Home » বাংলাদেশের পালবংশীয় রাজাদের রাজত্বকালকে স্বর্ণযুগ বলা হয়?
বাংলাদেশের পালবংশীয় রাজাদের রাজত্বকালকে স্বর্ণযুগ বলা হয় কেন

বাংলাদেশের পালবংশীয় রাজাদের রাজত্বকালকে স্বর্ণযুগ বলা হয়?

by TRI

প্রাচীন বাংলার ইতিহাসে এক গৌরবময় অধ্যায় পালযুগ। পালবংশ প্রায় চারশত বছর বাংলা শাসন করে। এরাই রাজবংশের দীর্ঘকালের শাসন ইতিহাসে বিরল। বিস্তৃত সাম্রাজ্র্যের সুষ্ঠু শাসন ব্যবস্থা, প্রজ্ঞাবৎসল রাজনীতি, শাসননীতি শিল্পকলার ক্ষেত্রে উৎকর্ষ সাধন এবং সাহিত্য ও জ্ঞানের চর্চা এসবই পাল যুগের কৃতিত্ব ও গৌরব। তাই পালবংশীয় রাজাদের রাজত্বকালকে বাংলার ইতিহাসে স্বর্ণযুগ বলা হয়।

পালবংশ (৭৫০-১১৫৬ খ্রিঃ)

খ্রিষ্টীয় সাত শতকের মাঝামাঝি থেকে আট শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত প্রায় শতবর্ষব্যাপী বাংলায় বিশেষত উত্তর বঙ্গে চরম অরাজকতা বিরাজ করে। যা মাৎস্যন্যায় নামে পরিচিত। এই অরাজক অবস্থা দূর করার জন্য অষ্টম শতকের মধ্যভাগে বাংলাদেশের জনগণ গোপাল নামের এক ব্যক্তিকে রাজপদে অধিষ্ঠিত করেন। মূলত গোপালের নেতৃত্বেই বাংলায় পাল বংশের প্রতিষ্ঠা হয়। পাল রাজ বংশ কৃতিত্বের সাথে বাংলায় প্রায় ৪০০ বছর রাজত্ব করে। বৌদ্ধধর্মের প্রচার ও প্রসারে পালবংশীয় রাজাদের অবদান অবিস্মরণীয়।

পালবংশীয় রাজত্বকে স্বর্ণযুগ বলার কারণ

পালযুগকে বাংলার ইতিহাসে স্বর্ণযুগ বলার বিদ্যমান কারণ সমূহ নিচে উল্লেখ করা হল-

বিস্তৃত সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা

পাল বংশের শাসন প্রতিষ্ঠার পর উদীয়মান প্রতিপত্তির যুগে পাল সাম্রাজ্যের ব্যাপক বিস্তৃতি ঘটে। সমগ্র উত্তর ভারত তাদের শাসনাধীনে না আসলেও কনৌজ পর্যন্ত বিস্তার লাভ করে পাল শক্তি উত্তর ভারতের রাজনীতিতে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়। পালদের অধীনে উত্তর ভারতের রাজনীতিতে বাংলার প্রথম সাফল্যজনক বিস্তৃতি ঘটে। বাংলার রাজবংশগুলোর মধ্যে এ গৌরবের দাবি শুধুমাত্র পালরাই করতে পারেন। শশাঙ্কের পর সামরিক ক্ষেত্রে শৌর্যবীর্যের প্রদর্শন ও শক্তি সঞ্চারের কৃতিত্ব পালদেরেই।

সুষ্ঠু শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তন

পালদের তাম্রশাসন সমূহে সুষ্ঠু শাসন ব্যবস্থার স্পষ্ট পরিচয় পাওয়া যায়। গ্রাম পর্যায় থেকে কেন্দ্রীয় সরকার পর্যন্ত স্তরীভূত সুবিন্যাস্ত শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়েছিল। পাল সাম্রাজ্যের রাজস্ব ছাড়াও বিভিন্ন কর শুল্ক আদায়ের এবং ভূমি প্রশাসনে ছিল সুবিন্যাস্ত অবকাঠামো। প্রশাসন ব্যবস্থা ছিল সর্বব্যাপী। খেয়াঘাটের ব্যবস্থা থেকে শুরু করে নদীপথ স্থলপথ, ব্যবসা-বাণিজ্য, নগর-বন্দর, আইন শৃঙ্খলা রক্ষা কোন ক্ষেত্রেই প্রশাসনতন্ত্রের আওতায় বহির্ভূত ছিল না, এমনকি বন এবং বাজার ব্যবস্থাপনার দিকেও নজর ছিল প্রশাসনের।

প্রজ্ঞাবৎসল শাসন নীতি

পাল সম্রাটগণ ছিলেন বৌদ্ধ। কিন্তু প্রজাদের অধিকাংশ ছিল হিন্দু। পাল সম্রাট ধর্মপাল ধর্মীয় সম্প্রীতির নীতি গ্রহণ করেছিলেন রাষ্ট্রীয় নীতি হিসেবে। পাল রাজারা বৌদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও হিন্দু দেব দেবতা বা ব্রাক্ষ্মণ সম্প্রদায় সম্রাটের অকুণ্ঠ পৃষ্টপোষকতা লাভ করেন। রাজকীয় উচ্চপদ সমূহে ব্রাক্ষ্মণদের চাকরি লাভের সুযোগ ছিল। বাংলার জনজীবন হিন্দু বৌদ্ধদের মধ্যে কোন ভেদাভেদ ছিল বলে প্রমাণ পাওয়া যায় না।

আরও পড়ুন:   

বড়ুয়া শব্দের অর্থ কি ? বাংলাদেশে বড়ুয়া জাতির ইতিহাস সম্পর্কে আলোচনা কর।

জনকল্যাণমূলক কার্যক্রম

ধর্মপাল বহু সহস্র রৌপ্যমুদ্রা খরচ করে খনন করেছিলেন কয়েকটি দীঘি। সম্রাট প্রথম মহীপাল বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে দীঘি খনন ও নগর প্রতিষ্ঠা করে বাংলার জনমনে তিনি যে স্থায়ী আমন করে নিয়েছিলেন সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। পাল সম্রাটদের জনস্বার্থের জন্য বহুতল নির্মাণের ধ্বংসাবশেষ তাঁদের কল্যাণমূখী শাসনের পরিচয় বহন করে।

বৌদ্ধধর্মের প্রসার

পাল রাজারা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বৌদ্ধধর্মের সেবায় নিযুক্ত ছিলেন। পালবংশীয় শ্রেষ্ঠ নরপতি ধর্মপাল প্রখ্যাত নালন্দা মহাবিহারকে সাজিয়েছিলেন। এছাড়াও তিনি সোমপুর বিহার, জগদ্দল বিহার, বিক্রমশীলা বিহার, ত্রৈকুটক বিহার সহ প্রভৃতি বিহার নির্মাণ করেছিলেন। প্রথম মহীপালের সময়ে শত শত প্রাচীন মন্দির পুনঃ সংস্কার করা হয়। এছাড়াও তিনি বুদ্ধগয়ায় দুটি বৌদ্ধ মন্দির নির্মাণ করান। তাঁর রাজত্বের ৫ম ও ৬ষ্ঠ বর্ষে ”অষ্ট সাহস্রিকা প্রজ্ঞা পারমিতা” নামে দুটি পান্ডুলিপি লেখা হয়। পালযুগে বৌদ্ধধর্মের প্রসার লাভ করেছিল তিব্বত, জাভা, সুমাত্রা ও মালয়শিয়াতে। বাংলার বৌদ্ধ বিহারগুলো থেকে বহু পন্ডিত এসব দেশে গিয়ে বৌদ্ধধর্ম প্রচার এবং প্রসারে ভূমিকা রেখেছিলেন। আর এসব সম্ভব হয়েছিল পাল রাজাদের পৃষ্ঠপোষকতার জন্য।

শিল্পকলা ও স্থাপত্যশিল্পের অগ্রগতি

পালযুগের শিল্পকলার মধ্যে ভাস্কর্য শিল্পের অগ্রগতি ঘটেছিল। গুপ্ত ভাস্কর্যের ধারাবাহিকতায় ও পাল সম্রাটদের পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলার ভাস্কর্য শিল্প এ যুগে এক নতুন রূপ পরিগ্রহ করে। পালযুগে কোন হিন্দু মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ পাওয়া যায় নি। তবে বাংলার বিভিন্ন জায়গায় মন্দিরের ব্যবহৃত স্তম্ভ বা দ্বারের অংশবিশেষ, ভাস্কর্যের মন্দিরের প্রতিকৃতি প্রভৃতি থেকে অনুমান করা সম্ভব যে, পালযুগে মন্দির ও স্থাপত্যের ব্যাপক প্রসার ঘটেছিল। পাল যুগের অন্যতম স্থাপত্য কীর্তির নিদর্শন হচ্ছে পাহাড়পুরের সোমপুর বিহার। এটি রাজা ধর্মপাল নির্মাণ করেন। এছাড়া পাল যুগের স্থাপত্য শিল্পের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল- বিক্রমশীলা বিহার ও জগদ্দল বিহার।

সাহিত্যের বিকাশ

পালযুগের প্রাপ্ত অসংখ্য তাম্র শাসনে বিধৃত প্রশান্তি অংশে সংস্কৃত ভাষা চর্চার ও শৈল্পিক মান সম্পন্ন কাব্য রচনার স্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়। কবি অভিনন্দন কর্তৃক বৈদভী রীতিতে রচিত রামচরিতম মহাকাব্য সর্বভারতীয় সাহিত্য সরে সমাদৃত হয়েছিল। ভাষার সৌকর্য বিশেষ অর্থবহ শব্দের প্রয়োগ এবং ছন্দের মাধুর্যে সন্ধ্যাকর নীতির রামচরিতম কাব্যটি সর্বভারতীয় সংস্কৃত সাহিত্যের মধ্যে দশম-একাদশ শতকের বেশ কয়েকজন কবির রচনায় স্থান পেয়েছে। কাব্যিক মান উচ্চ পর্যায়ের বলেই এই রচনা সমূহ সংকলনে স্থান পেয়েছে। তার এই কাব্য সম্ভার পালযুগের সাহিত্যের উৎকর্ষেরই প্রমাণ বহন করে।

উপসংহার

পরিশেষে বলা যায়, পালবংশীয় রাজাদের দীর্ঘ চারশত বছর রাজত্বকালে বাংলাদেশে বৌদ্ধধর্মের ব্যাপক উন্নতি হয়েছিল এটা বলার অপেক্ষা রাখে না। পাল বংশের সকল রাজাই ছিলেন পরম সৌগত এবং বুদ্ধের একান্ত ভক্ত ও অনুসারী। তাদের সময়ে শিক্ষা-সাহিত্যে, ধর্মদর্শনে, শিল্প-ভাস্কর্যে বৌদ্ধধর্মের চরম বিকাশ সাধিত হয়েছিল। তাই পালযুগকে বৌদ্ধধর্মের ইতিহাসে স্বর্ণযুগ নামে অভিহিত করা যায়।

আরও পড়ুন:   শ্রীলংকায় বৌদ্ধধর্ম প্রচারের ইতিহাস আলোচনা কর

Related Posts