মধ্যযুগের রাষ্ট্রচিন্তার বৈশিষ্ট্য সমূহ
রাজনৈতিক চিন্তার ইতিহাসে মধ্যযুগ গুরুত্বপূর্ণ হলেও মধ্যযুগের রাষ্ট্রচিন্তা ছিল ধর্মভিত্তিক চিন্তাধারায় আচ্ছন্ন, পার্থিব বিষয়ে নীরব এবং বিজ্ঞান বিমুখ। যে কারণে গ্রিক দর্শনের সাথে মধ্যযুগের দার্শনিক চিন্তার কোনো সাদৃশ্য পরিলক্ষিত হয়নি বিধায় মধ্যযুগে রাষ্ট্রচিন্তার ইতিহাসে এক প্রকার বন্ধ্যাত্বের অবস্থা বিরাজ করে। আর এটাও চরম সত্য যে, তৎকালীন সময়ে রাষ্ট্রচিন্তার পরিবর্তে ধর্মচিন্তাই ছিল প্রধান আলোচ্য বিষয়। ফলে সমালোচকরা মধ্যযুগকে অন্ধকার যুগ এবং অবৈজ্ঞানিক ও অরাজনৈতিক বলে আখ্যায়িত করে থাকেন।
মধ্যযুগে ইউরোপীয় রাষ্ট্রচিন্তা মূলত ধর্ম তথা যাজকদের কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয়েছে। যে কারণে মধ্যযুগকে বলা হয়ে থাকে যে, এটি মূল অরাজনৈতিক ও অসৃজনশীল যুগ। মধ্যযুগ সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে হলে আমাদেরকে মধ্যযুগের কয়েকটি বৈশিষ্ট্যের দিকে নজর দিতে হবে:
১. বিশ্বজনীনতাবাদ
বিশ্বজনীনতাবাদ হলো মধ্যযুগের রাষ্ট্রচিন্তার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। কেননা, সমগ্র বিশ্বজুড়ে সে এক সর্বজনীন সমাজ– এ ধারণা সমগ্র মধ্যযুগব্যাপী প্রাণবন্ত ছিল। রোমান সাম্রাজ্য ভৌগোলিক সীমানাকে স্বীকার করেনি। রোমান সাম্রাজ্যের একমাত্র সরকারি ধর্ম হিসেবে খ্রিষ্টান ধর্ম স্বীকৃতি লাভের পর রোমানদের এই বিশ্বান আরো দৃঢ় হয় যে, তাদের সাম্রাজ্য দৈব অভিপ্রায়েরই অভিব্যক্তি এবং তা শ্বাশত ও বিশ্বজনীন হতে বাধ্য। বস্তুত কোন সাম্রাজ্যের মাধ্যমেই খ্রিষ্টীয় গির্জা একটি বিশ্বজনীন সংগঠনে পরিণত হয়।
২. ধর্মীয় বিশ্বাস
সমগ্র মধ্যযুগব্যাপী একমাত্র ধর্মীয় বিশ্বাসই ছিল মানুষকে পরিচালিত করার চালিকাশক্তি। যুক্তির চেয়েও প্রবলতর ছিল ধর্মীয় বিশ্বাস এবং এর বাইরে মানুষ কিছু চিন্তাও করতে পারত না। খ্রিষ্টীয় নীতি দ্বারা মানুষের কাজ ও চিন্তাধারা গভীরভাবে প্রভাবিত ছিল। বলা যায়, মধ্যযুগ ছিল ধর্মশাসিত যুগ ।
৩. ধর্মের সাথে রাজনীতির সমন্বয়
মধ্যযুগে রাজনীতি ও ধর্মের মধ্যে যে যোগসূত্র সাধিত হয়েছিল তার জের সুদীর্ঘকাল পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। এ যুগে বিশ্বাস করা হতো যে, ধর্মীয় নির্দেশে ও অভিভাবকত্বে রাজনীতি পরিচালিত হবে। রাজনৈতিক সমাজের সদস্য হতে হলে কোনো ব্যক্তিকে প্রথমে হতে হতো একজন খ্রিস্টান।
৪. পোপের প্রাধান্য
মধ্যযুগে প্রচলিত নীতি অনুসারে যাজকগণ ছিলেন সমাজের প্রভাবশালী ব্যক্তি, আবার সবার উপরে নির্ধারিত হতো পোপের স্থান। অপ্রতিরোধ্য ক্ষমতার অধিকারী পোপের নির্দেশেই সকলে পরিচালিত হতো। এমনকি রাজার ন্যায় অন্যায়ের বিচারের ভারও পোপের উপরই ন্যস্ত ছিল।
৫. গির্জার অধীন রাষ্ট্র
রাষ্ট্রের সঙ্গে গির্জার সম্পর্কের প্রশ্নে মধ্যযুগের রাষ্ট্রচিন্তায় আমরা এক অভিনব সত্যের সন্ধান পাই। আর সেটা হচ্ছে রাষ্ট্র গির্জার অধীন। কোনো ব্যক্তি যদি কোনোক্রমে খ্রিষ্ট ধর্মচ্যুত হতেন তবে তার রাষ্ট্রীয় অধিকারও লোপ পেত। অর্থাৎ মধ্যযুগের রাষ্ট্রের সার্বভৌম ও স্বাতন্ত্র্যের বিষয়টি পোপের স্বীকৃতি লাভ করেনি। অথচ অন্যান্য যুগের রাষ্ট্রচিন্তায় দেখা যায় গির্জা রাষ্ট্রের অধীন।
আরও পড়ুন: আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তার জনক কে? আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তায় ম্যাকিয়াভেলীর অবদান
৬. রাষ্ট্র বনাম গির্জার দ্বন্দ্ব
মধ্যযুগের রাষ্ট্রচিন্তার ইতিহাস হচ্ছে রাষ্ট্র বনাম গির্জার পারস্পরিক দ্বন্দ্বের ইতিহাস। মধ্যযুগের অন্যতম চিন্তাবিদ সেন্ট অগাস্টিন গির্জাকে রাষ্ট্রের উপরে স্থান দিয়েছেন। পোপ গ্রেগরী চার্চকে পরিণত করেছেন বিজয়ী, শক্তিকেন্দ্র ও প্রভাব প্রতিপত্তির প্রতীক হিসেবে। অন্যদিকে দান্তে, মারসিলিও, উইলিয়াম এবং জন প্রমুখেরা রাষ্ট্রের কর্তৃত্ব প্রমাণ করার জন্য গির্জাকে তার সুউচ্চ স্থান থেকে নামিয়ে রাষ্ট্রের আজ্ঞাবহ করেছেন।
৭. পুরাতন টেস্টামেন্টকে অধিকতর গুরুত্ব প্রদান
পোপ তার প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে নতুন টেস্টামেন্ট (New Testament) অপেক্ষা পুরাতন টেস্টামেন্টকে (Old Testament) অধিকতর উপযোগী বলে মনে করে এর বাণী সমূহকে কাজে লাগাবার চেষ্টা করেন। রাষ্ট্র সংক্রান্ত ব্যাপারে পুরাতন টেস্টামেন্টের শিক্ষা হলো এই যে, আইন খোদার ইচ্ছার প্রত্যক্ষ অভিব্যক্তি, সরকারি শাসনের ব্যাপারে সাধারণ কর্মচারীদের চেয়ে পুরোহিতদের গুরুত্ব অধিক, যাজকতন্ত্রের ঐতিহ্য অনুসারে রাজার ক্ষমতা সীমিত, যে সকল রাজা নবী ও পয়গম্বরদের অধিক অনুগত তারা পার্থিব জীবনে অধিক সাফল্যের অধিকারী এবং সর্বোপরি আধ্যাত্মিক ক্ষমতার কাছে পার্থিব ক্ষমতার অধীনতা বিধাতার শাসন পরিকল্পনারই একটি অংশ।
৮. দুই তরবারি তত্ত্ব
সম্রাট ও পোপের ক্ষমতার প্রাধান্যকে ভিত্তি করে পঞ্চম শতাব্দীতে পোপ প্রথম গেলাসিয়াম ‘দুই তরবারি তত্ত্ব‘ প্রদান করেন। তার নামানুসারে এই তত্ত্ব ‘গেলাসিয়ান তত্ত্ব‘ নামেও পরিচিত। এক তরবারির প্রতীক রাজা, অন্য তরবারির প্রতীক পোপ বা গির্জা। উভয়ের মধ্যেকার কর্তৃত্বের সম্পর্ক এত মারাত্মক রূপ নেয় যে, সমাজে চরম বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছিল।
৯. রাজার নির্বাচন নীতি
মধ্যযুগে কোনো কোনো দেশে রাজাকে সরাসরিভাবে নির্বাচন করা হয়। যেমন– জার্মানি। আবার কোনো কোনো দেশে এই নির্বাচন সম্পন্ন হয় পরোক্ষভাবে। ইংল্যান্ডে যদিও বংশানুক্রমিক রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত, তথাপি বলতে গেলে পরোক্ষভাবে রাজা পার্লামেন্টের দ্বারাই নির্বাচিত হন।
১০. আইন বিষয়ক ধারণার বিকাশ
‘আইন সকলের এবং সবকিছুর উর্ধ্বে –এই চিন্তাধারার সূত্রপাত মধ্যযুগে। কেননা, মধ্যযুগে আইনকে কোনো নির্দিষ্ট ব্যক্তির ইচ্ছার অভিব্যক্তি হিসেবে গণ্য না করে সমষ্টিগতভাবে সকল জনগণের ইচ্ছার প্রকাশ হিসেবে গণ্য করা হয়। মধ্যযুগের শ্রেষ্ঠ দার্শনিক সেন্ট টমাস একুইনাস বলেন, ঈশ্বর নয়, যুক্তিই হলো আইনের মূল উৎস এবং আইন অনুযায়ী শাসকবর্গ শাসন পরিচালনা করবে।
১১. সামন্তবাদ
মধ্যযুগীয় রাষ্ট্রচিন্তার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো তাঁর সামন্তবাদী চরিত্র। মধ্যযুগে রাজা ও গির্জার মধ্যে বিরোধের ফলে রাজশক্তি যখন দুর্বল হয়ে পড়ে তখন সামন্তপ্রভুরা ক্ষমতাবান হয়ে ওঠে। রাজনৈতিক ক্ষমতার বিকেন্দ্রিকরণ, ভূমিকেন্দ্রিক অর্থনীতি, ভূমিভিত্তিক অধিকার ও সুবিধা, পর্যায়ক্রমিক ক্ষমতা বিন্যাস প্রভৃতি ছিল এই ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য।
১২. জনগণের প্রাধান্য
মধ্যযুগে যদিও বিশ্বাস করা হতো যে, রাজার ক্ষমতা ঈশ্বর প্রদত্ত, তথাপি এটাও মনে করা হতো যে, রাজতন্ত্রের উপর জনগণের প্রভাব অবশ্যই থাকবে। অনেকে মনে করেন, মধ্যযুগে রাজার ক্ষমতা গ্রহণ বা ক্ষমতা চ্যুতির ব্যাপারে জনমতের বিশেষ গুরুত্বের বিষয়টিই শেষ পর্যন্ত সামাজিক চুক্তির প্রথায় পরিণত হয়। পরবর্তীতে জন লক তাঁর রাষ্ট্রদর্শনে এই প্রথাটির সার্থক প্রয়োগ ঘটান।
১৩. স্টয়িকবাদের প্রভাব
স্টয়িকবাদের প্রভাব মধ্যযুগীয় রাষ্ট্রচিন্তার একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য। স্টয়িকবাদীরা মনে করেন যে, ব্যক্তি প্রকৃতির বিধান মেনে চললেই শান্তি লাভ করতে পারবে। স্টয়িক দর্শনের ন্যায় মধ্যযুগের রাজনৈতিক দর্শনও প্রাকৃতিক আইন, ঐশ্বরিক আইন, সৃষ্টিকর্তার দৃষ্টিতে সকল মানুষ সমান প্রভৃতি ধারণার উপর আস্থাবান ছিল।
পরিশেষে বলা যায় যে, রাষ্ট্রশক্তির সঙ্গে গির্জা তথা ধর্মীয় শক্তির দ্বন্দ্বের সর্বাধিক স্মরণীয় ও নাটকীয় ঘটনার যুগ হলো মধ্যযুগ। এ সময়ে রাষ্ট্রকে গির্জার অধীনস্ত করা হয়। যার ফলে মানুষের চিন্তা চেতনা ধর্মীয় কুসংস্কারের জালে আবদ্ধ হয়ে পড়ে। কিন্তু তাই বলে মধ্যযুগের ধ্যান–ধারণা ও চিন্তাভাবনাকে কোনভাবেই গুরুত্বহীন বলে একেবারে উড়িয়ে দেয়া যায় না। ফলে বিশ্লেষণধর্মী দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে মধ্যযুগের দিকে ফিরে তাকালে হয়তো আমরা আধুনিক জীবনের অনেক সমস্যার সমাধান মধ্যযুগের তত্ত্ব ও বিশ্বাসের মধ্যে পেতে পারি।