখানা খুবই নগণ্য। অনুন্নত দেশসমূহে মূলধনের পরিমাণ কম থাকায় বহদায়তন শিল্প কারখানা গড়ে তোলা সম্ভব হয় না। তাছাড়া এসব দেশে উদ্যোক্তার অভাব, দক্ষ শ্রমিকের অভাব, আধুনিক প্রযুক্তির অভাব, প্রশিক্ষণের অভাব প্রভৃতি কারণে শিল্প কারখানা গড়ে উঠে নি।

৮। প্রাকৃতিক সম্পদের অপূর্ণ ব্যবহার

অনুন্নত দেশের আর একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো প্রাকৃতিক সম্পদের অপূর্ণ ব্যবহার। অনুন্নত দেশের শিল্প ব্যবস্থা অনুন্নত বিধায় দক্ষ উদ্যোক্তা ও দক্ষ মানব সম্পদ গড়ে উঠে না। যেহেতু এসব দেশের জনগণ অশিক্ষিত, অদক্ষ এবং মূলধনের যথেষ্ট অভাব তাই তাদের পক্ষে প্রাপ্ত প্রাকৃতিক সম্পদের যথাযথ ব্যবহার সম্ভব হয় না। ফলে অনুন্নত দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ অকার্যকরভাবে পড়ে থাকে।

৯। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের উপর নির্ভরশীলতা

অধিকাংশ অনুন্নত দেশ কৃষির উপর নির্ভর হওয়ায় তারা শুধু কৃষিজাত পণ্য রপ্তানি করে। অন্যদিকে এসব দেশে মূলধনের পরিমাণ কম থাকায় শিল্পে অগ্রসর হতে পারে না। ফলে অনুন্নত দেশসমূহ ভোগ্যপণ্য ও শিল্পজাতপণ্য বিদেশ থেকে আমদানি করে । অতএব অনুন্নত দেশসমূহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রীর চাহিদা পূরণের জন্য আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের উপর নির্ভর করে থাকে।

১০। দুর্বল আর্থ-সামাজিক অবকাঠামো

অনুন্নত দেশের আর একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো দুর্বল আর্থ-সামাজিক অবকাঠামো। এসব দেশের মূলধনের পরিমাণ কম থাকায় শিক্ষা, স্বাস্থ্য, যাতায়াত, বিদ্যুৎ সরবরাহ ইত্যাদি খাতে অধিক টাকা বিনিয়োগ করতে পারে না। ফলে আর্থ-সামাজিক অবকাঠামো বেশ দুর্বল হয়।

১১। দক্ষ উদ্যোক্তার অভাব

অনুন্নত দেশসমূহে দক্ষ উদ্যোক্তা গড়ে উঠে না। কারণ এসব দেশে যাদের হাতে প্রচুর পরিমাণে মূলধন থাকে তারা কোন ঝুঁকিপূর্ণ কাজে টাকা বিনিয়োগ করতে আগ্রহী হয় না। অনুন্নত দেশে যারা বেশি টাকার অধিকারী তারা বিশেষ করে জমি ক্রয়, অলঙ্কারাদি ক্রয় প্রভৃতি খাতে টাকা খাটায় । ফলে দেশে দক্ষ উদ্যোক্তার অভাব দেখা দেয়।

১২। দক্ষ মানব সম্পদের অভাব

অনুন্নত দেশসমূহে সবচেয়ে বড় অভাব হলো দক্ষ মানব সম্পদের। এসব দেশে শ্রম বিশেষীকরণ না থাকার জন্য দক্ষ মানব সম্পদ সৃষ্টি হয় না। তাছাড়া উপযুক্ত শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা না থাকায় মানব সম্পদকে দক্ষ করে তোলা সম্ভব হয় না। যার ফলে এসব দেশের জনগণের উৎপাদন ক্ষমতা কম থাকে বলে জীবনযাত্রার মান খুবই নিম্ন হয়।

১৩। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি

অনুন্নত দেশের আর একটি উল্লেখযোগ্য বৈশষ্ট্য হলো দ্রব্যমূল্যের বৃদ্ধি। যেহেতু অনুন্নত দেশে শিক্ষার হার খুবই কম তাই জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার অধিক হয়। ফলে খাদ্য ঘাটতি দেখা দেয়ায় দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পায়। তাছাড়া অতিরিক্ত দুর্নীতি, কালোবাজারি এবং প্রাচীন কৃষিব্যবস্থার কারণে দ্রব্যমূল্য ক্রমাগত বৃদ্ধি পেতে থাকে। এর ফলে জনগণের ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পায়।

১৪। দ্বৈত অর্থনৈতিক ব্যবস্থা

অনুন্নত দেশের অন্যতম একটি বৈশিষ্ট্য হলো দ্বৈত অর্থনৈতিক অবস্থা। এসব দেশে বাজার অর্থনীতি এবং জীবন নির্বাহী অর্থনীতি দু’টোই চলমান থাকে। এতে করে কিছুসংখ্যক লোক সম্পদের পাহাড় গড়ে। অন্যদিকে সিংহভাগ জনগণ সম্পদের অভাবে মানবেতর জীবন যাপন করে।

১৫। আধুনিক প্রযুক্তির অভাব

অনুন্নত দেশসমূহ আধুনিক প্রযুক্তি ও কলাকৌশল থেকে বঞ্চিত হয়। এসব দেশে মূলধনের পরিমাণ কম বলে অধিক টাকা খরচ করে বিদেশ থেকে উন্নতমানের যন্ত্রপাতি ও কলাকৌশল আমদানি করতে পারে না। তাছাড়া অনুন্নত দেশের অধিকাংশ লোক অশিক্ষিত বিধায় তারা আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারে অনীহা প্রকাশ করে। ফলে অনুন্নত দেশসমূহের অর্থনৈতিক উন্নয়ন মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্ত হয়।

১৬। প্রতিকল সামাজিক ও ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি

অনুন্নত দেশেসমূহের অধিকাংশ জনগণ শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হয়। ফলে তারা নানা ধরনের সামাজিক কুসংস্কার ও ধর্মীয় গোড়ামি দ্বারা আচ্ছন্ন থাকে। এ কারণে অনুন্নত দেশের জনগণ কাজ করার স্পৃহা হারিয়ে ফেলে নিজেকে ভাগ্যের উপর ছেড়ে দেয়। ফলে অর্থনৈতিক উন্নয়ন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়।

১৭। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা

অনুন্নত দেশের আর একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা। বেশিরভাগ অনুন্নত দেশ সদ্য স্বাধীনতা প্রাপ্ত। ফলে এসব দেশে শক্তিশালী গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠিত না হওয়ার কারণে দুর্নীতি, হরতাল, অবরোধ, ভাংচুর প্রভৃতি প্রতিটি স্তরে পৌঁছে গেছে। এতে করে অনুন্নত দেশে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা বিরাজ করে । ফলে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ব্যাহত হয়।

১৮। বৈদেশিক সাহায্যের উপর নির্ভরশীলতা

অধিকাংশ অনুন্নত দেশ বৈদেশিক সাহায্যের উপর নির্ভরশীল থাকে। কারণ এসব দেশের প্রাকৃতিক সম্পদগুলো মূলধন ও প্রযুক্তির অভাবে অকার্যকরভাবে পড়ে থাকে। ফলে দেশের উন্নয়ন পরিকল্পনার ব্যয় নির্বাহের জন্য বৈদেশিক সাহায্যের উপর নির্ভর করতে হয়।

১৯। দারিদ্র্যের দুষ্টচক্র

অনুন্নত দেশের উল্লেখযোগ্য একটি বৈশিষ্ট্য হলো দারিদ্র্যের দুষ্টচক্র। এসব দেশের অর্থনীতি দারিদ্র্যের দুষ্টচক্র দ্বারা পরিবেষ্টিত থাকে। ফলে অর্থনৈতিক উন্নয়ন বাধাপ্রাপ্ত হয় । তাছাড়া অনুন্নত দেশের অনুন্নতির মূল কারণই হলো দারিদ্র্য। এ প্রেক্ষিতে অধ্যাপক নার্কস বলেন, “একটি দেশ দরিদ্র, কারণ সে দরিদ্র” (A country is poor, because it is poor.)। স্বল্প সঞ্চয়, স্বল্প মূলধন, স্বল্প বিনিয়োগ, স্বল্প উৎপাদন ও স্বল্প আয় ইত্যাদি অর্থনৈতিক উন্নয়নের বাধাসমূহ চক্রাকারে প্রতিনিয়ত কার্যকর থেকে অনুন্নত দেশগুলোর দারিদ্র্যের দুষ্টচক্রে আচ্ছন্ন রাখে।

উল্লিখিত বৈশিষ্ট্যগুলো অনুন্নত দেশগুলোতে বিরাজমান থাকার ফলে অর্থনৈতিক উন্নয়ন মারাত্মকভাবে বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে। যার দরুন অনুন্নত দেশগুলোর জনগণের মাথাপিছু আয় খুবই নিম্ন এবং জীবনযাত্রার মান দারিদ্র্যসীমার অনেক নিচে।

আরও পড়ুন:

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে প্রতিবন্ধকতা গুলো কি কি?

অর্থনৈতিক উন্নয়নের পূর্বশর্ত কি কি? আলোচনা কর

অর্থনৈতিক উন্নয়নের সূচক কি কি?

 

Related Posts