রাষ্ট্রচিন্তা কি
রাষ্ট্রচিন্তা একটি ব্যাপক ধারণা এবং সতত পরিবর্তনশীল একটি প্রক্রিয়া। সাধারণ অর্থে রাষ্ট্রচিন্তা বলতে রাষ্ট্র সম্পর্কে বিভিন্ন মনীষীদের বিভিন্ন মতবাদকে বুঝায়।
অন্যকথায় রাষ্ট্র এবং রাষ্ট্রের আনুষঙ্গিক বিষয়াদি সম্পর্কে যুগে যুগে বিভিন্ন পণ্ডিত, মনীষী এবং রাষ্ট্রচিন্তাবিদদের যে ভাবনা চিন্তা ইতিহাসে স্থান লাভ করেছে তাই রাষ্ট্রচিন্তা নামে অভিহিত। বিভিন্ন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বিভিন্নভাবে রাষ্ট্রচিন্তার সংজ্ঞা প্রদান করেছেন। নিম্নে এ সংক্রান্ত কয়েকটি প্রামাণ্য সংজ্ঞা প্রদান করা হলো :
অধ্যাপক হারমান হেলার এর মতে, “রাষ্ট্রচিন্তা রাষ্ট্রের স্থিতিশীল পর্যায়গুলো আলোচনা করে।”
হেনরি বি. মেরো (Henry B. Mayro) এর মতে, “রাজনৈতিক চিন্তাধারা কোনো বিশেষ সময়ে কোনো বিশেষ জনসমাজের ভাবধারা ও বিশ্বাসসমূহের প্রতি ইঙ্গিত করে। যেসব রাজনৈতিক ধারণা নিয়ে কোনো জনসমাজ বেঁচে থাকে, তাই রাজনৈতিক চিন্তাধারা। অন্যকথায় রাষ্ট্রচিন্তা হলো কোনো যুগের বা কালের রাজনৈতিক ধারণার সমষ্টি।“
অধ্যাপক ওরোপার (Prof. Wayper) এর মতে, “রাষ্ট্রচিন্তা বলতে বুঝায় সে মতবাদ– যা রাষ্ট্রের গঠন, প্রকৃতি ও উদ্দেশ্য নিয়ে আলোচনা করে।” তিনি আরো বলেন, “সামাজিক জীব হিসেবে মানুষের আচরণের নৈতিক দিকগুলোও এর আলোচ্য বিষয়। কেননা, রাষ্ট্রের নাগরিকদের নৈতিকতাবোধ ও সামাজিক মূল্যবোধ সরকারের প্রকৃতি ও উদ্দেশ্যকে অনেকখানি প্রভাবিত করে।”
অধ্যাপক ফিলিপ ডোয়েল (Prof. Philip Doyle) এর মতে, রাউতিস্তার বিষয়বস্তু প্রধানত তিনটি ক্ষেত্রে পরিব্যাপ্ত। যেমন:
১. মানব প্রকৃতি ও তাঁর কার্যকলাপ;
২. জীবনের সমগ্র অনুভূতির জন্য পৃথিবীর অপরাপর বিষয়ের সাথে মানুষের সম্পর্ক;
৩. সমাজের সদস্য হিসেবে মানুষের পারস্পরিক সম্পর্ক।
অধ্যাপক আর্নেস্ট বার্কার (Prof. Ernest Barker) এর মতে, “Political theory is the speculation of particular thinkers which may be remote from actual fact of the time, political thought is the imminent philosophy of the whole age.”
অধ্যাপক আর. জি. গ্যাটেল (Prof. R. G. Gettel) বলেন, “Political thought represent a high type of intellectual achivement and like other forms of philosophical thought, has an interest and value entirely apart from any practical application of its principles. Intillegent men naturally wish to understand the authority under which they live, to analyse its organization and its activities and speculate concerning the best form of political existence.”
পরিশেষে বলা যায় যে, রাষ্ট্র, রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে বিভিন্ন রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান, সামাজিক প্রাণী হিসেবে মানুষের কার্যকলাপ এবং মানুষের সাথে সমাজের পারস্পরিক সম্পর্কের বিষয়ে যুগে যুগে বিভিন্ন মনীষী যে তত্ত্ব প্রদান করেছেন তাকেই রাষ্ট্রচিন্তা বলে।
আরও পড়ুন: মধ্যযুগের রাষ্ট্রচিন্তার বৈশিষ্ট্য সমূহ আলোচনা কর
রাষ্ট্রচিন্তায় এরিস্টটলের অবদান
রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও রাষ্ট্রতত্ত্বের ক্ষেত্রে এরিস্টটলের অবদান অতুলনীয়। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এরিস্টটলের এই অতুলনীয় অবদানের জন্য এরিস্টটলকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের জনক হিসেবে অভিহিত করা হয়ে থাকে। নিম্নে এসম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।
১. রাষ্ট্রবিজ্ঞানকে বিজ্ঞানের মর্যাদা দান
এরিস্টটল সর্বপ্রথম রাষ্ট্রবিজ্ঞানকে নীতিশাস্ত্র থেকে পৃথক করে একটি স্বতন্ত্র বিজ্ঞানের মর্যাদা প্রদান করেন। তিনি রাষ্ট্রবিজ্ঞানকে ‘সর্বশ্রেষ্ঠ বিজ্ঞান‘ বলেও অভিহিত করেন। বর্তমান রাষ্ট্রবিজ্ঞান তারই সুচিন্তিত ও বৈজ্ঞানিক চিন্তার ফলস্বরূপ ।
২. নিয়মতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার প্রবর্তক
এরিস্টটলের মতে, নাগরিকদের প্রণীত শাসনতন্ত্রের উপর রাষ্ট্রীয় প্রশাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়া উচিত। তিনি বিশ্বাস করতেন, জনসাধারণের সামগ্রিক কল্যাণ সাধন জনগণের শাসনব্যবস্থার মাধ্যমেই সম্ভব।
৩. আইনের শাসনের প্রতি গুরুত্বারোপ
এরিস্টটল আইনের শাসনের প্রতিও যথেষ্ট গুরুত্বারোপ করেন। তার মতে, আইন যেখানে শাসন করে না, সেখানে কোনো শাসন ব্যবস্থার অস্তিত্ব থাকে না। যে কারণে সকলের উপরই আইনের শাসন প্রয়োগ হওয়া আবশ্যক। সমগ্র রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাকে আইনের ভিত্তিমূলে প্রতিষ্ঠিত করে তিনি আইনের গুরুত্ব অত্যধিক বৃদ্ধি করেছেন।
৪. ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির প্রবক্তা
এরিস্টটল ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির প্রবর্তন করে সরকারের স্বৈরাচারী প্রবণতা রোধ করতে সচেষ্ট হন। তিনি বলেন, ক্ষমতার স্বতন্ত্রীকরণের মাধ্যমে রাষ্ট্রের প্রত্যেক নাগরিক বিশেষভাবে উপকৃত এবং রাজনৈতিক শিক্ষা লাভ করবে। আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানীগণ এরিস্টটলের এই ধারণার সাথে সম্পূর্ণভাবে একমত পোষণ করেন।
৫. বিপ্লব তত্ত্ব
এরিস্টটলের মতে, মানুষ যখন তাঁর ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হয় তখনই সে বিপ্লবে ঝাঁপিয়ে পড়ে। বিপ্লব সম্পর্কিত তাঁর এই ধারণা আজও অম্লান। তাছাড়া তিনি বিপ্লব প্রতিরোধের উপায় এবং রাষ্ট্র ও সরকারের স্থায়িত্ব প্রসঙ্গে যেসব উপায়ের উল্লেখ করেছেন তার গুরুত্ব আজও হ্রাস পায়নি।
৬. শিক্ষার উপর গুরুত্বারোপ
তাঁর মতে, শিক্ষার মাধ্যমে আদর্শ নাগরিকত্ব গড়ে তোলা সম্ভব বিধায় তিনি শিক্ষার উপর গুরুত্বারোপ করেন। তিনি রাষ্ট্রের মধ্যে ধনী ও দরিদ্রের ভারসাম্য রক্ষা করার জন্য একটি শক্তিশালী মধ্যবিত্ত শ্রেণি
গঠনের সুপারিশ করেছেন।
৭. পরবর্তী চিন্তা ও দর্শনে প্রভাব
পরবর্তীকালে এরিস্টটলের চিন্তাধারা ও রাষ্ট্রদর্শনকে অনুসরণ করে বিভিন্ন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বিভিন্ন তত্ত্ব প্রদান করেছেন। যে কারণে তাকে জ্ঞানী ব্যক্তিদের শিক্ষক বলা হয়ে থাকে।
- মধ্যযুগীয় দার্শনিক সেন্ট টমাস একুইনাস মধ্যযুগীয় চিন্তাধারাকে এরিস্টটলের চিন্তাধারার মধ্যে সমন্বয় সাধন করেন।
- মার্সিলিও অব পাদুয়া ও দান্তের চিন্তাধারার মধ্যেও এরিস্টটলের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়।পদ্ধতি ও দৃষ্টিভঙ্গির দিক থেকে আধুনিক যুগের দার্শনিক ম্যাকিয়াভেলী তাঁর ‘দি প্রিন্স‘ নামক রাজনৈতিক গ্রন্থটি রচনার অনুপ্রেরণা লাভ করেন এরিস্টটলের বিপ্লব সম্পর্কিত ধারণা থেকে।
- দার্শনিক হেগেল সংবিধান সম্পর্কিত মতবাদে এরিস্টটলের সংবিধান সম্পর্কিত ধারণার সঙ্গে একাত্মতা পোষন করেন।
- একথাও বলা যায় যে, কার্ল মার্কসের শ্রেণি সংগ্রাম ধারনার পূর্বাভাসও এরিস্টটলের চিন্তা হতে পাওয়া যায়। কেননা, ধনী ও দরিদ্র যে দুটি পরস্পর বিবদমান শ্রেণি, এরিস্টটল তা দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে ঘোষনা করে গেছেন।
উপরোক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে বলা যায় যে, আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তার ক্ষেত্রে এরিস্টটলের অবদান অনস্বীকার্য। যে কারণে এরিস্টটলের মতবাদকে বাদ দিলে রাষ্ট্রবিজ্ঞান অসম্পূর্ণ থেকে যায়। ফলে এরিস্টটলকে আমরা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের জনক হিসেবে অভিহিত করতে পারি।