প্রাচ্যের রাষ্ট্রচিন্তা
প্রাচ্যের যে সকল মনীষী বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে মৌলিক ধরনের রাষ্ট্রিক চিন্তা-ভাবনা করেছেন তাই প্রাচ্যের রাষ্ট্রচিন্তা হিসেবে পরিচিত। ভৌগোলিক অবস্থানগত দিক থেকে প্রাচ্য তথা এশিয়া এবং আফ্রিকার মিশরসহ মধ্যপ্রাচ্যকে প্রাচ্যভুক্ত করা গেলেও বৌদ্ধিক (Intellegentia) দিক দিয়ে অ–পাশ্চাত্য দেশসমূহ যথা এশিয়া, আফ্রিকা ও দঃ আমেরিকাও অ–পাশ্চাত্য তথা প্রাচ্য চিন্তামুক্ত।
প্রাচ্যের রাষ্ট্রচিন্তাকে ‘প্রাচীন, মধ্য এবং আধুনিক‘ এ ৰূপ যুগবিভাগে বিভাজিত করা যেতে পারে। প্রাচীনকালে চীনে কনফুসিয়াস, লাও–ৎসু, মেনসিয়াস প্রমুখ, ভারতে কৌটিল্য, মিশরে আমেনহোটেপ, প্রাচীন ব্যবিলনে হাম্বুরাবি, এ ধরনের অনেক চিন্তাবিদের সাক্ষাত পাওয়া যায়।
মধ্যযুগে হযরত মোহাম্মদ (সা.) প্রবর্তিত রাষ্ট্রব্যবস্থা রাষ্ট্রচিন্তার জগতে এক বিরাট আলোড়ন তোলে। তাই ইউরোপে যখন মধ্যযুগ অন্ধকারাচ্ছন্ন তখন মধ্যযুগে মধ্য এশিয়া ইসলামের আলোয় আলোকিত। তাই প্রাচ্যের মধ্যযুগ অন্ধকারাচ্ছন্ন ও অনুর্বর নয় বরং এ যুগে আল ফারাবী, ইবনে সিনা, আল–গাজ্জালী, ইবনে খালদুন, ইবনে রুশদ, নিজামুল মুলক তুসী প্রমুখ রাষ্ট্রচিভাবিদের আবির্ভাব ঘটে।
আরও পড়ুন: পাশ্চাত্যের রাষ্ট্রচিন্তা সম্পর্কে আলোচনা
প্রাচ্যের রাষ্ট্রচিন্তার আধুনিককাল ইউরোপের সম–সাময়িক নয়। বরং ইউরোপীয় উপনিবেশিক সংস্পর্শে আসার পর প্রাচ্যে আধুনিকতার ছোয়া লাগে। যে সমস্ত দেশ ইউরোপীয়দের সরাসরি উপনিবেশ ছিল সে সমস্ত দেশ তো বটেই যারা সরাসরি উপনিবেশ ছিল না সে সমস্ত দেশগুলোতেও যেমন জাপানে, চীনে ও অন্যান্য স্থানে পরোক্ষ প্রভাবে আধুনিকতার ছোয়া লাগে। প্রাচ্যে বিশেষ করে ভারতে রাষ্ট্রগুরু সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জী, এম, এন. রায়, মহাত্মা গান্ধী, আল্লামা ইকবাল, মোজাফফর আহমদ, অরবিন্দ ঘোষ, চীনে মাও সেতুং, দেং জিয়াও পিং, দঃ আমেরিকায় বাউল প্রেবিশ এ.জি. ফ্রাংক, আফ্রিকায় সামির আমিন, হামজা আলাভী, নকুমা, বাংলাদেশে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মাওলানা ভাসানী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রমুখ ব্যক্তিত্ব প্রাচ্যের রাষ্ট্রচিন্তায় অভূতপূর্ব অবদান রেখেছেন।
প্রাচ্যের রাষ্ট্রচিন্তার বৈশিষ্ট্যসমূহ
প্রাচ্যের রাষ্ট্রচিন্তার যে তিনটি যুগবিভাজন আমরা পূর্বে আলোচনায় করেছি তার মধ্যে কতকগুলো সাধারণ বৈশিষ্ট্য রয়েছে। যদিও পাশ্চাত্য পণ্ডিতগণ শুধুমাত্র প্রাচীনকালের ধর্ম নৈতিকতার বাণীগুলোকে উদ্ধৃত করে দেখাতে চান প্রাচ্যের রাষ্ট্রচিন্তা ধর্মতান্ত্রিক। কিন্তু আমরা দেখাব কৌটিল্যের লেখা যেখানে ধর্ম ও রাষ্ট্রনীতিকে এক করে দেখা হয় নি। তদ্রুপ মধ্যযুগে মুসলিম রাষ্ট্রচিন্তাবিদগণ প্লেটো, এরিস্টটলকে নতুনভাবে আবিষ্কার ও ব্যাখ্যা করে মুসলিম দর্শনের মধ্যে একটি নতুন সমন্বয়বাদী চিন্তার উন্মেষ ঘটান। আধুনিক যুগে সেকুলার রাষ্ট্রচিন্তার সাথে ধর্মাশ্রয়ী চিন্তা এখনও প্রাচ্যে কি পাশ্চাত্যে সবক্ষেত্রেই সক্রিয়। তাই দেখা যায় প্রাচ্যের রাষ্ট্রচিন্তায় পারস্পরিক বিপরীত বৈশিষ্ট্যও বিদ্যমান। নিম্নে প্রাচ্যের রাষ্ট্রচিন্তার কতকগুলো বৈশিষ্ট্য আলোচনা করা হলো:
১. নীতিবাদী রাষ্ট্রচিন্তা
নীতিবাদী রাষ্ট্রচিন্তা প্রাচ্যের রাষ্ট্রচিন্তার একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। পাশ্চাত্যের অনেক পণ্ডিত মনে করেন যে, প্রাচ্যের রাষ্ট্রচিন্তা যতটা না রাজনৈতিক তার চেয়ে অধিক হলো নৈতিক প্রকৃতির। রাজনীতি শব্দটি ব্যবচ্ছেদ করলেই দেখা যায় যে, রাজনীতি নীতির রাজা। অর্থাৎ নীতি ও রাষ্ট্র পরিচালনাকে প্রাচ্যে আলাদা করা হয়নি। সেটা প্রাচীন ভারতের মনুসংহিতা, কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র, কনফুসিয়াস লাও–ৎসু, এবং ইসলামের প্রতিটি কাজে নৈতিকতার বিধান কায়েমের নির্দেশের মধ্যে পাওয়া যায়।
ক. ভারতীয় রাজনীতি ও সংস্কৃতির সঙ্গে ধর্মের এবং নৈতিকতার গভীর যোগসূত্র রয়েছে। কৌটিল্য রাজাকে পরামর্শ দিচ্ছেন নৈতিক আচরণ করার জন্য। তার মতে, রাজাকে অর্থশাস্ত্রে বর্ণিত কৌশলগুলো বুঝতে হবে নৈতিকতার পরিপ্রেক্ষিতে যা মানুষকে স্বর্গের পথ দেখায়।
খ. প্রাচীন চীনে রাষ্ট্রদর্শনে নৈতিকতার সুস্পষ্ট প্রাধান্য লক্ষ করা যায়। কনফুসিয়াসের জীবন দর্শনে পাঁচটি নৈতিক কর্তব্যকে মূল ভিত্তি হিসেবে চিহ্নিত করেছেন যা Five chings নামে সুপরিচিত। তাওবাদ প্রচলিত আদর্শবাদী নৈতিকতার বিরুদ্ধে প্রাকৃতিক নৈতিক দর্শন শিক্ষা দিত। লাও-ৎসু রচিত ‘তাও–তে চিং‘ গ্রন্থের মূলসুর হলো সত্য বা নৈতিকতার পথ।
গ. মধ্যযুগের মুসলিম রাষ্ট্রদার্শনিকগণ রাষ্ট্রচিন্তার আলোচনায় ইসলামের নৈতিক শিক্ষাগুলোকে রাষ্ট্রে প্রতিপালনের উপর জোর দিয়েছেন। তারা রাষ্ট্রশাসককে পরহেজগারী ও আল্লাহভীতির কথা সর্বদা মনে করিয়ে দিচ্ছেন ।
২. ন্যায় বিচার ধারণার প্রাধান্য
প্রাচ্যের রাষ্ট্রচিন্তায় ন্যায় বিচার ধারণা প্লেটোর ধারণা থেকে কোনো অংশেই কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। কৌটিল্য তাঁর অর্থশাস্ত্রের তৃতীয় অধিকরণে রাজাকে আইন কার্যকর করার জন্য এবং বিচার ব্যবস্থার মাধ্যমে জনগণের জন্য ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য উপদেশ দিচ্ছেন। ন্যায়বিচারকে কৌটিল্যের রাষ্ট্রদর্শনের ভিত্তি বলা হয়। কনফুসিয়াসের রাষ্ট্রদর্শনে ন্যায়বিচার এবং ন্যায়পরায়ণ সরকারের ধারণা একটি অন্যতম বিষয়। তিনি মূলত ন্যায়পরায়ণ রাজার ধারণার প্রেক্ষিতেই রাজতন্ত্রকে পিতৃতুল্য সরকার ব্যবস্থা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। অর্থাৎ রাজা যতক্ষণ ন্যায়পরায়ণ ততক্ষণ রাজাকে মান্য করতে হবে নচেৎ নয়। ইসলামের রাষ্ট্রব্যবস্থার একটি কেন্দ্রীয় বিষয় হলো আদল বা ন্যায়বিচার। আর এর আলোকেই মধ্যযুগে মুসলিম দার্শনিকগণ ইসলামের ভিত্তি হিসেবে ন্যায়বিচার ধারণার যথাযথ বাস্তবায়নে তাদের রাষ্ট্রদর্শনে বৌদ্ধিক প্রচেষ্টা চালিয়েছেন।
৩. আদর্শবাদের প্রাধান্য
প্রাচ্যের রাষ্ট্রচিন্তার আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হিসেবে আদর্শবাদের প্রাধান্য লক্ষ্য করা যায়। প্রাচীন চীনের কনফুসীয় রাজনৈতিক চিন্তাধারায় নৈতিক আদর্শবাদের সুস্পষ্ট প্রভাব ছিল। প্রাচীন ভারতের কৌটিল্যের রাষ্ট্রচিন্তা ব্যাপকভাবে বাস্তববাদের উপর প্রতিষ্ঠিত হলেও সনাতন ব্রাহ্মণ্যবাদী ধর্মীয় ভাবাদর্শের উপরে উঠতে পারেনি। এমনকি এই আধুনিক যুগেও মহাত্মা গান্ধীর রাষ্ট্রদর্শন ও ধর্মীয় ভাবাদর্শিক আবেগ থেকে মুক্ত নয় । মধ্যযুগের মুসলিম রাষ্ট্রচিন্তাবিদদের রাষ্ট্রদর্শনকে অনেক পাশ্চাত্য পণ্ডিত ইসলামি ভাবাদর্শের সম্প্রসারিত রূপ বলে আখ্যায়িত করেন। মুসলিম দার্শনিকগণ ইসলামি আদর্শবাদের সঙ্গে গ্রিক রাষ্ট্রদর্শনের সমন্বয় সাধনের চেষ্টা করেছেন। তাঁরা প্লেটো, এরিস্টটলের কমেন্টারিগুলোতে বিভিন্ন টাকা সংযুক্ত করতেন; যেমন প্লেটোর দার্শনিক রাজার শাসনের সাথে খলিফা হযরত উমর (রাঃ) এর শাসনকে প্লেটোর দার্শনিক রাজার বাস্তব প্রতিফলন হিসেবে দেখিয়েছেন। তাঁরা তাঁদের চিন্তাধারায় তথ্যের সত্যের চেয়ে বিষয়টি আদর্শের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ কিনা এর উপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন বেশি।
আরও পড়ুন: মধ্যযুগের রাষ্ট্রচিন্তার বৈশিষ্ট্য সমূহ
৪. ধর্মের প্রাধান্য
ধর্ম সম্ভবত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে প্রাচ্যের রাষ্ট্রচিন্তায় স্থান দখল করে আছে। কনফুসীয় দর্শন প্রাচীন চীনে রাজনৈতিক জীবনে যেমন প্রাধান্য বিস্তার করেছিল পরবর্তীতে তা সমাজ জীবনে ধর্মীয় নীতি হিসেবে প্রভাব বিস্তার করেছিল। তাওবাদের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। মনুসংহিতা নামে আমরা যে গ্রন্থ পাই তা মূলত হিন্দুশাস্ত্র সম্পর্কিত আলোচনা। তবে এতে প্রাচীন ভারতে রাষ্ট্র দর্শনের সম্যক পরিচিতি লাভ করা যায়। কৌটিল্যের তৎকালীন প্রচলিত বৈদিক সমাজের প্রতি ছিল দৃঢ় বিশ্বাস এবং তিনি এই সমাজব্যবস্থার সারবস্তুকেই রাষ্ট্রযন্ত্রের মাধ্যমে বাস্তবায়নের চেষ্টা করেছেন। প্রাচীন ভারতের মনু–র মতোই কৌটিল্য রাষ্ট্রের উৎপত্তিকে দেখেছেন, ঐশ্বরিক ধারণার মাধ্যমে এবং ‘চরম রাজা‘ ধারণার পরিবর্তে ‘কল্যাণকামী রাজা‘ ধারণা ব্যক্ত করেছেন। কৌটিল নিজে শাসন কাজে সরাসরি অংশগ্রহণ করার কারণে তার রাষ্ট্রচিন্তায় বাস্তব অবস্থার চিত্র ও যুক্তিবাদিতা থাকলেও রাষ্ট্রের আদর্শ এবং নৈতিক ধারণাবলির ক্ষেত্রে তিনি হিন্দু ধর্মের প্রাধান্যকে অস্বীকার করেন নি। সামাজিক স্তরবিন্যাস বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে কৌটিল্য হিন্দু ধর্মের শোষণমূলক বর্ণব্যবস্থার সংরক্ষণকে রাষ্ট্রের অন্যতম কাজ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। মহাত্মা গান্ধীর সর্বোদয় আর সত্যাগ্রহ সবই ধর্ম উদ্ভূত চিন্তা। মুসলিম রাষ্ট্রদর্শনের মূল পবিত্র আল– কোরআন। পবিত্র কোরআনে ঘোষিত ‘ইন্নি জা‘য়িলুন ফিল আরদ্বি খালিফা‘ (কোরআন ২:৩০) অর্থাৎ নিশ্চয়ই আমি পৃথিবীতে আমার প্রতিনিধি প্রেরণ করব। মহান আল্লাহর এই প্রত্যাদিষ্ট সত্য তত্ত্বের ধারণাই সব মুসলিম রাষ্ট্রদার্শনিকদের মধ্যেই দেখা যায়। আল–ফারাবী জগৎ ও মানুষের মধ্যকার ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধকে দেখাবার চেষ্টা করেছেন। অধিবিদ্যা ও রাষ্ট্রদর্শনের সম্বন্ধের মধ্যে দিয়ে। এ প্রসঙ্গে আল–ফারাবী বলেন, আমরা যাকে রাষ্ট্রদর্শন ও নীতিবিদ্যা বলি তা অধিবিদ্যা ও ধর্মতত্ত্বেরই সম্প্রসারণ।
৫. অভিজ্ঞতাবাদী
প্রাচ্যের রাষ্ট্রচিন্তায় নৈতিকতা ও আদর্শবাদের প্রাধান্য থাকলেও অভিজ্ঞতাবাদী বিশ্লেষণ পদ্ধতির ব্যবস্থাও দৃশ্যমান। চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের প্রধানমন্ত্রী কৌটিল্য যে অর্থশাস্ত্র রচনা করেছেন তার প্রধান উপাদান তার রাষ্ট্রশাসনের বাস্তব অভিজ্ঞতা। যে কারণে তিনি সরকার কাঠামোর সুসংহত ধারণা উপস্থাপন করতে পেরেছেন। উপনিষদ, মহাভারত থেকে উদ্ধৃতি থাকলেও সংহত রাষ্ট্র কাঠামো গড়ে তোলার প্রত্যয়ে সরকার ও প্রশাসন কাঠামো (State Craft) সম্পৰ্ক, কার্যাবলি, দায়বদ্ধতার ক্ষেত্রে অভিজ্ঞতালব্ধ ধারণাকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। কনফুসীয় দর্শনেও অভিজ্ঞতাবাদের প্রভাব দৃশ্যমান। মধ্যযুগের মুসলিম রাষ্ট্র দার্শনিক নিজামুল মূলক তুসী‘র রাজনৈতিক চিন্তাধারায় ধর্মীয় নৈতিকতাবোধের সঙ্গে অভিজ্ঞতাবাদের সমন্বয় পরিলক্ষিত হয়। জাপানে মেইজি রেস্টোরেশনে (Meiji Restoratain) অভিজ্ঞতাবাদ সুস্পষ্ট প্রতীয়মান।
৬. মানবতাবাদী
প্রাচ্যের রাষ্ট্রচিন্তায় মানবতাবাদের অনেক উপাদান লক্ষ করা যায়। প্রাচীন চীনে কনফুসীয় রাষ্ট্রদর্শনকে অনেকে পরিপূর্ণ মানবতাবাদী দর্শন হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। কনফুসীয় দর্শনে ব্যক্তির অধিকারকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। রাজার সামগ্রিক কার্যাবলিকে জনগণের কল্যাণের ধারণার সঙ্গে যুক্ত করে বিশ্লেষণ করা হয়েছে। কৌটিল্যের রাষ্ট্র দর্শনেও মানবতার সুর ধ্বনিত হয়। মধ্যযুগের মুসলিম দার্শনিকদের রাষ্ট্রদর্শনে ইসলামের সার্বজনীন মানবতাবোধের প্রতিফলন দেখা যায়। তাকওয়া বা আল্লাহভীতিসহ নৈতিক গুণাবলিকে খলিফা বা রাষ্ট্রপ্রধান হওয়ার একমাত্র সূচক হিসেবে চিহ্নিতকরণের মধ্যে মানবতাবাদ এবং কল্যাণকামী রাষ্ট্র ধারণার প্রতিফলন লক্ষ করা যায়। আধুনিককালে ভারতের এম. এন. রায় এক বিজ্ঞানভিত্তিক বলিষ্ঠ মানবতাবাদী দর্শন গড়ে তোলেন, যা Radical Humanism’ নামে পরিচিত। এই মানবতাবাদী দর্শনকে রাষ্ট্রব্যবস্থায় বাস্তবায়নের জন্য তিনি ‘Radical Democracy’ নামে রাজনৈতিক ব্যবস্থা ভিত্তিক রাষ্ট্রদর্শন গড়ে তোলেন।
৭. ইসলামি ধর্মতত্ত্বের সঙ্গে গ্রিক দর্শনের সমন্বয়ের প্রবণতা
মধ্যযুগের প্রাচ্যের রাষ্ট্রচিন্তা ইসলামের আলোয় উদ্ভাসিত। ইসলামের মূল স্পিরিট বুকে ধারণ করে তাঁরা প্লেটো, এরিস্টটলের বইগুলোর নতুন নতুন ব্যাখ্যা আবিষ্কার করেন। তাঁদের রাষ্ট্র দর্শন পর্যালোচনা করলে একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হিসেবে ইসলামি ধর্মতত্ত্বের সঙ্গে গ্রিক দর্শনের সমন্বয়ের প্রবণতা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। আল–ফারাবীর দর্শনে প্লেটোর ব্যক্তি ও রাষ্ট্র সংক্রান্ত ধারণাই লাভ করে এক নবতর রূপে। ব্যক্তি ও রাষ্ট্রের এই সম্বন্ধের আলোকেই তিনি উদ্ঘাটন করেছেন মানুষ ও জগতের সম্বন্ধকে আল–ফারাবীর রাষ্ট্রদর্শনে স্টোয়িকবাদের প্রতিধ্বনি শোনা যায়। সার্বিকভাবে বলা যায় যে, একমাত্র আল–গাজ্জালী ব্যতীত মধ্যযুগের ইবনে সিনা, ইবনে রুশদ প্রমুখ সকল দার্শনিকই ইসলামি ধর্মতত্ত্বের সঙ্গে গ্রিক দর্শনের সমন্বয় সাধনে তৎপর ছিলেন।
৮. শাসনব্যবস্থা হিসেবে রাজতান্ত্রিক ধারণার প্রাধান্য
প্রাচ্যের রাষ্ট্রচিন্তার কল্যাণকামী রাজার ধারণার মাধ্যমে মূলত রাজতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার ধারণাই স্বীকৃতি লাভ করে। তাই ইউরোপীয় ভ্রমণকারীদের লেখায় Oriental Despotism বা প্রাচ্য একনায়কতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থা নামে পরিচিতি লাভ করে। কনফুসিয়াস রাজতন্ত্রকেই সর্বোত্তম শাসন ব্যবস্থা হিসেবে চিহ্নিত করে রাজার ভূমিকাকে রাজতান্ত্রিক পিতৃয়তা (Kingship Paternalism) ধারণার মাধ্যমে প্রকাশ করেন। কনফুসিয়াস মনে করেন, রাজনৈতিক দিক দিয়ে পিতৃতুল্য রাজতান্ত্রিক‘ সরকারের ধারণাই সমর্থনযোগ্য। কৌটিল্য ও কল্যাণকামী রাজার ধারণার মাধ্যমে তাঁর রাষ্ট্রদর্শনের বিকাশ সাধন করেন। মধ্যযুগের মুসলিম রাষ্ট্র দর্শনিকগণ আল্লাহর প্রতিনিধি ভিত্তিক খেলাফত ব্যবস্থার কথা বললেও প্রতিষ্ঠিত খলিফা বা সরকারের বিরুদ্ধাচরণকে নিরুৎসাহিত করেছেন যা রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে রাজতান্ত্রিক ধরনের।
৯. সুশাসন ব্যবস্থার গুরুত্বারোপ
সাধারণভাবে পাশ্চাত্য লেখকদের লেখায় দেখা যাবে প্রাচ্যের একনায়ক শাসক বা রাজাদের স্বেচ্ছাচারিতা উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু গভীরভাবে লক্ষ করলে দেখা যাবে যে প্রাচ্যের রাজনৈতিক বর্তমান কালের বহুল আলোচিত সুশাসন ধারণা প্রচলিত ছিল। তা কনফুসিয়াস থেকে শুরু করে মহাত্মা গান্ধী এমনকি বঙ্গবন্ধু পর্যন্ত। কনফুসিয়াস সুশাসন নিশ্চিত করতে রাজাকে সম্ভব সব রকমের ব্যবস্থা গ্রহণে উপদেশ দিয়েছেন। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রের বিভিন্ন অধ্যায়ে সুশাসন নিশ্চিতকরণে রাজাকে বিভিন্ন উপদেশ বিধৃত হয়েছে। যেমন–মন্ত্রী, অমাত্য, গোয়েন্দা নিয়োগ থেকে শুরু করে জনগণের অভাব অভিযোগ সরাসরি শুনতে তিনি রাজাকে উৎসাহিত করেন। হযরত উমর (রা🙂 এর সুশাসন দ্বারা উদ্বুদ্ধ মুসলিম রাষ্ট্রদার্শনিকগণ তাঁদের লেখনিতে যে কোনো ধরনের শাসন ব্যবস্থায় সুশাসন ধারণার উপর জোর দিয়েছেন।
আরও পড়ুন: রাষ্ট্রচিন্তা কি? রাষ্ট্রচিন্তায় এরিস্টটলের অবদান আলোচনা
১০. রক্ষণশীলতা
রক্ষণশীলতাকে প্রাচ্যের রাষ্ট্রচিন্তার একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হিসেবে উল্লেখ করা যায়। কৌটিল্য, কনফুসিয়াস, মহাত্মা গান্ধী এবং মধ্যযুগের মুসলিম দার্শনিকগণ কোনো বৈপ্লবিক রাষ্ট্রদর্শন উপস্থাপন করেন নি বা বিদ্যমান সমাজ ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তনের কথাও বলেননি। কনফুসিয়াস সমাজব্যবস্থার সীমিত পরিবর্তনকে সমর্থন করলেও আমূল পরিবর্তনের ধারণাকে সমর্থন করেননি। কৌটিলা তৎকালীন প্রচলিত বর্ণ বৈষম্যভিত্তিক সমাজব্যবস্থার সংরক্ষণের পক্ষে মত প্রকাশ করেছেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এমনকি ব্রিটিশ প্রশস্তি গেয়ে ব্রিটিশ শাসনের পক্ষে মত প্রকাশ করেন।
১১. জনকল্যাণকামিতা
প্রাচ্যের রাষ্ট্রচিন্তায় জনকল্যাণকামী দিকটি স্পষ্ট হয়ে উঠে। প্রাচীন ভারতের মনুর মতোই কৌটিল্য রাষ্ট্রের উৎপত্তিকে ঈশ্বরিক ধারনার মাধ্যমে এবং চরম রাজা ধারণার পরিবর্তে কল্যাণকামী রাজা এর ধারণা ব্যক্ত করেছেন। চীনের কনফুসিয়াস ব্যক্তির অধিকারকে সর্বোচ্চ অধিকার হিসেবে ঘোষণা করেছেন। আধুনিক যুগে ভারতের মানবেন্দ্রনাথ রায় “রেডিক্যাল হিউম্যানিজম” নামের যে বিজ্ঞানভিত্তিক রাষ্ট্রদর্শন গড়ে তোলেন তা রূপ লাভ করে ব্যাডিক্যাল ডেমোক্রাসিতে।
১২. ইসলামি মৌলিকত্ব
ইসলামি রাষ্ট্রচিন্তার মৌল ধারণা প্রাচ্যের রাষ্ট্রচিন্তার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। যেমন: সামাজিক সুবিচার, মৌলিক মানবাধিকার, তাওহীদ বা আল্লাহর একত্ববাদ, স্বাধীনতা, সাম্য, সৌভ্রাতৃত্ব, উম্মাহ তথ্য জাতীয়তাবান, আন্তর্জাতিকতাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ, মৌলবাদ, ইসলামে সার্বভৌমত্বের অর্থ ও এর অবস্থান, খিলাফত, এর উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ ইত্যাদি সম্পর্কে জ্ঞান লাভের জন্য প্রাচ্যের রাষ্ট্রচিন্তা পাঠ করা প্রয়োজন।
১৩. ইসলামি অর্থব্যবস্থা
ইসলামি অর্থব্যবস্থা প্রাচ্যের রাষ্ট্রচিন্তার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। ইসলামি অর্থব্যবস্থা ব্যতীত সুশীল সমাজ গঠন করা সম্ভব নয় বিধায় প্রাচ্যের রাষ্ট্রচিন্তা ইসলামি অর্থব্যবস্থা কী, ইসলামি অর্থব্যবস্থার বিষয়বস্তু, বৈশিষ্ট্য,
গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা, উৎপাদন, বণ্টন, ইসলামি অর্থব্যবস্থার সাথে রাষ্ট্রীয় আয়ের উৎস, ব্যবসা বাণিজ্য, ব্যাংকিং ব্যবস্থা, পাশ্চাত্যের পুঁজিবাদী, সমাজতান্ত্রিক ও সাম্যবাদী অর্থব্যবস্থার সাথে ইসলামি অর্থব্যবস্থার পার্থক্য প্রভৃতি
বিষয়ে প্রাচ্যের রাষ্ট্রচিন্তা আলোকপাত করে।
১৪. শান্তি বাণী ঘোষণা
শান্তিময় পরিস্থিতি বজায় রাখা এবং শান্তি সম্পর্কে আলোচনা করা প্রাচ্যের রাষ্ট্রচিন্তার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। সমাজে তথা রাষ্ট্রে শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তা, ইসলামি রাষ্ট্রে ন্যায়বিচার বাস্তবায়নে জিহাদের গুরুত্ব, সেই সাথে বিশ্বকে অসঙ্গত যুদ্ধ থেকে মুক্ত রাখার ক্ষেত্রে ইসলামের সুস্পষ্ট দিক নির্দেশনা, বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বিশ্বকে শান্তিময় আবাসস্থল হিসেবে গড়ে তোলার ব্যাপারে প্রাচ্যের রাষ্ট্রচিন্তার রয়েছে সুস্পষ্ট নীতি ও নির্দেশনা।
১৫. আন্তর্জাতিকতা
আন্তর্জাতিকতা প্রাচ্যের রাষ্ট্রচিন্তার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। ইসলামের আলোকে আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা, বিশ্বভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠা, বিশ্ব শান্তিতে মুসলিম জাতির প্রভাব এবং এক রাষ্ট্রের সহিত অন্য রাষ্ট্রের কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠায় প্রাচ্যের রাষ্ট্রচিন্তা আলোচনা করে।
উপরোক্ত বৈশিষ্ট্যের মধ্যেই প্রাচ্যের রাষ্ট্রচিন্তার বৈশিষ্ট্যগুলো সীমাবদ্ধ রাখা যাবে না। আরো অনেক বৈশিষ্ট্যই খুঁজে পাওয়া যেতে পারে। তবে এত বড় প্রাচ্য এলাকায় সাধারণ বৈশিষ্ট্য খুঁজে পাওয়া দুস্কর। একেক এলাকায় একেক ধরনের বৈশিষ্ট্য থাকাতে তা কখনো কখনো পারস্পরিক বিরোধপূর্ণ বৈশিষ্ট্যও পাওয়া যেতে পারে। এভাবে প্রাচ্যের রাষ্ট্রচিন্তার ঐতিহাসিক বিকাশ প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন প্রবণতা পুষ্ট হয়ে প্রাচ্যে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন মৌলিক রাষ্ট্রদর্শনের এক সমৃদ্ধ সম্ভার।