আইনের উৎস সমূহ
আমরা জানি যে, আইন হল রাষ্ট্রের মত বহু বিবর্তনের ফল। বিভিন্ন ধরনের আইনের উৎস রয়েছে। অধ্যাপক হল্যান্ড আইনের ছয়টি উৎসের কথা উল্লেখ করেছেন। এগুলো সম্পর্কে নিচে আলোচনা করা হলো-
প্রচলিত প্রথা
সকল দেশেই আইনের অন্যতম উৎস হচ্ছে সামাজিক রীতি-নীতি বা প্রচলিত প্রথা। রাষ্ট্র সৃষ্টির পূর্বে মানুষের জীবনযাত্রা সামাজিক প্রথার দ্বারা পরিচালিত হত। সামাজিক প্রথা রাষ্ট্রের স্বীকৃতি লাভ করে আইনে পরিণত হয়। বিভিন্ন দেশে কতিপয় প্রথাগত বিধান আইনের সৃষ্টি করেছে। রাষ্ট্র কর্তৃক প্রণীত বিভিন্ন আইনের পরিপূরক হিসেবে প্রথাগত বিধানগুলোও আইনের মর্যাদা লাভ করে। ইংল্যান্ডের সাধারণ আইনগুলোও প্রচলিত-প্রথার উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে।
ধর্ম
আদি যুগে ধর্ম থেকেই অনেক আইনের সৃষ্টি হয়েছে। ধর্মীয় অনুশাসনও অনেক ক্ষেত্রে আইনের উৎস হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী মানুষ নিজ আচরণ মেনে চলে। ধর্মের বিধি-বিধান রাষ্ট্রের সমর্থন লাভ করে আইনে পরিণত হতে পারে। হিন্দু ও মুসলমান সম্প্রদায়ের বহু প্রকার আইনের উৎস হচ্ছে ধর্ম। তাই বলা যায়, ধর্ম আইনের আরেকটি উৎস।
বিজ্ঞানসম্মত ভাষ্য
বিশিষ্ট আইনবিদদের বিজ্ঞানসম্মত পর্যালোচনাও আইনের অন্যতম উৎস। তাদের মতবাদ যুক্তি হিসেবে গ্রহণ করা হয়, সিদ্ধান্ত হিসেবে নয়। বিজ্ঞানসম্মত আলোচনার স্বীকৃতিস্বরূপ একে বিচারকদের সিদ্ধান্ত বলেই গণ্য করা হয়।
আরও পড়ুন: আইন কি? আইন কত প্রকার ও কি কি? আইনের শাসন বলতে কি বুঝায়?
বিচারকের রায়
বিচার করতে গিয়ে অনেক সময় বিচারকগণ সমস্যায় পড়েন। কারণ প্রচলিত আইনকে হয়ত কোন কারণে ব্যবহার করা সম্ভবপর হয় না। তখন তারা নিজস্ব বুদ্ধি ও অভিজ্ঞতার আলোকে নতুন আইন তৈরি করেন এবং বিচারের রায় দেন। ফলে নতুন আইন তৈরি হয়। পরবর্তীতে বিচারকগণ এ সকল নতুন আইন অনুসরণ করেন।
ন্যায়বোধ
আইনের আর একটি উৎস হচ্ছে বিচারকগণের ন্যায়বোধ। বিচারকগণের কাছে অনেক সময় এমন মামলা উপস্থিত হয় যা প্রচলিত আইনের দ্বারা বিচার করা চলে না। এ সকল ক্ষেত্রে বিচারকগণ মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি ও ন্যায়বোধের দ্বারা বিচার করে থাকেন। তাদের ন্যায়বোধ হতে যে সকল সিদ্ধান্ত গড়ে উঠে তা থেকে আইনের সৃষ্টি হয়ে থাকে।
আইন সভা
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং ফলপ্রসু উৎস হল আইনসভা কর্তৃক আইন প্রণয়ন। বর্তমান বিশ্বে আইনসভা কর্তৃক প্রণীত আইন আইনের একটি বিরাট উৎস। আইনসভা পুরাতন আইনের সংশোধন করে এবং প্রয়োজন অনুযায়ী নতুন আইন প্রণয়ন করে।
জনমত
আইনের উৎস হিসেবে জনমত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আইনসভার সদস্যগণ জনগণের প্রতিনিধি। জনমতের বাস্তব প্রতিফলন ঘটানো তাদের অন্যতম দায়িত্ব। কাজেই আইনসভায় যে কোন আইন প্রণয়নের সময় জনমতের প্রতি বিশেষভাবে লক্ষ্য রাখা হয়। আইন বিশারদ ওপেনহেইম বলেন, “জনমত আইনের অন্যতম উৎস।”
নির্বাহী ঘোষণা ও ডিক্রী
বর্তমান যুগে বিভিন্ন কারণে আইনসভা তার কর্তৃত্বকে শাসন বিভাগের মাধ্যমেও পরিচালিত করে। এ অবস্থায় শাসন বিভাগের জারিকৃত ঘোষণা ও আদেশগুলোও আইনে পরিণত হয়। তাই বলা যায় যে, প্রশাসনিক আইনের উৎস নির্বাহী ঘোষণা ও ডিক্রী।
সংবিধান
সংবিধান আইনের সবচেয়ে বড় উৎস। সংবিধান একটি বিশেষ দলিল। আইনসভা ও অন্যান্য সরকারি বিভাগের ক্ষমতা সীমিত ও তাদের কার্যরীতি প্রতিষ্ঠার জন্যে সংবিধান তৈরি করা হয়। সংবিধানে বিভিন্ন ধরনের বিধানাবলী লিপিবদ্ধ থাকে যেগুলো আইনসভা এবং সরকারের পথ-প্রদর্শক হিসেবে কাজ করে।
মানুষ আইন মান্য করে কেন?
নিম্নলিখিত কারণে জনসাধারণ আইন মেনে চলে:
ধর্মীয় কারণে
ধর্মীয় কারণে জনসাধারণ আইন মান্য করে। মধ্যযুগে আইন ধর্মের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছিল। তখন আইন অমান্য করা পাপ বলে বিবেচিত হত। পাপের ভয়ে জনসাধারণ আইন মেনে চলত।
সুখ-শান্তি ও নিরাপত্তার লক্ষ্যে
সুখ-শান্তিও নিরাপত্তার কারণে জনসাধারণ আইন মান্য করে চলে। আইন মান্য করে চললে রাষ্ট্রে শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় থাকে এবং জনসাধারণ সুখ-শান্তি ও নিরাপদে বসবাস করতে পারে।
শাস্তির ভয়
শাস্তির ভয়ে জনসাধারণ আইন মান্য করে চলে। আইন ভঙ্গ করা শাস্তিমূলক অপরাধ। আইন অমান্য করলে রাষ্ট্র কর্তৃক প্রদত্ত শাস্তি পেতে হয় এবং সমাজ কর্তৃক নিন্দিত হতে হয়।
ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য
ন্যায় প্রতিষ্ঠার তাগিদে জনসাধারণ আইন মান্য করে চলে। আইন দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালন করে সমাজে ন্যায় প্রতিষ্ঠা করে। আইন না থাকলে অনিয়মে দেশ ছেয়ে যেত এবং মানব সভ্যতা বিলুপ্ত হত।
মৌলিক অধিকার সংরক্ষণের জন্য
প্রত্যেক রাষ্ট্রেই জনসাধারণের মৌলিক অধিকার রয়েছে। আইন না থাকলে এ সকল মৌলিক অধিকার ভোগ করা সম্ভব নয়। মৌলিক অধিকার সংরক্ষণ ও ভোগের জন্যে জনসাধারণ আইন মান্য করে চলে।
মনুষ্যত্ব ও ব্যক্তিত্ব বিকাশের জন্য
মনুষ্যত্ব ও ব্যক্তিত্ব বিকাশের জন্য জনসাধারণ আইন মান্য করে চলে। সুখ-শান্তি ও নিরাপত্তার অভাব হলে জনসাধারণ মানবিক গুণাবলী ও ব্যক্তিত্ব বিকাশের সুযোগ পায় না। ফলে সভ্যতা, সমৃদ্ধি ও উন্নতি ব্যাহত হয়।
উপযোগিতা উপলব্ধি
আইনের উপযোগিতাও জনসাধারণের আইন মানতে অনুপ্রাণিত করে। মানুষ সামাজিক জীব। সমাজে বাস করতে হলে কিছু নিয়ম-কানুন মেনে চলতে হবে। এটি জনসাধারণ উপলব্ধি করে বলেই তারা আইন মেনে চলে।
লর্ড ব্রাইস এর মতে, জনসাধারণ পাঁচটি কারণে আইন মেনে চলে। যথা-
১. আলস্য
২. অপরের প্রতি শ্রদ্ধা
৩. শাস্তির ভয়
৪. সহানুভূতি ও
৫. বিচার-বুদ্ধি।
যে দেশ যত বেশি উন্নত ও শিক্ষিত সে দেশের জনসাধারণ তত বেশি আইন মেনে চলে।