Home » বাংলাদেশে বৌদ্ধ ধর্ম প্রচার ও প্রসারের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস তুলে ধর।

বাংলাদেশে বৌদ্ধ ধর্ম প্রচার ও প্রসারের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস তুলে ধর।

by TRI

গৌতম বুদ্ধের আবির্ভাব ষষ্ঠ শতকে। তিনি উত্তর প্রদেশের কপিলা বস্তু রাজ্যের শাক্য বংশে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা ছিলেন রাজা শুদ্ধোধন ও মাতা ছিলেন রানী মহামায়া। তিনি ছিলেন রাজ সন্ন্যাসী, সর্বত্যাগী মহাপুরুষ। জীবনের প্রাচুর্য্যর মধ্য হতেই তিনিই জীবন সত্যকে উপলব্ধি করেছিলেন। তিনি মানুষকে সঠিক পথ বা দুঃখ মুক্তির পথ দেখানোর জন্য বৌদ্ধ ধর্ম প্রচার করেছিলেন। তার ধর্মমত ছিল একান্তভাবে বাস্তবমুখী ও সার্বজনীন।

বুদ্ধ তার সুসংগঠিত সংঘকে নিয়ে দীর্ঘ ৪৫ বছর সমগ্র ভারত ও মধ্য ভারতে ধর্ম প্রচার ‍করেছিলেন। বুদ্ধের পরিনির্বাণের পরও বিভিন্ন অঞ্চলের রাজন্য বর্গ ও ধণাঢ্য ব্যক্তি বর্গ এবং পরবর্তীকালে মৌর্য সম্রাট অশোক, কনিষ্ক, হর্ষবর্ধন, বিম্বিসার, পালবংসীয় রাজগণদের সহযোগিতায় ও পৃষ্ঠপোষকতায় বৌদ্ধ ধর্ম সমগ্র ভারতবর্ষ সহ বহির্বিশ্বে প্রচার ও প্রসার ঘটে।

বাংলাদেশে বৌদ্ধ ধর্ম প্রচার ও প্রসার

বাংলাদেশে কখন বৌদ্ধ ধর্ম প্রচার হয়েছিল তার সঠিক তথ্য এখনও নির্ধারণ করা সম্ভব হয়নি। তবে অনুমান করা যায় খ্রিষ্ঠপূর্ব ৬ষ্ঠ শতকে গেীতম বুদ্ধের সময়কাল হতেই সদ্ধর্মের আলো বাংলায় বিকীর্ণ হয়েছিল। প্রত্নতাত্ত্বিক উপকরণ ও বৌদ্ধ সাহিত্য হতে জানা যায়, এককালে প্রাচীন ভারতের বৌদ্ধ ধর্মের আলো বিস্তৃত অঞ্চল ছড়িয়ে পড়েছিল। বুদ্ধের ধর্ম যে সব স্থানকে কেন্দ্র করে প্রচারিত এবং প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বাংলাদেশ এর অতি নিকটেই। একমাত্র এ কারণে ধারণা করা হয় বুদ্ধের জীবিতাবস্থায় বাংলাদেশে বৌদ্ধ ধর্ম প্রচারিত হয়েছিল। এ প্রসঙ্গে জাহ্নবী কুমার চক্রবর্তীর অভিমতও বিশেষ উল্লেখযোগ্য। তার মতে, মহামানব বুদ্ধ বৃহৎ বঙ্গের শেষ সীমায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তার ধর্ম প্রচারের কেন্দ্রগুলির মধ্যে মগধ ছিল অন্যতম। মগধ ও বঙ্গ এই উভয় রাজ্যই পাশাপাশি অবস্থিত। সে সূত্রে গেীড়বঙ্গে বৌদ্ধধর্মের মূল প্রভাব ‍নিশ্চয়ই ছিল এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যেতে পারে।

আরও পড়ুন:   রাজা মিলিন্দ কে ছিলেন? তার জীবন সম্পর্কে সম্যক ধারণা দাও।

তাছাড়া বাংলাদেশের প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমার ও শ্রীলংকায় বুদ্ধের যাতায়াত ও ধর্ম প্রচার যদি হয়ে থাকে ,বুদ্ধের ধর্ম প্রচারের কেন্দ্রভূমি মগধ হতে নিকটবর্তী বাংলাদেশের মাটিতে বুদ্ধের যাতায়াত হবে না কেন? বর্তমান বাংলাদেশের দক্ষিণ পাশেই মিয়ানমার।

সে দেশের বৌদ্ধধর্মের প্রচারের ইতিহাস স্মরণ করিয়ে দেয় যে,মগধ হতে বাংলাদেশের যাতায়াতের সুবিধা মিয়ানমার থেকে অনেক বেশি ছিল। মিয়ানমারের যদি সে সময় বৌদ্ধ ধর্ম প্রচারিত হয়ে থাকে ,তবে বাংলাদেশেও সে সময় বৌদ্ধধর্ম প্রচারিত হয়ে থাকবে তা মেনে নেয়া যেতে পারে। সে সময় বাংলাদেশের উপর দিয়েই মগধ থেকে মিয়ানমার যাতায়াত করা ভিন্ন অন্য কোন পথ ছিল না। গৌতম বুদ্ধ বাংলাদেশে আগমন করেছেন বলে কোন প্রাচীন গ্রন্থাদিতে বা কোন শিলালিপিতে উল্লেখ নেই। কিন্তু বিভিন্ন সময়ে প্রণীত পালি গ্রন্থ ও ইতিহাসশ্রয়ী সমসাময়িক সূত্রাবলীর সূত্র ধরেই পারিপার্শ্বিকতার আলোকে বুদ্ধ যে বাংলাদেশের মাটিতেও আগমন করে ধর্ম প্রচার করেছেন বলে অনুমান করা যায়।

অঙ্গুত্তর নিকায় গ্রন্থে কজঙ্গলা সূত্র হতে জানা যায়,বুদ্ধ একসময় কজঙ্গলা পরিভ্রমণে আসেন। সেখানকার সুবেস বনে কিছুকাল অবস্থান করেন। এ কজঙ্গলা প্রাচীন অঙ্গ, উত্তর রাঢ় ও গৌড়ের মধ্যবর্তী রাজমহলের গ্রাম।রমেশ চন্দ্র মজুমদার ও অন্যান্য ঐতিহাসিকদের মতে, কজঙ্গলা প্রাচীন বৃহৎ বঙ্গের  অন্তর্গত একটি রাজ্য ছিল। বর্তমান কাকজোল গ্রামই উক্ত কজঙ্গলা গ্রাম। এর দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, বুদ্ধ স্বয়ং বাংলাদেশের মাটিতে আগমন করেছিলেন। অঙ্গুত্তর নিকায়, সংযুক্ত নিকায়, থেরগাথা ও অপদান গ্রন্থে জানা যায় বুদ্ধের আশিজন সাক্ষাৎ মহাশ্রাবকদের অতুলনীয় কবিদের অধিকারী “বঙ্গীস ”ছিলেন অন্যতম। তারা উভয়ে বাংলাদেশের অধিবাসী বলে এরুপ নামধারী হয়েছিল।

আবার বগুড়ার ইতিকাহিনীর লেখকের ভাষায় চীন দেশীয় পর্যটকের  মতে, উপকন্ঠে (ভাসুবিহার) গৌতম বুদ্ধ ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে কিছুকাল আবার কারও কারও মতে ৬ মাস অবস্থান করেছিলেন। সেখানে অশোক নির্মিত স্মারক স্তুপ ও বুদ্ধের পদচিহ্ন আছে বলে অনেকের ধারণা। জনশ্রুতি মতে, গৌতম বুদ্ধ স্বীয় ঋদ্ধিযোগে জম্বুদ্বীপের বিভিন্ন অঞ্চল পরিভ্রমনকালে বর্তমান চক্রশালা, হাইদগং চট্টগ্রামে বিশ্রাম গ্রহণ করেছিলেন। বাংলাদেশের ইতিহাসে উল্লেখ আছে, বাংলার বীর সন্তান বিজয়সিংহ বুদ্ধের পরিনির্বানের অব্যবহিত পূর্বেই বুদ্ধের নির্দেশক্রমে দেবরাজ ইন্দ্রের সহায়তায় শ্রীলংকা জয় করেন। একজন বাঙালী বীর সন্তান দ্বারা শ্রীলংকা জয় হবে যুগপথ বুদ্ধের ধর্ম প্রচার লাভ করবে বলেই বুদ্ধ বিজয় সিংহের প্রতি এরুপ করুণা প্রদর্শন করেছিলেন। এসব কারণে বুদ্ধের জীবদ্দশায় বাংলাদেশে বৌদ্ধধর্ম প্রচারিত হয়েছি বলে ধারণা করা হয়।

এছাড়াও সম্রাট অশোক কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত সাঁচী স্তুপের দক্ষিণ দিকের তোরণটি পুন্ড্রবর্ধনবাসী ধর্মদত্তা ও খষ্টি নন্দনের অর্থ ব্যয়ে নির্মিত হয়েছিল বলে এখানকার শিলালিপিতে উল্লেখ আছে। এ শিলালিপি দুইটিকে মৌর্যযুগে বাংলাদেশে বৌদ্ধধর্ম প্রচারের শিলালিপিগত ঐতিহাসিক প্রমাণ হিসেবে গণ্য করা হয়। অশোকোত্তর যুগে বাংলাদেশকে মধ্যদেশে অন্তর্ভুক্ত করে নেয়ার প্রমাণ পাওয়া যায়।

তৎকালীন বাংলাদেশে বুদ্ধের আগমন বা বৌদ্ধ ধর্ম প্রচার প্রসঙ্গে হিউয়েন সাঙ এর ভ্রমণ বিবরণীও বিশেষ উল্লখযোগ্য। চীনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙ (খ্রি:৬২৯-৬৪৫) তৎকালীন প্রচলিত কিংবদন্তী অনুসরণ করে তার ভ্রমণ বিবরণীতে লিপিবদ্ধ করেছেন যে, বুদ্ধধর্ম প্রচারের জন্য ৩ মাসের অধিককাল পুন্ড্রবর্ধন, সমটত,তাম্রলিপি ও কর্ণসুবর্ণে অবস্থান করেছিলেন। এ সমস্ত স্থানে তিনি অশোক নির্মিত স্তুপ ও স্তম্ভ দেখতে পান।

উপরিউক্ত তথ্য ব্যতীত চট্টগ্রামে বুদ্ধের আগমন ও ধর্মপ্রচার সংক্রান্ত কিছু লোকের কথা ও কিংবদন্তী উল্লেখ আছে। বৌদ্ধ সাহিত্যে মহাবংশ মতে, সম্রাট অশোকের পৃষ্টপোষকতায় মোগ্গলিপুত্ত ‍তিস্‌স থের নের্তৃত্বে তৃতীয় মহাসংগীতি পাটলিপুত্র নগরে অনুষ্ঠিত হয়। এরপর অশোক বৌদ্ধধর্ম প্রচারের জন্য বিভিন্ন স্থানে, দেশে,ধর্ম প্রচারক প্রেরণ করেছিলেন। কিংবদন্তী আছে, বুদ্ধ স্বয়ং একবার চট্টগ্রামে হস্তী গ্রামে এসে পক্ষকাল অবস্থান করে ধর্ম প্রচার করেছিলেন। সেই হস্তীগ্রাম চট্টগ্রাম পটিয়ার হাইদাগং বলে মনে হয়।

গৌতম বুদ্ধের দীর্ঘ ৪৫ বছর ধর্মপ্রচার কালে বাংলাদেশে বৌদ্ধ ধর্ম প্রচার ও প্রতিষ্ঠার বিষয়ে ঐতিহাসিক, গবেষক ও পন্ডিতগণ একমত নন। তবে বাংলাদেশের ঢাকা জেলার ধামরাই ও শাখাসর অঞ্চলে প্রাপ্ত সম্রাট অশোক প্রতিষ্ঠিত বলে কথিত স্তম্ভ ও লিপি ১৯৩১ সালে মহাস্থানগড়ে আবিষ্কৃত মৌর্যযুগের শিলালিপি ও কাল নির্দেশক বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক বস্তু ইত্যাদি দ্বারা নিশ্চিত অনুমান করা যায়। বুদ্ধের জীবদ্দশায় না হলেও অন্তত মৌর্যযুগের বাংলাদেশে বৌদ্ধধর্ম প্রবেশের সাক্ষী হিসেবে মহাস্থানগড়ের মৌর্যযুগের পাথুরে প্রমাণকে ঐতিহাসিক ও প্রত্নতাত্ত্বিকগণ স্বীকার করেন।

সুতরাং, প্রাচীন বৌদ্ধ ঐতিহ্য বিভিন্ন শিলা ও স্তম্ভলিপি চৈনিক পরিব্রাজকদের ভ্রমণ কাহিনী এবং বিভিন্ন ঐতিহাসিক,প্রত্নতাত্ত্বিক ও গবেষকদের মতামতের প্রেক্ষিতে বলা যায় মৌর্যযুগে পুন্ড্রবর্ধনকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশে বৌদ্ধ ধর্ম প্রচারিত হয়েছিল এবং পরবর্তীকালে তা সমগ্র বাংলাদেশে বিস্তার লাভ করেছিল। 

কিছু প্রশ্নোত্তর

১। বৌদ্ধ ধর্ম গ্রন্থের নাম কি ?

উত্তর: ত্রিপিটক।

২। বৌদ্ধ ধর্মের প্রবর্তক কে ?

উত্তর: গৌতম বুদ্ধ (গৃহী নাম সিদ্ধার্থ)।

 

Related Posts