প্রাচ্যের রাষ্ট্রচিন্তার বিষয়বস্তু ও পরিধি
প্রাচ্যের রাষ্ট্রচিন্তার বিষয়বস্তু অত্যন্ত ব্যাপক। কেননা, প্রাচীনকাল থেকে শুরু করে বর্তমান সময় পর্যন্ত প্রাচ্যের রাষ্ট্রচিন্তাবিদদের চিন্তাধারার মধ্যে যে সকল আলোচনা আসে তাই প্রাচ্যের রাষ্ট্রচিন্তার বিষয়বস্তু। নিম্নে এ সম্পর্কে আলোচনা করা হলো:
১. ইসলামি জীবন ব্যবস্থা সম্পর্কে আলোচনা
প্রাচ্যের রাষ্ট্রচিন্তা ইসলাম সম্পর্কে ব্যাপক আলোচনা করে। ইসলামি জীবন ব্যবস্থায় যা কিছু প্রয়োজন তা সহ আরও অন্যান্য বিষয় সম্পর্কে আলোচনা করে থাকে। যেমন– ইসলাম কী, ইসলামের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশের ইতিহাস, ইসলামের ভিত্তি ও উৎসসমূহ, ইসলাম কীভাবে একটি পরিপূর্ণ ও প্রগতিশীল জীবন ব্যবস্থা নির্দেশ করে, ইসলাম কীভাবে মানুষের ব্যক্তিগত, সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক জীবনের নিশ্চয়তা বিধান করে ইত্যাদি বিষয় প্রাচ্যের রাষ্ট্রচিন্তার কেন্দ্রবিন্দু।
২. ইসলামি আইন বা শরীয়াহ সম্পর্কে আলোচনা
প্রাচ্যের রাষ্ট্রচিন্তা ইসলামি আইন সম্পর্কেও আলোচনা করে। ইসলামি আইনের সংজ্ঞা, ইসলামি আইনের উৎপত্তি ও বৈশিষ্ট্য, ইসলামি আইন প্রণয়নের পদ্ধতি, ইসলামি আইন বাস্তবায়নের পদ্ধতি, ইসলামি আইন অমান্যকারীর বিরুদ্ধে কী ধরনের শাস্তি হবে তার নির্দেশনাদানসহ ইসলামি আইনের বাস্তবরূপ সম্পর্কেও প্রাচ্যের রাষ্ট্রচিন্তা আলোচনা করে।
৩. ইসলামি অর্থব্যবস্থা
প্রাচ্যের রাষ্ট্রচিন্তা ইসলামি অর্থব্যবস্থা সম্পর্কে আলোচনা করে। ইসলামি অর্থব্যবস্থা ব্যতীত সুশীল সমাজ গঠন করা সম্ভব নয় বিধায় প্রাচ্যের রাষ্ট্রচিন্তা ইসলামি অর্থ ব্যবস্থা কী, ইসলামি অর্থব্যবস্থার বিষয়বস্তু, বৈশিষ্ট্য, গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা, উৎপাদন, বণ্টন, ইসলামি অর্থব্যবস্থার সাথে রাষ্ট্রীয় আয়ের উৎস, ব্যবসা বাণিজ্য, ব্যাংকিং ব্যবস্থা, পাশ্চাত্যের পুঁজিবাদী, সমাজতান্ত্রিক ও সাম্যবাদী অর্থব্যবস্থার সাথে ইসলামি অর্থব্যবস্থার পার্থক্য প্রভৃতি বিষয়ে প্রাচ্যের রাষ্ট্রচিন্তা আলোচনা করে।
৪. ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা
প্রাচ্যের রাষ্ট্রচিন্তায় ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার উপর যথেষ্ট গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। কৌটিল্য ও কনফুসিয়াস ন্যায়বিচারকে রাষ্ট্রব্যবস্থার ভিত্তি ও কেন্দ্র হিসেবে উল্লেখ করেছেন। মধ্যযুগের মুসলিম রাষ্ট্রচিন্তাবীদগণ কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার ক্রমিক চেষ্টা চালিয়েছেন। এভাবে প্রতীয়মান হয় যে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা প্রাচ্যের রাষ্ট্রচিন্তার অন্যতম বিষয়।
৫. গ্রিক রাষ্ট্রদর্শনের অনুশীলন
মধ্যযুগের মুসলিম রাষ্ট্রচিন্তাবিদগণ গ্রিক দর্শনের আলোকে নিজেদের মতবাদকে সাজিয়েছেন বিধায় আমরা প্রাচ্যের রাষ্ট্রদর্শন অধ্যয়নের ফলে গ্রিক রাষ্ট্রদর্শনের স্বরূপ জানতে পারি। উদাহরস্বরূপ বলা যায়, আল ফারাবীর রাষ্ট্রদর্শনে প্লেটোর রাষ্ট্র সংক্রান্ত ধারণাই নতুন রূপে ফুটে উঠেছে। একমাত্র গাজ্জালী ব্যতীত মধ্যযুগের ইবনে সিনা, ইবনে রুশদসহ সকল মুসলিম দার্শনিক ইসলামি ধর্মতত্ত্বে সাথে গ্রিক দর্শনের সমন্বয় সাধন করে যে সকল মতবাদ প্রদান করেন সেগুলো প্রাচ্যের রাষ্ট্রচিন্তার অন্যতম বিষয়।
আরও পড়ুন: প্রাচ্যের রাষ্ট্রচিন্তা কি? প্রাচ্যের রাষ্ট্রচিন্তার বৈশিষ্ট্য কি কি?
৬. রাজনৈতিক অবস্থা
প্রাচ্যের রাষ্ট্রচিন্তা ইসলামি রাজনৈতিক ব্যবস্থা নিয়েও আলোচনা করে। ইসলামি রাষ্ট্রের উপাদান ও গঠনপ্রণালি, ইসলামি রাষ্ট্রের গুরুত্ব ও উদ্দেশ্য, বৈশিষ্ট্য ও মৌলনীতি, ইসলামি রাজনৈতিক ব্যবস্থার সংজ্ঞা, ইসলামি রাজনীতি সম্পর্কে পাশ্চাত্যবাদীদের অভিমত, ইসলামি রাষ্ট্রব্যবস্থার সাথে পাশ্চাত্যের আধুনিক গণতান্ত্রিক, পুঁজিবাদী ও সমাজতান্ত্রিক রাজনৈতিক পদ্ধতির তুলনামূলক আলোচনা, ইসলামি রাষ্ট্রের আইনসভার গঠন ক্ষমতা ও কার্যাবলি, ইসলামি রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধানদের যোগ্যতা ও গুণাবলি, তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য প্রভৃতি বিষয় প্রাচ্যের রাষ্ট্রচিন্ত পর আলোচনার বিষয়।
৭. সামাজিক ব্যবস্থা
সামাজিক ন্যায়বিচার তথা আদর্শ সামাজিক ন্যায়বিচার সম্পর্কে প্রাচ্যের রাষ্ট্রচিন্তা আলোচনা করে। এক্ষেত্রে ন্যায়বিচারের সংখ্যা, আদর্শ সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা, ন্যায়বিচারের উপকারিতা, ন্যায়বিচারকে অধিকতর সুনিশ্চিত করার উপায়সমূহ নিয়ে প্রাচ্যের রাষ্ট্রচিন্তা আলোচনা করে। তাছাড়া প্রাচ্যের রাষ্ট্রচিন্তা একই সাথে আদর্শ সামাজিক ব্যবস্থাকে আরও সুন্দর করে তোলার জন্য সমাজ থেকে সকল অনাচার, অবিচার, চাঁদাবাজি, চুরি–ডাকাতি, সন্ত্রাস, দুর্নীতি, সুদ–ঘুষ, ছিনতাই, মাদকাসক্তিসহ নানাবিধ সামাজিক অপরাধসমূহ দূর করে আদর্শ ও সুশীল সমাজ গড়ে তোলার জন্য দিকনির্দেশনা দান করে।
৮. ইসলামি রাষ্ট্রচিন্তার মৌলিক ধারণা
প্রাচ্যের রাষ্ট্রচিন্তা ইসলামি রাষ্ট্রচিন্তার মৌলিক বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করে। যেমন– আল্লাহর একত্ববাদ, সৌভ্রাতৃত্ব, জাতীয়তাবাদ, সামাজিক সুবিচার, মানবাধিকার, ধর্মনিরপেক্ষতা, সার্বভৌমত্ব, আন্তর্জাতিকতাবাদ, সন্ত্রাসবাদ, খেলাফত এবং এর উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ প্রভৃতি মৌলিক ধারণা নিয়ে আলোচনা করে।
৯. যুদ্ধ, শান্তি ও নিরাপত্তা
সমাজে কীভাবে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা যায় প্রাচ্যের রাষ্ট্রচিন্তা তা নিয়ে আলোচনা করে। সমাজে তথা রাষ্ট্রে শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তা, ইসলামি রাষ্ট্রে ন্যায়বিচার বাস্তবায়নে জিহাদের গুরুত্ব, সেই সাথে বিশ্বকে অসঙ্গত যুদ্ধ থেকে মুক্ত রাখার ক্ষেত্রে ইসলামের সুস্পষ্ট দিক নির্দেশনা, বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বিশ্বকে শান্তিময় আবাসস্থল হিসেবে গড়ে তোলার ব্যাপারে প্রাচ্যের রাষ্ট্রচিন্তার রয়েছে সুস্পষ্ট নীতি ও নির্দেশনা।
১০. রাজতন্ত্রের প্রতি গুরুত্বারোপ
প্রাচ্যের রাষ্ট্রদর্শনে রাজতন্ত্রের প্রতি অধিক গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। চীনের কনফুসিয়াস পিতৃতুল্য রাজতান্ত্রিক সরকারের ধারণা প্রচার করেছেন। প্রাচীন ভারতের কৌটিল্যও কল্যাণকামী রাজার কথা বলেছেন। মুসলিম দার্শনিকগণ খিলাফত ও প্রথার কথা বললেও মূলত এটি ছিল রাজতন্ত্রেরই এক প্রকার সম্প্রসারিত রূপ। এভাবে দেখা যায় যে, প্রাচ্যের রাষ্ট্রচিন্তা অধ্যয়নের মাধ্যমে প্রাচীন রাজা বাদশাহদের শাসনব্যবস্থা, তাদের শান শওকত প্রভৃতি সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করা যায় ।
১১. আদর্শবাদ
আদর্শবাদ প্রাচ্যের রাষ্ট্রচিন্তার অন্যতম বিষয়বস্তু। কেননা, প্রাচীন চীনের রাষ্ট্রচিন্তায় নৈতিক আদর্শবাদের। প্রভাব যেমন ছিল লক্ষণীয়, তেমনি ভারতবর্ষে কৌটিল্যের রাষ্ট্রচিন্তায়ও আদর্শবাদের ধারণা মূর্ত হয়ে উঠেছিল ৷৷ একইভাবে মধ্যযুগের মুসলিম চিন্তাবিদদের রাষ্ট্রদর্শন ছিল ইসলামি ভাবাদর্শেরই সম্প্রসারিত রূপ। এসকল চিন্তাবিদ তাঁদের চিন্তাধারায় তথ্যের সত্যের চেয়ে বিষয়টি আদর্শের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ কিনা তার উপর অধিক গুরুত্বারোপ করেছেন।
১২. মানবতাবাদ / জনকল্যাণকামিতা
প্রাচ্যের রাষ্ট্রচিন্তার অন্যতম একটি দিক হলো মানবতাবাদ বা জনকল্যাণকামিতা। চীনের কনফুসিয়ানিজমে ব্যক্তির অধিকারকে সর্বোচ্চ অধিকার হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। মধ্যযুগের মুসলিম দার্শনিকদের রাষ্ট্রদর্শনে ইসলামি সর্বজনীন মানবতাবোধের প্রতিফলন লক্ষণীয়। আধুনিক ভারতের মানবেন্দ্রনাথ রায় যে বিজ্ঞানভিত্তিক রাষ্ট্রদর্শন গড়ে তোলেন তা র্যাডিক্যাল হিউম্যানিজম নামে পরিচিত। এর উপর ভিত্তি করেই র্যাডিক্যাল ডেমোক্র্যাসি নামে এক নতুন রাষ্ট্রদর্শন গড়ে উঠেছিল।
১৩. আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা সম্পর্কে
প্রাচ্যের রাষ্ট্রচিন্তার বিষয়বস্তু আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার আলোচনার ক্ষেত্রেরও পরিব্যাপ্ত। ইসলামের আলোকে আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা, বিশ্ব ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠা, বিশ্ব শান্তিতে মুসলিম জাতির প্রভাব এবং এক রাষ্ট্রের সহিত অন্য রাষ্ট্রের কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠায় প্রাচ্যের রাষ্ট্রচিন্তা আলোচনা করে।
১৪. ভারতীয় চিন্তাধারা সম্পর্কে আলোচনা
প্রাচ্যের রাষ্ট্রচিন্তায় ভারতীয় রাজনৈতিক চিন্তাধারা বিশেষ গুরুত্ব সহকারে বিবেচিত হয়ে থাকে। এরই অংশ হিসেবে প্রাচ্যের রাষ্ট্রচিন্তায় অতীশ দীপঙ্কর, কৌটিল্য, আবুল ফজল, নেহেরু, গান্ধী, ইকবাল, জিন্নাহ, এম. এন রায়, আবুল কালাম আজাদ প্রমুখ ভারতীয় রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর চিন্তাধারা ও জীবন পর্যালোচিত।
১৫. চৈনিক রাষ্ট্রচিন্তা সম্পর্কে পর্যালোচনা
প্রাচ্যের রাষ্ট্রচিন্তার একটি বিশেষ অংশ জুড়ে রয়েছে চীনা রাজনীতিবিদদের চিন্তাধারা এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের বিশ্লেষণ। বিশেষভাবে আলোচনা করা হয়েছে কনফুসিয়ানিজম এবং তাওবাদ সম্পর্কে। কেননা, চৈনিক রাজনৈতিক দর্শনের মূল উৎস হলো এই দুটি মতবাদ।
পরিশেষে বলা যায় যে, প্রাচ্যের রাষ্ট্রচিন্তা মানুষের ব্যক্তিগত জীবন থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন বিষয়কে অন্তর্ভুক্ত করে। এক্ষেত্রে ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক বা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সর্ব বিষয় প্রাচ্যের রাষ্ট্রচিন্তার আলোচ্য বিষয়। অর্থাৎ, মানবজীবনের এমন কোনো দিক নেই, যা প্রাচ্যের রাষ্ট্রচিন্তার আলোচ্যভুক্ত নয়।