প্রিয় পাঠক, আজকে আমরা আধুনিক রাষ্ট্রের কার্যাবলী সম্পর্কে আলোচনা করবো। সেই সাথে আমরা আধুনিক রাষ্ট্রের উদ্দেশ্যও জেনে নেবো। চলুন তবে শুরু করা যাক।
আধুনিক রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য
রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য নিয়ে অনেকের অনেক মতভেদ রয়েছে। কোন কোন মতবাদে রাষ্ট্রকে ঐশ্বরিক ইচ্ছার বহিঃপ্রকাশ হিসেবে প্রকাশ করা হয়েছে। আবার কোন কোন মতবাদে সমাজ জীবনের মহত্তম সংস্থা বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। আবার কোনো কোনো মতবাদে রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয়তা পর্যন্ত অস্বীকার করা হয়েছে । প্রাচীন গ্রীক আমল থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও চিন্তাবিদগণ প্রায় আড়াই হাজার বছর এ বিষয় নিয়ে বহু তর্কবিতর্ক করে আসছেন। কিন্তু কোন ঐক্যমতে পৌঁছাতে পারেননি।
রাষ্ট্রকে শ্রেষ্ঠ মানবিক সংগঠন বলে উল্লেখ করেছেন গ্রীক দার্শনিক প্লেটো ও এরিস্টটল । তাদের মতে রাষ্ট্রের মধ্যে নাগরিকের পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটে। এরিস্টটলের মতে, রাষ্ট্রের বাইরে যারা বসবাস করেন তারা সাধারণ মানুষ নহে। হয় তারা দেবতা, না হয় পশু। মানব জীবনের প্রয়োজনেই রাষ্ট্রের উদ্ভব হয়েছে। মানুষের কল্যাণ সাধনের উপরই এর সার্থকতা নিহিত। মানব জীবনের সামাজিক, নৈতিক ও আধ্যাত্মিক জীবনের পরিপূর্ণতা রাষ্ট্রের মধ্যেই বাস্তব হয়ে ওঠে।
এরিস্টটলের পদাঙ্ক অনুসরণ করে মধ্যযুগের বিশিষ্ট চিন্তাবিদ টমাস একুইনাস মানুষের কল্যাণ সাধনকে রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য বলে উল্লেখ করেছেন। পবিত্র ইসলাম ধর্মেও রাষ্ট্র বিশ্বাসীগণ ইহলোকিক ও পারলৌকিক মঙ্গলের উপায় হিসেবে গৃহীত হয়েছে। ঐক্য, কান্তিও সৎ জীবনের প্রতীকরূপী ইসলামী রাষ্ট্র বিশেষ উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
অষ্টাদশ শতাব্দীতে অ্যাডাম স্মীথ তার বিখ্যাত “Wealth of Nations“ গ্রন্থে রাষ্ট্রের তিনটি প্রধান কাজের কথা বলেছেন। যথা:
১. স্বীয় রাষ্ট্রকে অন্য রাষ্ট্রের আক্রমণ হতে রক্ষা করা।
২. রাষ্ট্রের কোন সদস্যের অবিচার থেকে সকলকে রক্ষা করা।
৩. রাষ্ট্র যাতে শুধুমাত্র কতিপয় ব্যক্তির স্বার্থে কার্যসম্পাদন না করে তার প্রতি সতর্ক থাকা।
অধ্যাপক গার্নার রাষ্ট্রের তিনটি উদ্দেশ্যের কথা বলেছেন। এগুলো হলো-
প্রথমত: রাষ্ট্র ব্যক্তিসমূহের মধ্যে শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করবে। সুবিচার ও আইনের শাসনের মাধ্যমে প্রত্যেকের অধিকার রক্ষা করবে।
দ্বিতীয়ত: রাষ্ট্রের উচিত হবে ব্যক্তি সমষ্টির কল্যাণ সাধন করা।
তৃতীয়ত: অন্যান্য রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে সাহায্য ও সহযোগিতা বৃদ্ধির মাধ্যমে রাষ্ট্র বিশ্ব সভ্যতার বিকাশ ও সংরক্ষণ করবে। রাষ্ট্রের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বার্জেস তাৎপর্যপূর্ণ মতামত ব্যক্ত করেছেন। তার মতে, রাষ্ট্রের চরম ও পরম উদ্দেশ্য হচ্ছে মানবিক মূল্যবোধের বিকাশ এবং সভ্যতার উৎকর্ষ সাধন করে মানব সমাজে ন্যায়নীতি কায়েম করা।
রাষ্ট্র বিজ্ঞানীদের মতামত বিশ্লেষণ করলে আধুনিক রাষ্ট্রের চারটি উদ্দেশ্য পরিস্ফুট হয়ে উঠে। যথা-
১. রাষ্ট্রের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও সংহতি রক্ষা করা।
২. জাতীয় উন্নতি ও অগ্রগতিসাধন এবং বিশ্বশান্তি ও বিশ্বসভ্যতার বিকাশে সহযোগিতা করা।
৩. রাষ্ট্রের শান্তি ও শৃঙ্খলা রক্ষা করা।
৪. নাগরিকবৃন্দের দৈহিক ও মানসিক বিকাশ সাধন।
আধুনিক রাষ্ট্রের কার্যাবলী
মানুষের প্রয়োজন ও চাহিদার তাগিদে ক্রমবিকাশের মধ্য দিয়ে গড়ে উঠেছে রাষ্ট্রব্যবস্থা। মানব সমাজের প্রয়োজনেই রাষ্ট্রকে বিভিন্ন কার্য সম্পাদন করতে হয়। রাষ্ট্রের কার্যাবলী কোন নির্দিষ্ট গন্ডির মধ্যে আবর্তিত হয় না। বরং মানব সমাজের কল্যাণ সাধনই রাষ্ট্রের লক্ষ্য। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী উইলোবি ও গেটেল আধুনিক রাষ্ট্রের কার্যাবলী দু’ভাগে বিভক্ত করেছেন। যথা-
১. অপরিহার্য বা মূখ্য কার্যবলী
২. ঐচ্ছিক বা গৌণ কার্যাবলী।
অপরিহার্য কার্যাবলী
রাষ্ট্রের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব এবং নাগরিকের অধিকার সংরক্ষণের জন্যে রাষ্ট্রকে যে সকল কাজ সম্পাদন করে তাকে অপরিহার্য কাজ বলে। রাষ্ট্রের অপরিহার্য কার্যগুলি নিম্নরূপ:
অভ্যন্তরীণ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা সংক্রান্ত কার্যাবলী
জান মালের নিরাপত্তা, রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতা ও সংহতির জন্যে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা করা রাষ্ট্রর পবিত্র দায়িত্ব।
দেশ রক্ষা
দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা করা রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ কাজ। বহিঃশত্রুর হাত থেকে দেশকে রক্ষার জন্যে স্থল বাহিনী, নৌ-বাহিনী ও বিমান বাহিনী গঠন ও তত্ত্বাবধান রাষ্ট্রের অপরিহার্য কর্তব্য।
প্রশাসনিক কার্যাবলী
সরকারী কার্যক্রম পরিচালনা ও বাস্তবায়নের জন্য রাষ্ট্রকে প্রশাসনিক কাঠামো নির্মাণ ও কর্মচারী নিয়োগ করতে হয়।
অর্থনৈতিক ও মুদ্রানীতি সংক্রান্ত কার্যাবলী
দেশের উন্নয়ন এবং সরকারি কর্মচারীদের বেতনাদির জন্য রাষ্ট্র কর ও শুল্ক ধার্য ও আদায়ের ব্যবস্থা করে থাকে, মুদ্রানীতি সংক্রান্ত কাজ রাষ্ট্রের অপরিহার্য কাজ বলে গণ্য হয়।
বৈদেশিক কার্যাবলী
বৈদেশিক বাণিজ্য ‘সামরিক চুক্তি’, শান্তি ও সহযোগিতা চুক্তি, কূটনৈতিক সম্পর্ক, আঞ্চলিক জোট গঠন প্রভৃতি বৈদেশিক কাজ রাষ্ট্র করে থাকে।
আইন ও বিচার সংক্রান্ত কাজ
আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, আদালত গঠন ও পরিচালনার মাধ্যমে জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং অপরাধীদের শাস্তি প্রদান রাষ্ট্রের অপরিহার্য কাজ বলে গণ্য করা হয়।
ঐচ্ছিক কার্যাবলী
নাগরিক জীবনকে সুন্দরভাবে গড়ে তোলার জন্যে রাষ্ট্র স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে বহু জনকল্যাণমূলক কাজ সম্পাদন করে থাকে। সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় ক্ষেত্রে নাগরিকের কল্যাণ ও মঙ্গলের জন্য যে সমস্ত কাজ রাষ্ট্র করে সেগুলোকে ঐচ্ছিক কার্যাবলী বলে।
ঐচ্ছিক কার্যাবলী
ঐচ্ছিক কার্যাবলীগুলো নিম্নরূপ:
শিক্ষা বিষয়ক কার্যাবলী
জাতিকে সঠিকভাবে গড়ে তোলা এবং নাগরিকের অধিকার ও কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন করার জন্যে রাষ্ট্র শিক্ষা সংক্রান্ত বহুবিধ কাজ করে। যেমন- স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, বিশ্ববিদ্যালয় প্রভৃতি প্রতিষ্ঠান স্থাপন ও পরিচালনা করে থাকে।
শিল্প-বাণিজ্য
বর্তমান বিশ্বে সকল রাষ্ট্রই শিল্প-বাণিজ্যের প্রসারের প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। অর্থনৈতিক কর্মকান্ড বিকাশের জন্যে, উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য রাষ্ট্র শিল্প-কারখানা স্থাপন, ব্যাংক, বীমা ও অন্যান্য পুঁজি বিনিয়োগ সংগঠনগুলো পরিচালনা করে।
জনস্বাস্থ্য সংরক্ষণ
সুস্থ, সবল জনগণ রাষ্ট্রের সম্পদ। জনস্বাস্থ্যের উন্নতির জন্য রাষ্ট্র হাসপাতাল, শিশু কল্যাণ কেন্দ্রে, চিকিৎসা কেন্দ্রে, মাতৃসদন ও গবেষণা কেন্দ্র স্থাপন করে থাকে। পানীয় জলের সুব্যবস্থার জন্য নলকূপ খনন এবং পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা অভিযান পরিচালনা করে। ম্যালেরিয়া ও বসন্ত উচ্ছেদ অভিযান এবং কলেরা ও অন্যান্য ব্যাধির প্রতিষেধক টিকা ইনজেকশন দেয়ার ব্যবস্থা করে।
যোগাযোগ ব্যবস্থা
দেশের যোগাযোগ, যাতায়াত ব্যবস্থার উন্নতির জন্য রাষ্ট্র সড়ক, রেল, পথ, বিমান, নৌপথ, ডাক, তার ও টেলিফোনের ব্যবস্থা করে। আন্তর্জাতিক যোগাযোগের ক্ষেত্রেও প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণ করে থাকে।
শ্রমিকদের কল্যাণমূলক কাজ
রাষ্ট্র শ্রমিকদের কার্যের মেয়াদ, সময়, মজুরী নির্ধারণ, মজুরী বোর্ড ও শ্রম আদালত স্থাপন করে। দরিদ্র-শ্রমিক ও জনসাধারণের লেখা-পড়ার জন্য রাষ্ট্র বিভিন্ন কার্যক্রমগ্রহণ করে। এ প্রসঙ্গে খাদ্যের বিনিময়ে শিক্ষা কার্যক্রমের কথা উল্লেখ করা যায়।
সামাজিক নিরাপত্তা ও জনহিতকর কার্যাবলী
জনসাধারণের কল্যাণের জন্যে রাষ্ট্র পেনশন, কল্যাণভাতা, যৌথবীমা, বয়স্কভাতা, বেকারভাতা ইত্যাদি পদক্ষেপ নিয়ে থাকে। কৃষি, সেচব্যবস্থার উন্নতি সাধন করে থাকে। এছাড়া দুর্ভিক্ষ, মহামারী ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করে থাকে। রাষ্ট্রের স্বেচ্ছামূলক কার্যের আওতা অতি ব্যাপক। বর্তমানে কোন রাষ্ট্রই আর পুলিশী রাষ্ট্র নয়। তাই রাষ্ট্রের ঐচ্ছিক কার্যাবলীর গুরুত্ব বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে।
আরও পড়ুন: আইন ও স্বাধীনতার সম্পর্ক