মূল্যবোধ কত প্রকার
মূল্যবোধ কত প্রকার তা নির্দিষ্ট নয়। বিভিন্ন সমাজবিজ্ঞানী মূল্যবোধকে বিভিন্নভাবে শ্রেণিবিন্যাস করেছেন। মূল্যবোধ বিভিন্ন ধরনের হতে পারে। নিচে মূল্যবোধের প্রকারভেদ আলোচনা করা হলো:
১। ব্যক্তিগত মূল্যবোধ
ব্যক্তিগত মূল্যবোধ ব্যক্তির জীবন বিকাশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। ব্যক্তিগত মূল্যবোধ তৈরিতে পরিবার, বিভিন্ন সামাজিক ও রাজনৈতিক সংগঠন, সংস্কৃতি ইত্যাদির প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। ব্যক্তি পরিবার থেকেই মানবীয় গুণাবলি যেমন- কর্তব্যনিষ্ঠা, সত্যবাদিতা, সততা, বন্ধুবাৎসল্য, স্নেহপ্রবণতা ইত্যাদি অর্জন করে থাকে। ব্যক্তিগত মূল্যবোধ ব্যক্তির স্বকীয়তাবোধ সৃষ্টিতে সহায়তা করে থাকে। ব্যক্তির বাচনভঙ্গি, পোশাক-পরিচ্ছদ, পরিচ্ছন্নতা, চিন্তা ও মত প্রকাশের ধরন ইত্যাদি মূল্যবোধ ব্যক্তিগত মূল্যবোধের অংশ।
২। নৈতিক মূল্যবোধ
মানুষের ভালো-মন্দ, উচিত-অনুচিত, ন্যায়-অন্যায় বোধ নিয়ে নৈতিক মূল্যবোধ গঠিত। নৈতিক মূল্যবোধের কারণে সমাজে মানুষ নীতিবর্জিত কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থাকে। নৈতিক মূল্যবোধ সমাজে মানুষের সম্প্রীতির বন্ধন সুদৃঢ় করে এবং মানুষের মধ্যে ঐক্য সৃষ্টি করে।
৩। সামাজিক মূল্যবোধ
ব্যক্তির যেসব গুণ, আচার-আচরণ ও কর্মকাণ্ড সমাজজীবনকে নিয়ন্ত্রণ করে এবং সমাজে শৃঙ্খলা স্থাপন করে, ব্যক্তির সেসব আচরণ ও কর্মকাণ্ডের সমষ্টিকে সামাজিক মূল্যবোধ বলে। সামাজিক মূল্যবোধ সামাজিক ঐক্য ও শান্তি-শৃঙ্খলার চাবিকাঠি। সামাজিক মূল্যবোধ ব্যক্তিকে সামাজিক বন্ধনে আবদ্ধ করে। সামাজিক মূল্যবোধ বলতে শৃঙ্খলাবোধ, ন্যায়পরায়ণতা, সততা, শিষ্টাচার, সহনশীলতা ইত্যাদিকে বোঝায়।
আরও পড়ুন: মূল্যবোধ কি? মূল্যবোধের বৈশিষ্ট্য গুলো আলোচনা কর
৪। রাজনৈতিক মূল্যবোধ
রাজনৈতিক মূল্যবোধ বলতে ব্যক্তির রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ, রাজনৈতিক আদর্শ ও নিয়মাবলি পালন করাকে বোঝায়। রাজনৈতিক মূল্যবোধ রাষ্ট্রে রাজনৈতিক সংস্কৃতি তৈরিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে পরমতসহিষ্ণুতা, সবার মতের প্রাধান্য, অসাম্প্রদায়িকতা ইত্যাদি রাজনৈতিক মূল্যবোধের অংশ। রাজনৈতিক মূল্যবোধ নাগরিকদের মধ্যে রাজনৈতিক চেতনার বিকাশ ঘটায়।
৫। জাতীয় মূল্যবোধ
যেসব আচার-আচরণের মধ্য দিয়ে জাতীয় বা রাষ্ট্রীয় আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটে সেসব আচার-আচরণের সমষ্টিকে জাতীয় মূল্যবোধ বলে। রাষ্ট্রের সব নাগরিকের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টায় জাতীয় মূল্যবোধ রক্ষিত হয়। জাতীয় সম্পদ বিনষ্ট করা, দেশের সম্মান হানিকর কোনো কার্যে লিপ্ত হওয়া জাতীয় মূল্যবোধের পরিপন্থী। মূলত জাতীয় মূল্যবোধ জাতীয় উন্নয়নের চালিকাশক্তি।
৬। সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ
সমাজে দীর্ঘদিন ধরে প্রচলিত ধ্যানধারণা, অভ্যাস, রীতিনীতি সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ তৈরি করে। সমাজব্যবস্থায় একত্রে বসবাস করা, বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠান পালন, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, শ্রমের মর্যাদা, সৌজন্য, ক্ষমাশীলতা ইত্যাদি সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ। সামাজিক উন্নয়নের লক্ষ্যে সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ বিশেষভাবে কাজ করে থাকে।
৭। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ
গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে মানুষের যে আদর্শ ও আচার-ব্যবহার তার কর্মকাণ্ডকে একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পরিচালিত করে তাকে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ বলে। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ জনগণের গণতান্ত্রিক চিন্তা-চেতনা ও শিক্ষার প্রসার ঘটায়। সমাজব্যবস্থায় পরমতসহিষ্ণুতা, সহনশীলতা, সংহতি ইত্যাদি গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের অংশ।
৮। ধর্মীয় মূল্যবোধ
সমাজজীবনে মানুষের আচার-আচরণ, অভ্যাস, রীতিনীতি ধর্মীয় মূল্যবোধ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। ব্যক্তিগত ও সমাজজীবনে ধর্মীয় অনুশাসন, বিধিবিধান পালন, অন্য ধর্মকে হেয় না করা, সব ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ও সহনশীল হওয়া ইত্যাদি ধর্মীয় মূল্যবোধের অংশ। অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তুলতে ধর্মীয় মূল্যবোধের চেতনা অপরিহার্য।
৯। বুদ্ধিবৃত্তিক মূল্যবোধ
কোনো বিষয়কে বাস্তবিকভাবে বোঝার সামর্থ্যই হচ্ছে বুদ্ধিবৃত্তিক মূল্যবোধ। আমরা সমাজ বা পরিবশে অনেক বিষয় দেখতে পাই, এই বিষয়গুলো বিভিন্ন জন বিভিন্নভাবে গ্রহণ করে। সমাজ বা পরিবেশ থেকে উদ্ভূত কোনো বিষয়কে যৌক্তিকভাবে গ্রহণ করা বুদ্ধিবৃত্তিক মূল্যবোধের মধ্যে পড়ে। এ ধরনের মূল্যবোধ উত্তরাধিকারসূত্রে মানুষ পায়, আবার অনেকে নিজেও অর্জন করে। সামাজিক শৃঙ্খলা রক্ষায় বুদ্ধিবৃত্তিক মূল্যবোধ খুবই প্রয়োজন।
১০। পরিবর্তিত মূল্যবোধ
নতুন অভিজ্ঞতা অর্জনের ফলে কিছু মূল্যবোধেল বিকাশ ঘটে। যেমন- স্কুলজীবন শেষ করে কলেজ জীবনে প্রবেশের সময় নতুন অভিজ্ঞতা কিছু মূল্যবোধের বিকাশ ঘটায়। আবার শিক্ষাজীবন শেষ করে কর্মজীবনে প্রবেশের সময়ও নতুন অভিজ্ঞতা কিছু মূল্যবোধের সৃষ্টি করে। এভাবে জীবনের বিভিন্ন ধাপে মানুষের মধ্যে নতুন কিছু মূল্যবোধের জন্ম হয়।