রাষ্ট্র ও সমাজের মধ্যে পার্থক্য
রাষ্ট্র ও সমাজের মধ্যে ব্যাপক পার্থক্য বিদ্যমান। আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানীগণ রাষ্ট্র ও সমাজের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করেছেন। অধ্যাপক লাস্কি (Laski) বলেন, “রাষ্ট্র সমাজ জীবনের মূলসূত্র নির্ধারণ করেছিল বটে কিন্তু রাষ্ট্র ও সমাজ জীবন অভিন্ন নয়।” অধ্যাপক বার্কার (Barker) বলেন, “সমাজ ও রাষ্ট্র পারস্পরিক সহযোগিতার সূত্রে আবদ্ধ সন্দেহ নেই, কিন্তু এরা একই কাজ সম্মিলিতভাবে এবং একই পদ্ধতিতে করে না।” অধ্যাপক বার্কার (Barker) সমাজের সংজ্ঞায় বলেন, “সমাজ বলতে জাতির অন্তর্গত স্বেচ্ছায় প্রতিষ্ঠিত সংঘের সমষ্টিকে বোঝায়।” (By society we mean the whole sum of voluntary bodies or associations contained in the nation.) অপরদিকে, রাষ্ট্র বলতে বিশেষ উদ্দেশ্য সাধনের জন্য প্রতিষ্ঠিত এক আবশ্যিক সংগঠনকে বোঝায়।
নিম্নে রাষ্ট্র ও সমাজের মধ্যে পার্থক্য আলোচনা করা হলো:
১. জন্মের দিক থেকে
রাষ্ট্র সৃষ্টির অনেক আগেই সমাজের জন্ম হয়েছে। মানবসভ্যতার আদিম যুগে যখন রাষ্ট্র নামক কোনো প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব ছিল না, তখনও গোত্রীয় জীবন যাপনকারী মানুষের সমাজের অস্তিত্ব ছিল। তখনকার সমাজ ছিল সমকোণী, কালক্রমে পশুপালন সমাপ্ত এবং কৃষি সমাজ গড়ে ওঠে। এরপর শ্রমবিভাগ, বিনিময়, ব্যক্তিগত সম্পত্তি ও নিয়ম-কানুনের ভিত্তিতে সুসংগঠিত সমাজগোষ্ঠী, উপজাতীয় সমাজের সৃষ্টি হয়। উপজাতীয় সমাজই রাষ্ট্র সৃষ্টি করে। ম্যাকাইভার (Maclver) বলেন, “Society preceedes the state just as it preceeds the family.”
২.পরিধির দিক থেকে
সমাজের পরিধি রাষ্ট্রের পরিধি অপেক্ষা অনেক ব্যাপক, মানব জীবনের সবকিছু সমাজের পরিধিভুক্ত। মানুষের সর্বাঙ্গীণ উন্নতি সাধনই হলো সমাজের উদ্দেশ্য। কিন্তু রাষ্ট্র কেবল মানুষের রাজনৈতিক জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করে, বস্তুত সমাজের অন্তর্গত বহুবিধ সংগঠনের মধ্যে রাষ্ট্র হলো অন্যতম রাজনৈতিক সংগঠন। অধ্যাপক বার্কার (Barker) বলেন, “The state exists for one great but single purpose. Society exists for a number of purposes.”
৩. ভৌগোলিক সীমারেখার দিক থেকে
রাষ্ট্র একটি ভৌগোলিক প্রতিষ্ঠান। এর সীমানা নির্দিষ্ট। ভৌগোলিক সীমানা রাষ্ট্রকে একটি সসীম প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেছে। কিন্তু ভৌগোলিক সীমারেখা দ্বারা সমাজ গঠিত হয় না। সমাজের কোনো নির্দিষ্ট ভূখণ্ড নেই। সমাজ ছোট বড় হতে পারে। এমনকি বিশ্বব্যাপীও সমাজ গঠিত হতে পারে। যেমন- খ্রিস্টান সমাজ, মুসলিম সমাজ, রোটারি ইন্টারন্যাশনাল, রেডক্রস সোসাইটি ইত্যাদি। অধ্যাপক লীকক (Leacock)-এর মতে, “সমাজ শব্দটির সাথে কোনো ভূখণ্ডের ধারণা জড়িত নেই।” (The term society has no reference to a territorial occupation.)
আরও পড়ুন: প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্র ধারণাটি আলোচনা কর
৪. সরকারের দিক থেকে
রাষ্ট্রের অপরিহার্য উপাদানগুলোর মধ্যে সরকার হলো অন্যতম। সরকারের মাধ্যমে রাষ্ট্রের লক্ষ, উদ্দেশ্য, ইচ্ছা-অনিচ্ছা প্রকাশিত ও বাস্তবায়িত হয়। অধ্যাপক পেটেল (Gettell)-এর মতে, “সরকার হলো রাষ্ট্রের একটি সংস্থা বা যন্ত্র।” (Government is the organisation or machinery of the state.) অপরদিকে, সমাজ গঠনের জন্য সরকার নামক উপাদানের দরকার নেই। আদিম যুগে মানুষের মধ্যে সমাজের অস্তিত্ব ছিল, কিন্তু সরকারের অস্তিত্ব ছিল না।
৫. সার্বভৌমত্বের ক্ষেত্রে
সার্বভৌমত্ব হলো রাষ্ট্রের অন্যতম উপাদান। সার্বভৌম ক্ষমতা ব্যতীত রাষ্ট্র গঠন সম্ভব নয়। রাষ্ট্র শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে তার আদেশ-নির্দেশ বাস্তবায়ন করে। কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান রাষ্ট্রীয় আইন ভঙ্গ করলে, রাষ্ট্র তাকে শাস্তি দিতে পারে। এমনকি গুরুতর অপরাধের জন্য মৃত্যুদণ্ডও প্রদান করতে পারে। কিন্তু সমাজ সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী নয়। সমাজ প্রচলিত প্রথা, রীতি-নীতির মাধ্যমে মানুষের আচার-আচরণ নিয়ন্ত্রণ করে। সমাজ শক্তি প্রয়োগ করতে পারে না।
৬. সদস্যপদ গ্রহণের ক্ষেত্রে
রাষ্ট্রের সদস্যপদ গ্রহণ বাধ্যতামূলক। প্রত্যেক ব্যক্তিকে নিজ রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন ও নিজ রাষ্ট্রের আইন মেনে চলতে হয়। বিশেষ ব্যতিক্রম ছাড়া একই ব্যক্তি একই সাথে একাধিক রাষ্ট্রের সদস্য হতে পারে না। কিন্তু সমাজের সদস্য হওয়া বাধ্যতামূলক নয়। সমাজের সদস্যপদ লাভ ঐচ্ছিক। যে কেউ কোনো সমাজের সদস্য হতেও পারে আবার নাও হতে পারে। আবার কেউ একাধিক সমাজেরও সদস্য হতে পারে। এভাবে সমাজস্থ ব্যক্তিবর্গের আনুগত্য একাধিক সমিতির প্রতি প্রসারিত হয় বা বিভক্ত হয়।
৭. উদ্দেশ্যগত পার্থক্য
উদ্দেশ্যগত দিক থেকে রাষ্ট্র ও সমাজের মধ্যে পার্থক্য বিদ্যমান। রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য মূলত আইন, শাসন ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করা। একমাত্র রাষ্ট্রই আইন প্রণয়ন ও বলবৎকরণের কাজ সম্পাদন করে। কিন্তু সমাজের উদ্দেশ্য হলো বহু ও বিভিন্ন ধর্মীয়, নৈতিক, আর্থিক, সাংস্কৃতিক প্রভৃতি বহু উদ্দেশ্য সাধনের মাধ্যম হলো সমাজ। বস্তুত বিভিন্ন সমিতি বা সংগঠনের মাধ্যমে সমাজের এ সকল দায়িত্ব সম্পাদিত হয়।
৮. বল প্রয়োগের ক্ষেত্রে
রাষ্ট্র তার উদ্দেশ্য সাধনের জন্য বলপ্রয়োগ করতে পারে। রাষ্ট্র বিধিবন্ধ আইনের সাহায্যে এবং প্রয়োজনবোধে বলপ্রয়োগ করে তার উদ্দেশ্য সাধন করে। পক্ষান্তরে, সমাজ তার উদ্দেশ্য সাধনের জন্য সহযোগিতা ও শুভেচ্ছামূলক পদ্ধতি অনুসরণ করে। সমাজ বলপ্রয়োগ করতে পারে না। অধ্যাপক বার্কার (Barker) বলেন, “Society uses the method of voluntary action and process of persuation.
৯. স্থায়িত্বের দিক থেকে
রাষ্ট্র একটি স্থায়ী প্রতিষ্ঠান। রাষ্ট্রের রূপান্তর ঘটতে পারে কিন্তু তা সহজে বিনাশ হয় না। যুদ্ধ বা প্রাকৃতিক কারণে রাষ্ট্রের বিলুপ্তি ঘটতে পারে। তবে এটা ব্যতিক্রম। পক্ষান্তরে সমাজ চির পরিবর্তনশীল, সদস্যদের অসহযোগিতা বা অপ্রয়োজনীয়তার কারণে সমাজ বিলুপ্ত হয়ে যায়।
১০. সাংগঠনিক দিক থেকে
রাষ্ট্র মূলত রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানেরই নামান্তর। একটি নির্দিষ্ট ভূখণ্ডে রাজনৈতিকভাবে সংগঠিত জনসমষ্টি নিয়ে রাষ্ট্র গঠিত হয়। রাষ্ট্র রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে আলোচনা করে। কিন্তু সমাজ কোনো রাজনৈতিক সংগঠন নয়। সমাজের বিভিন্ন সংগঠনের সমন্বয়ই সমাজ গঠনের উৎস। সমাজ একটি সার্বভৌম ক্ষমতাহীন অরাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান।
১১. সুসংহতের দিক থেকে
রাষ্ট্র একটি সুসংহত ও সংগঠিত প্রতিষ্ঠান। সরকার আছে বলেই রাষ্ট্র এতটা সুসংগঠিত ও শক্তিশালী। অপরদিকে, সমাজ হলো অনেকটা অসংহত ও অসংগঠিত প্রতিষ্ঠান। বস্তুত সরকার না থাকায় সমাজ সুসংগঠিত প্রতিষ্ঠানে পরিণত হতে পারেনি।
১২.কার্যগত দিক থেকে
রাষ্ট্র মানুষের রাজনৈতিক আচরণ ও কাজকে নিয়ন্ত্রণ করে এবং রাষ্ট্রীয় কার্যাবলির সাথে সম্পর্কযুক্ত অর্থনৈতিক ও উন্নয়নমূলক কাজ সম্পাদন করে। তবে রাষ্ট্র মানুষের জাগতিক ও পারলৌকিক সকল বিষয় পরিচালনা করে না। কিন্তু সমাজ মানুষের সার্বিক কল্যাণ সাধনের জন্য প্রয়োজনীয় কাজ সম্পাদন করে।
১৩. কাঠামোগত দিক থেকে
কাঠামোগত দিক থেকে রাষ্ট্র ও সমাজের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। অধ্যাপক বার্কার (Barker) বলেন, “আইনগতভাবে সংগঠিত জাতির সদস্যগণ যে একটিমাত্র সংগঠনের সদস্য তা হলো রাষ্ট্র, কিন্তু সামাজিকভাবে সংগঠিত জাতির সদস্যগণ বিভিন্ন সংগঠনের সদস্য।” অধ্যাপক বার্কার (Barker) আরও বলেন, “স্বেচ্ছামূলক সহযোগিতা হলো সমাজের এলাকা, এর শক্তি হলো সদিচ্ছা এবং এর পদ্ধতি হলো স্থিতিস্থাপকতা। অপরদিকে, যান্ত্রিক কার্যাবলি হলো রাষ্ট্রের এলাকা, এর শক্তি হলো বলপ্রয়োগ এবং এর পদ্ধতি হলো কঠোরতা।” (The area of society is voluntary co-operation, its energy is that of goodwill, and its method is elasticity, while the area of the other is that of mechanical action, its energy is force and its method is rigidity.)
১৪. নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে
রাষ্ট্র কেবল মানুষের বাহ্যিক আচার-আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করে। অপরদিকে, সমাজ মানুষের বাহ্যিক, মানসিক, নৈতিক, ধর্মীয় ইত্যাদি সামগ্রিক জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করে।
১৫. আইনের স্বচ্ছতা ও সুনির্দিষ্টতার ক্ষেত্রে
রাষ্ট্রের আইন এবং নিয়মকানুন স্বচ্ছ ও সুনির্দিষ্ট। কারণ এ সকল আইন ও নিয়মকানুন আইনসভা কর্তৃক প্রণীত হয়। অপরদিকে, সমাজ আইন প্রণয়ন করতে পারে না। সমাজের আইন কানুনের উৎস হলো প্রথা, ঐতিহ্য ও ধর্ম। ফলে এগুলো তেমন স্বচ্ছ ও সুনির্দিষ্ট নয়।