ভূমিকা
খুদ্দক নিকায় সুত্ত পিটকের পঞ্চম গ্রন্থ। ক্ষুদ্র বা ছোটখাট বিষয়ের যেমন গল্প, জাতক, থের–থেরীর জীবন, সুত্র ইত্যাদির সমষ্টি এই নিকায়ে নিবদ্ধ করা হয়েছে বিধায় এই নিকায়কে খুদ্দক নিকায় নামে অভিহিত করা হয়। এই নিকায় ১৫ অংশে বিভক্ত। যথা– ১.খুদ্দক পাঠ, ২.ধম্মপদ, ৩.উদান, ৪.ইতিবুত্তক, ৫.সুত্তনিপাত, ৬.বিমানবত্থু, ৭.প্রেতবত্থু, ৮.থেরগাথা, ৯.থেরী গাথা, ১০.জাতক, ১১.নিদ্দেস, ১২.পটিসম্ভিদামগ্গ, ১৩.অপদান, ১৪.বুদ্ধবংস, ১৫.চরিয়া পিটক।
খুদ্দক পাঠের সম্যক ধারণা
এটি খুদ্দক নিকায়ের প্রথম গ্রন্থ।খুদ্দকপাঠো শব্দের অর্থ সংক্ষিপ্ত পাঠ বা আবৃত্তি।এ ক্ষুদ্রাকার গ্রন্থখানি প্রত্যেক ভিক্ষু শ্রামণের অবশ্য পাঠ্য। নবদীক্ষিত ভিক্ষু শ্রামণেরা অন্যান্য গ্রন্থ শিক্ষা করার পূর্বে এ গ্রন্থটি শিক্ষা করেন।গৃহী বৌদ্ধদের নিকট এটি পবিত্র মন্ত্ররুপে পরিগণিত হয়।গ্রন্থের নয়টি পাঠের মধ্যে প্রথম চারটি পাঠ অতিশয় সংক্ষিপ্ত।পাঠগুলো– ১.ত্রিশরণ ২.দশশীল ৩. দ্বত্তিংসাকারো ও ৪. কুমার প্রশ্ন।
১.ত্রিশরণ: ত্রিশরণ বলতে আমরা বুদ্ধ ,ধর্ম ও সংঘের শরণকেই বুঝি।বুদ্ধের নয়গুণ,ধর্মের ছয়গুণ ও সংঘের নয়গুণ শরণই ত্রিশরণ।ত্রিশরণ বৌদ্ধধর্মে প্রবেশ করার সোপানস্বরুপ।
২.দশশীল: দশপ্রকার শীল বা শিক্ষাপদ শ্রামণদের অবশ্য প্রতিপাল্য।ভগবান বুদ্ধ রাহুলকে প্রব্রজ্যা প্রদানের উদ্দেশ্য এই শীলগুলো প্রজ্ঞাপ্ত করেন।তখন হতে এ শিক্ষাপদগুলো ভিক্ষু শ্রামণদের অবশ্য প্রতিপালনীয় শীলরুপে পরিগণিত হয়ে আসছে।
৩. দ্বত্তিংসাকারো: আমাদের শরীরে ৩২ প্রকার অশুচির পদার্থে পরিপূর্ণ। কামনা–বাসনা পরায়ণ অজ্ঞানান্ধ ব্যক্তি এটি বুঝতে পারেনা।যে ব্যক্তি নিয়ত মানবদেহের নশ্বরত্ব ও অশুচিত্ব সম্বন্ধে জ্ঞাত হন, তার অন্তরে কখনো রুপগর্ব জাগরিত হয় না।
৪.কুমারপ্রশ্ন: সাত বছর বয়স্ক সোপাক বা কুমার কাশ্যপ নামে বুদ্ধের একজন মহাশ্রাবক ছিলেন।তিনি ঐ বয়সে অর্হত্ব লাভ করেন এবং ভগবানের নিকট উপসম্পদা প্রার্থী হলে ভগবান তাকে পরীক্ষার জন্য দশটি প্রশ্ন করেন। এ প্রশ্নগুলো কুমার প্রশ্ন নামে খ্যাত।
আরও পড়ুন:
করনীয় মৈত্রী সূত্রটি কেন আবৃ্ত্তি করা হয়েছিল? এ সূত্রের সারমম তুলে ধর
কুমার প্রশ্নগুলোর গুরুত্ব
বুদ্ধের সান্নিধ্যলাভে কৃতপুণ্যে কিশোর সোপাকের জীবন সম্পূর্ণ বদলে গেল। অল্পকালের মধ্যেই সাধনায় পরম সিদ্ধিলাভ করে তিনি অর্হত্বফল লাভ করলেন। ভগবান গন্ধকুটীরের ছায়ায় চংক্রমণ করছিলেন। এমন সময় সোপাকও ভগবানের অনুবর্তী হয়ে সংযত পদক্ষেপে শ্রামণের জ্ঞানের গভীরতা প্রকাশ পাবার জন্য ও উপসম্পদা অনুজ্ঞা করবার ইচ্ছা প্রকাশ করলে, তখন বুদ্ধ তাঁকে সস্নেহ বচনে দশটি গভীর তত্ত্বপূর্ণ প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করলেন। তিনিও ভগবানের অভিপ্রায় বুঝে নিপুণতার সাথে প্রশ্নগুলির যথাযথ উত্তর প্রদান করেন। প্রশ্নগুলো নিম্নরূপ–
১. এক নাম কিং? – সব্বে সত্তা আহারটঠিকা। অর্থাৎ,সর্বসত্ত্ব আহারে স্থিত। অর্থাৎ জীবজগতের সকল প্রাণী একমাত্র আহারের দ্বারাই জীবন–ধারণ করে থাকে। এই আহার চার প্রকার । যথা– কবলীকৃত আহার, স্পর্শহার, চেতনাহার বা মনোসঞ্চেতনাহার ও বিজ্ঞানাহার।
২. দ্বে নাম কিং? – নামঞ্চ রূপঞ্চ। অর্থাৎ– দুই নামে নাম–রূপকে বুঝায়। নাম–রূপ, বেদনা, সংজ্ঞা – সংস্কার ও বিজ্ঞান স্কন্ধ এই চার স্কন্ধকে একত্রে ‘নাম‘ এবং ‘রূপ‘ স্কন্ধকে ‘রূপ‘ বলা হয়।
৩. তীনি নাম কিং? – উতিসসো বেদনা। অর্থাৎ– তিন প্রকার বেদনা– সুখ বেদনা, দুঃখ বেদনা ও উপেক্ষা বেদনা। বেদনা অর্থ অনুভূতি।
৪. চত্তারি নাম কিং? – চত্তারি অরিয় সচ্চানি। অর্থাৎ– চার আর্যসত্য। চারি আর্য সত্য হল ১.দুঃখ আর্যসত্য ২.দুঃখ সমুদয় আর্যসত্য ৩.দুঃখ নিরোধ আর্যসত্য ৪.দুঃখ নিরোধের উপায় আর্যসত্য। আর্য বলতে বুঝায় নিষ্কলুষ শুদ্ধাত্মা ব্যক্তিবর্গ। যারা নির্বানোপলব্ধির বিভিন্ন স্তর আয়ত্ব করেছেন অর্থাৎ স্রোতাপন্ন, সকৃদাগামী, অনাগামী কিংবা অর্হৎ হয়েছেন।
৫. পঞ্চ নাম কিং? – পঞ্চুপাদানক্খন্ধ। অর্থাৎ– পঞ্চ উপাদান স্কন্ধ। স্কন্ধ শব্দের অর্থ সমষ্টি। রূপ, বেদনা, সংজ্ঞা, সংস্কার ও বিজ্ঞান– এই পাঁচটি বিষয়ের সমষ্টিকে পঞ্চস্কন্ধ বলা হয়।
৬. ছুট্ঠ নাম কিং? – ছ অজ্ঝত্তিকানি আয়তনানি। অর্থাৎ– ছয় আধ্যাত্মিক আয়তন। ছয় আধ্যাত্মিক আয়তন চক্ষু, শোত্র, ঘ্রান, জিহ্বা, কায় ও মন আয়তন এই ছয় প্রকার আধ্যাত্মিক অর্থাৎ ষড়ায়তন বা ষড়েন্দ্রিয়।
৭. সত্ত নাম কিং? – সত্ত বোজ্ঝঙ্গা। অর্থাৎ– সপ্ত বোধ্যঙ্গ। সপ্ত বোধঙ্গ হচ্ছে সম্বোধি জ্ঞান লাভের অঙ্গ বিশেষ। সম্বোধি অর্থে চারি মার্গ জ্ঞান অধিগম বুঝায়।
৮. অটট নাম কিং? – অরিয়ো অট্ঠঙ্গিকো মগগো। অর্থাৎ– আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গ। যথা–১.সম্যক বাক্য, ২. সম্যক কর্ম ৩.সম্যক জীবিকা ৪.সম্যক সংকল্প ৫.সম্যক দৃষ্টি ৬.সম্যক ব্যায়াম ৭. সম্যক স্মৃতি ও ৮. সম্যক সমাধি।
৯. নব নাম কিং? – নবসত্তাবাসা । অর্থাৎ– প্রাণীর নয় আবাস। ১. নানাকায় নানা সংজ্ঞা( মনুষ্যগণ, কোন কোন দেবতা,কোন কোন নরকগামীএ পর্যায় ভুক্ত।২. নানা কায় একসয়জ্ঞা ( ব্রক্ষ্ম কায়িক দেবগণ যারা প্রথম ধ্যান লাভ হেতু ব্রক্ষ্মলোকে উৎপন্ন হয়েছেন তারা এ পর্যায়ভুক্ত। ৩. এককায় নানা সংজ্ঞা (আভাস্বর দেবগণ) ৪. এককায় একসংজ্ঞা (শুভকীর্ণ দেবগণ) ৫. অসংজ্ঞসত্ব দেবগণ( অসংজ্ঞসত্ব দেবতারা) ৬. আকাশানন্তায়তন উপগত( যারা রুপ সংজ্ঞা, প্রতিঘসংজ্ঞা অতিক্রম করে নানাবিধ সংজ্ঞায় মনোনিবেশ না করে স্থিত হন। ৭. বিজ্ঞানায়তন উপগত(যারা অনন্ত আকাশ অতিক্রম করে অনন্ত বিজ্ঞান আয়তনে স্থিত হন।৮. আকিঞ্চনায়তন উপগত ( যারা অনন্ত বিজ্ঞান আয়তন অতিক্রম করে কিছু নাই এরুপ সংজ্ঞায় স্থিত হন। ৯. নেব সংজ্ঞা না সংজ্ঞায়তন ( আকিঞ্চন আয়তন অতিক্রম করে যারা সংজ্ঞা নাই অসংজ্ঞাও নাই এরুপ অবস্থায় স্থিত হন।
১০. দসনাম কিং? – দস অঙ্গেহি সমন্নাগতো অরহাতি বুচ্চতি – অর্থাৎদশ অঙ্গ সমন্বিত ব্যক্তিকে অর্হৎ বলা হয়। যথা–১. অশৈক্ষ্য সম্যক দৃষ্টি, ২.অশৈক্ষ্য সম্যক সংকল্প ৩. অশৈক্ষ্য সম্যক বাক্য ৪. অশৈক্ষ্য সম্যক কর্ম ৫.অশৈক্ষ্য সম্যক জীবিকা ৬. অশৈক্ষ্য সম্যক ব্যায়াম ৭.অশৈক্ষ্য সম্যক স্মৃতি ৮. অশৈক্ষ্য সম্যক সমাধি ৯. অশৈক্ষ্য সম্যক জ্ঞান ১০.অশৈক্ষ্য সম্যক বিমুক্তি।
উপরোক্ত বিষয়গুলো ছাড়াও পাঁচটি পাঠ বা সুত্র এ গ্রন্থে সন্নিবেশিত করা হয়েছে। পাঁচটি সূত্র হল– মঙ্গল সূত্র, রতন সূত্র, করণীয় মৈত্রী সূত্র, তিরোকুড্ড সুত্র ও নিধিকণ্ড সূত্র।
বৌদ্ধ শাস্ত্রীয় সাহিত্যে এ প্রতীকী দশ ধরনের প্রশ্নোত্তর পদ্ধতির অনুসরন বেশ ব্যাপক, বেশ চমকপ্রদ, আকর্ষণীয় বটে। পূর্বজন্মে পূরিত পারমী না হলে এমন অল্প বয়স্ক শ্রামণের অর্হত্বফল প্রাপ্তি আশ্চর্য বটে। এইরূপ পুন্যসকর্মা পুরুষের নিষ্কলঙ্ক জীবনই ধন্য। সার্থক তার প্রবজ্যা। সপ্তম বর্ষীয প্রব্রজ্যা কুমার শ্রামন বটে কিন্তু জ্ঞানের প্রতীক, তাঁর প্রত্যেক উত্তর চিত্ত গভীর জ্ঞানদ্যোতক দার্শনিক তত্ত্ব সমন্বিত । সমস্ত জটিল প্রশ্ন তাঁর সম্মুখে উপস্থিত করা হয়েছিল তা সমস্তই ত্রিপিটকের সারতত্ত্ব – শীল, সমাধি, বিদর্শন ও লোকত্তর জ্ঞান সম্বন্ধীয় গভীর বিষয়।
উপসংহার
উপরিউল্লিখিত কুমার প্রশ্নগুলো পর্যালোচনা করে প্রতীয়মান হয় যে, এই প্রশ্নগুলোতে ত্রিপিটকের সারতত্ত্ব শীল, সমাধি,প্রজ্ঞা সম্বন্ধীয় গভীর বিষয় তথা বৌদ্ধ ধর্মের মূলতত্ত্ব আলোচিত হয়েছে। তাই বলা যায় কুমার প্রশ্নের গুরুত্ব অপরিহার্য।