প্রাক সুলতানী আমলে চন্দ্রবংশের সূচনা হয়। দক্ষিণ পূর্ব বাংলার সবচেয়ে শক্তিশালী স্বাধীন রাজবংশ ছিল চন্দ্রবংশ। দশম শতকের শুরু হতে একাদশ শতকের মধ্যভাগ পর্যন্ত দেড়শত বছর এ বংশের রাজারা শাসন করে। চন্দ্রবংশীয় রাজারা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী রাজবংশ ছিল। ভারতীয় উপমহাদেশের চন্দ্রবংশীয় রাজবংশ মূলত দক্ষিণ পূর্ব বাংলার সমতট অঞ্চল ও উত্তর আরাকান শাসন করত। পাহাড় ছিল চন্দ্রবংশ রাজাদের মূল কেন্দ্র। এ পাহাড় প্রাচীন কালে রোহিত গিরি নামে পরিচিত ছিল। তাদের হাতেই ময়নামতি এবং লালমাই এলাকায় বৌদ্ধদের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড নতুন শক্তি লাভ করে। কিন্তু চন্দ্র রাজগণ উদার ধর্মীয় নীতি অনুসরণ করেছিলেন বলেই ঐতিহাসিকদের ধারণা সিলেট অঞ্চলে শ্রীচন্দ্র ব্রাক্ষ্মণ্য ধর্মের পৃষ্ঠপোষকতা করেন।
চন্দ্রবংশীয় রাজাদের রাজত্বকাল
চন্দ্র রাজ্যটি ভারতীয় উপমহাদেশের বৌদ্ধদের শেষ কয়েকটি দুর্গের মধ্যে একটি ছিল। রাজ্যটি বৌদ্ধধর্মের তান্ত্রিক বিদ্যালয়ের কেন্দ্র হিসেবে প্রচার ও প্রসার লাভ করেছি। এটি দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার মহাযান ও বৌদ্ধধর্মের আদর্শের বিস্তারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। এ বংশের কয়েকজন শাসকের কয়েকটি তাম্রশাসন আবিস্কৃত হওয়ায় বর্তমানে এদের বংশানুক্রমিক ইতিহাস পুনর্গঠন করা সম্ভব হয়েছে। চন্দ্র রাজবংশের পাঁচজন উল্লেখযোগ্য রাজা হলেন-
ত্রৈলোকচন্দ্র (৯০০-৯৩০ খ্রিষ্টাব্দ)
শ্রীচন্দ্র (৯৩০-৯৭৫ খ্রিঃ)
কল্যাণ চন্দ্র (৯৭৫-১০০০ খ্রিঃ)
লডহ চন্দ্র (১০০০-১০২০ খ্রিঃ)
গোবিন্দ চন্দ্র (১০২০-১০৫০ খ্রিঃ)
ত্রৈলোকচন্দ্রের রাজত্বকাল
পূর্ণচন্দ্র এবং সুবর্ণচন্দ্র হরিকেল রাজার অধীনে রোহিত গিরির (সম্ভবত লালমাই অঞ্চল) সামন্ত ছিলেন। সুবর্ণচন্দ্রের পুত্র ত্রৈলোক্যচন্দ্র (আনুমানিক ৯০০-৯৩০ খ্রি) ছিলেন এ বংশের প্রথম স্বাধীন রাজা। তিনি সমতট বংশের সার্বভৌম ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করেন। দেব পর্বত ছিল তাদের ক্ষমতার কেন্দ্রস্থল। বঙ্গের অংশবিশেষ এবং চন্দ্রদ্বীপের উপর তিনি ধীরে ধীরে তাঁর ক্ষমতার বিস্তার ঘটান এবং মহারাজাধিরাজ উপাধি গ্রহণ করেন। লডহ চন্দ্রের ময়নামতি তাম্রশাসনের একটি শ্লোকে বলা হয়েছে যে, ত্রৈলোক্য চন্দ্রের অধীনে বঙ্গের উত্তরোত্তর সমৃদ্ধি ঘটে। সমতটে ত্রৈলোক্য চন্দ্রের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয় খুব সম্ভবত পশ্চিম ও উত্তর বাংলায় পাল সাম্রাজ্যের অভ্যন্তরে কম্বোজদের উত্থানের সমসাময়িক কালে।
শ্রীচন্দ্রের রাজত্বকাল
ত্রৈলোক্যচন্দ্রের পুত্র শ্রীচন্দ্রের (আনুমানিক ৯৩০-৯৭৫ খ্রিঃ) শাসনকালে চন্দ্র রাজ্যের প্রশাসনিক কেন্দ্র স্থাপিত হয় বঙ্গের বিক্রমপুরে। শ্রীচন্দ্র ছিলেন চন্দ্র রাজবংশের সব চাইতে গুরুত্বপূর্ণ রাজা। শ্রীচন্দ্রের পরমেশ্বর, পরম ভট্টারক ও মহারাজাধিরাজ উপাধি ছিল। চন্দ্রদের ক্ষমতা সম্প্রসারণের কৃতিত্ব শ্রীচন্দ্রের। মৌলভীবাজার জেলার পশ্চিম ভাগ গ্রামে প্রাপ্ত তাঁর একটি তাম্রশাসনে কামরূপ অভিযান সম্পর্কে তথ্য রয়েছে। একই তাম্রশাসনে তাঁর উদ্যোগে সিলেট এলাকায় বিপুল সংখ্যক ব্রাক্ষ্মণের বসতি স্থাপনের কথা জানা যায়। তিনি গৌড়দের বিরুদ্ধেও অস্ত্রধারণ করেন (খুব সম্ভবত কাম্বোজ গৌড়পতি বা পালনের বিরুদ্ধে)। দ্বিতীয় গোপাল এর সময় পালদের ক্ষমতা রক্ষাকল্পে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেন (পশ্চিমভাগ তাম্রশাসনের একটি শ্লোকে দ্বিতীয় গোপালকে “গোপাল-সংরোপনে মহোৎসব গুরু” বলে উল্লেখ করা হয়েছে)। ভূমিদান সম্পর্কিত তাঁর ৬টি তাম্রশাসন এবং তাঁর উত্তরাধিকারীদের তাম্রশাসনে শ্রীচন্দ্র সম্পর্কে যে তথ্য পাওয়া যায় তা থেকে সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় যে, বঙ্গ ও সমতটের বিস্তীর্ণ এলাকায় তাঁর শাসন প্রতিষ্ঠিত ছিল।
কল্যাণচন্দ্রের রাজত্বকাল
শ্রীচন্দ্রের পুত্র ও উত্তরাধিকারী কল্যাণচন্দ্রের (আনুমানিক ৯৭৫-১০০০ খ্রিঃ) মাত্র ১টি তাম্রশাসন এ পর্যন্ত আবিষ্কৃত হয়েছে। কল্যাণচন্দ্রের উত্তরাধিকারীগণের তাম্র্রশাসন সমূহ থেকে জানা যায়, কামরূপ এবং গৌড়ে তিনি ক্ষমতা প্রদর্শন করেছিলেন। উত্তর ও পশ্চিম বাংলায় কম্বোজদের প্রতি তিনি সম্ভবত শেষ আঘাতটি করেন এবং প্রথম মহীপালের অধীনে পাল সাম্রাজ্য পুনরুদ্ধারে সাহায্য করেন।
লডহচন্দ্রের রাজত্বকাল
কল্যাণচন্দ্রের পরবর্তী তাঁর দুজন উত্তরাধিকারী যথাক্রমে পুত্র লডহচন্দ্র (আনুমানিক ১০০০-১০২০ খ্রিঃ) এবং পৌত্র গোবিন্দচন্দ্র চন্দ্র বংশের গৌরব অব্যাহত রাখেন। অনুসৃত উদার নীতির কারণে তাদেরকে প্রশংসা করা হয়।
গোবিন্দচন্দ্রের রাজত্বকাল
এ পর্যন্ত জানা মতে, লডহচন্দ্রের পুত্র গোবিন্দচন্দ্র ছিলেন চন্দ্রবংশের শেষ রাজা। তিরুমুলাই লিপিতে উল্লেখিত হয়েছে যে, তাঁর সময়ে “বঙ্গালদেশ” বৃষ্টি যেখানে কখনও থামে না, চোলদের অভিযানে পর্যুদস্ত হয় ( ১০২১-১০২৪ খ্রিঃ মধ্যে)। সম্ভবত গোবিন্দচন্দ্র অথবা তাঁর উত্তরাধিকারী (নাম জানা যায় নি) কলুচরি রাজা কর্ণ কর্তৃক (১০৪৮-১০৪৯ খ্রিঃ আগে কোন এক সময়) আক্রান্ত হয়েছিলেন। এ অভিযান চন্দ্রদের পতনের জন্য সম্ভবত যতেষ্ট দায়ী ছিল।
চন্দ্রবংশীয় রাজাদের বাণিজ্যিক সম্পর্ক
উপকূলীয় রাজ্য যেমন- মায়ানমার, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া এবং ভিয়েতনামের সাথে চন্দ্রবংশের বাণিজ্য সম্পর্ক ছিল। দশম শতাব্দীতে জাভা দ্বীপ পুঞ্জের বণিকেরা দক্ষিণ-পূর্ব বাংলা এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মধ্যে সমুদ্র সংযোগ ও বাণিজ্য করার পথ সুগম করে। ব্রোঞ্জের ভাস্কর্যগুলি জাভা দ্বীপের ব্যবসায়ীরা দক্ষিণ-পূর্ব বাংলার চন্দ্র রাজ্য থেকে আমদানি করেছিলেন। আরব বণিকেরাও এই রাজ্যের সাথে ব্যবসা করতে পছন্দ করেন।
চন্দ্রবংশীয় রাজাদের পুরাতত্ত্ব
চন্দ্রবংশের সময়কালের প্রচুর শিলালিপি পাওয়া গিয়েছে। চন্দ্ররাজবংশ সম্পর্কিত ৩টি প্রত্নতাত্ত্বিক স্থল বিদ্যমান। এগুলো হল- বিক্রমপুর, কুমিল্লার ময়নামতি এবং মায়ানমারের রাখাইন রাজ্যের ওয়াইথালি।
উপসংহার
একাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি কালে দক্ষিণ-পূর্ব বাংলায় চন্দ্রবংশের শাসনের লোপ পায়। দক্ষিণ-পূর্ব বাংলায় প্রায় দেড় শতাব্দীকাল চন্দ্রবংশের শাসন বিরাজমান ছিল। ত্রৈলোক চন্দ্র চন্দ্রবংশের নায়ক। তাঁর রাজত্বকালে তাদের ক্ষমতা উন্নতির উচ্চ শিখরে উঠে।
আরও পড়ুন: পালবংশীয় রাজাদের রাজত্বকালকে স্বর্ণযুগ বলা হয়?