মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের প্রস্তাবনা
১৭৮৭ সালে ফিলাডেলফিয়া সম্মেলনে রচিত ও গৃহীত মার্কিন সংবিধানেই সর্বপ্রথম একটি প্রস্তাবনা সংযুক্ত করা হয়। এর আগে সংবিধানে প্রস্তাবনা সংযোজনের কোন নজির নেই। মার্কিন সংবিধানের পর থেকেই বিভিন্ন দেশের লিখিত সংবিধানের শুরুতেই একটি প্রস্তাবনা সংযোজন বর্তমানে একটি রীতিতে পরিণত হয়েছে। এক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিধানই হল পথ প্রদর্শক। মার্কিন সংবিধানের প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে- ❝আমরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জনগণ একটি অধিকতর সার্থক রাজ্যসংঘ গঠন, ন্যায়বিচার, আভ্যন্তরীন শান্তি-শৃঙ্খলা ও যৌথ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠা এবং সর্ব সাধারণের কল্যাণ বৃদ্ধি, আমাদের এবং আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের জন্য এবং স্বাধীনতার আশীর্বাদ লাভ করার উদ্দেশ্যে যুক্তরাষ্ট্রের এই সংবিধান বিধিবদ্ধ ও প্রতিষ্ঠা করছি❞
প্রস্তাবনার পরিপ্রেক্ষিতে মার্কিন সংবিধানের উৎস হল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জনগণ। মার্কিন জনগণের অনুমোদন ক্রমে এই সংবিধান রচিত ও গৃহীত হয়েছে। ১৭৭৬ সালের স্বাধীনতার ঘোষণার যে সমস্ত মৌলিক নীতি ও আদর্শের কথা ঘোষণা করা হয়েছিল, সেগুলিকে প্রস্তাবনায় গুরত্ব সহকারে সংযুক্ত করা হয়েছে।
তবে সমালোচকদের মতানুসারে মার্কিন সংবিধানের উৎস হিসাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জনগণের কথা বলা যায় না। মার্কিন জনগণ এই সংবিধান রচনা বা গ্রহণ করেনি। মার্কিন জনসাধারণের সকল অংশের প্রতিনিধি ফিলাডেলফিয়া সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন না। প্রধানত; কায়েমী স্বার্থের প্রতিনিধিরাই সাংবিধানিক সম্মেলনের কার্যক্রমকে প্রভাবিত করেছেন। তার ফলে এই শ্রেণীর স্বার্থই সংবিধানে প্রতিফলিত হয়েছে।
ভারতের সংবিধানের প্রস্তাবনা
ভারতীয় সংবিধান একটি গণতান্ত্রিক সংবিধান। সংবিধানের প্রস্তাবনার উপর ভারতীয় সংবিধানের গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে। প্রস্তাবনাকে সাংবিধানিক লিখিত প্রচেষ্টার সংবিধানের অর্থে ও চেতনার মূল হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। ভারত স্বাধীনতার সূচনা লগ্ন থেকেই এটি একটি কল্যাণমূলক রাষ্ট্র হিসেবে কাজ করে যাচ্ছে। মূলত ভারতীয় সংবিধানের মূল দর্শন এর প্রস্তাবনায় নিহিত রয়েছে।ভারতই কল্যাণমূলক আদর্শ রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠায় এবং আর্থ-সামাজিক ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠায় কাজ করেছে।
ভারতীয় সংবিধানের প্রস্তাবনার মূল বিষয়সমূহ
উৎপত্তিগত ভাবে ভারতীয় সংবিধানের প্রস্তাবনায় যে শব্দ গুলো রয়েছে তা হল-
আমরা ভারতের জনগণ পবিত্র ভাবে মীমাংসার মাধ্যমে সমাধান করে স্বার্বভৌমত্ব, গণতন্ত্রের মাধ্যমে ভারত গঠন করতে এবং সকল জনগণের জন্য তা নিশ্চিত করতে:
- ন্যায়বিচার, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক,
- চিন্তা, মতপ্রকাশ, ধর্মীয় আস্থা, বিশ্বাসের স্বাধীনতা,
- সম্মান ও সুযোগের সমতা; এবং সকলের মধ্যে তা উন্নীত করা।
- জাতীয় ঐক্যে এবং ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য/ব্যক্তির মর্যাদায় ভ্রাতৃত্ব নিশ্চিত করণ:
এবং আরো বলা আছে, “In our constituent assembly this twenty-Sixth day of November, 1949, Do hereby adopt, enact give to ourselves this Constitution”
আরও পড়ুন: সংবিধানের প্রস্তাবনা কি? বাংলাদেশের সংবিধানের প্রস্তাবনা কয়টি ও কি কি?
যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতীয় সাংবিধানিক প্রস্তাবনার তুলনা
যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের প্রস্তাবনার সাথে ভারতীয় সংবিধানের প্রস্তাবনার তুলনা করা যায়। এক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের প্রস্তাবনায় বলা আছে যে, ❝আমরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জনগণ একটি অধিকতর সার্থক রাজ্যসংঘ গঠন, ন্যায়বিচার, আভ্যন্তরীন শান্তি-শৃঙ্খলা ও যৌথ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠা এবং সর্ব সাধারণের কল্যাণ বৃদ্ধি, আমাদের এবং আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের জন্য এবং স্বাধীনতার আশীর্বাদ লাভ করার উদ্দেশ্যে যুক্তরাষ্ট্রের এই সংবিধান বিধিবদ্ধ ও প্রতিষ্ঠা করছি❞ -এই বিষয়সমূহ ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র উভয় সংবিধানের প্রস্তাবনায় উল্লেখ আছে। উভয় দেশেই জনগণকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। উভয় দেশেই স্বাধীনতা ও ন্যায়বিচারের কথা বলা হয়েছে। যাই হোক ঐতিহাসিক পরিমন্ডলের কারণে এখানে উভয় দেশের প্রস্তাবনায় কিছু নির্দিষ্ট ভিন্নতা আছে।
১. যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাবনায় সাধারণ প্রতিরক্ষা ও আভ্যন্তরীন শান্তি-শৃঙ্খলার উপর জোর দেওয়া হয়েছে। এর কারণ হল আমেরিকান সংবিধান যখন গৃহীত হয় তখন সেখানে প্রচুর অনাচার চলছিল। দীর্ঘদিন আমেরিকানরা ব্রিটিশ শাসনের কবলে থাকতে থাকতে আইনহীনতা বিস্তার লাভ করছিল। তাই যুদ্ধের পর ব্রিটিশদের কাছ থেকে মুক্তি লাভের পর সংবিধানের প্রস্তাবনায় আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উপর জোর দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে। আর ব্যাপক ত্যাগ ও প্রচেষ্টার পর তারা যে স্বাধীনতা অর্জন করে তা রক্ষার্থে প্রতিরক্ষা সমস্যার উপর জোর দেয়।
কিন্তু এই দুটি বিষয় ভারতীয় সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করতে পারেনি। এক্ষেত্রে ভারতীয় জনগণকে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে হয়নি। সেখানে একটি শান্তিপূর্ণ ক্ষমতার রদবদল ছিল।
২. অন্যদিকে ভারতীয় সংবিধান প্রস্তাবনায় স্বার্বভৌমত্ব, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, প্রজাতান্ত্রিক গণতন্ত্র প্রভৃতির উল্লেখ থাকলেও আমেরিকান সংবিধানে তা উল্লেখ নেই।
৩. ভারতীয় সংবিধান ব্রিটিশ তত্ত্বাবধানে রচিত ছিল বলে রাজতান্ত্রিক প্রধান ছিল রাষ্ট্রপ্রধান। কিন্তু ঔপনিবেশিক শাসন হতে মুক্তি লাভের পর রাজা বা রানীকে অপসারণ জরুরী হয়ে পড়ে।
অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের জনগণ গোড়া থেকেই স্বাধীন ছিল। তাদের বাস্তবিক দিক থেকেই স্বাধীন প্রজাতন্ত্র বিদ্যমান ছিল।
৪. ভারতীয় সংবিধানে ভ্রাতৃত্বের উপর জোর দেওয়া হয়েছে। ভারতে অস্পৃশ্যতা ও বর্ণ প্রথার স্বৈরাশাসন বিদ্যমান ছিল যা অপসারণের প্রয়োজনীয়তা থেকে প্রস্তাবনায় ভ্রাতৃত্বের কথা বলা হয়েছে।
অন্যদিকে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান প্রস্তাবনায় এরূপ কোন বিষয় উল্লেখ করা হয়নি। কারণ, যখন আমেরিকার সংবিধান গৃহীত হয় তখন সেখানে বর্ণ প্রথা বা Caste-distinctions ছিল না।
৫. ভারতীয় প্রস্তাবনায় ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্রের প্রতি জোর দেওয়া হয়েছে।
অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানে এসব বিষয়ের প্রতি জোর দেয়া হয়নি। ১৯ শতাব্দীতে প্রথম বারের মত সমাজতন্ত্রের ধারণাকে পৃথক করা হয়েছিল তথাপিও USA সংবিধানে পরিলক্ষিত হয়নি। অধিকন্তু, সমাজতন্ত্রের ধারণা ও ধর্মনিরপেক্ষতার ধারণা USA সংবিধান খসড়াকালীন সময়ে ততটা বিশিষ্ট ছিল না।