Home » তত্ত্বাবধায়ক সরকার কি? বাংলাদেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রবর্তনের কারণ

তত্ত্বাবধায়ক সরকার কি? বাংলাদেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রবর্তনের কারণ

by TRI

জনপ্রিয় শাসনব্যবস্থা হিসেবে বর্তমান বিশ্বে গণতন্ত্র ঈর্ষণীয় জনপ্রিয়তা পেয়েছে এবং বিশ্বব্যাপী গণতান্ত্রিক শাসনের প্রচলন ও জনপ্রিয়তা অব্যাহত রয়েছে। বর্ধিত জনসংখ্যা এবং কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের কর্মকান্ডের পরিধি বিস্তারিত হওয়ার পর গণতান্ত্রিক বিশ্বে শাসনব্যবস্থা হিসেবে প্রতিনিধিত্বমূলক সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ব্যাপকভাবে অনুসৃত ও চর্চিত হচ্ছে। এ ব্যবস্থায় সার্বভৌম ক্ষমতা সংসদের হাতে ন্যস্ত থাকে এবং সংসদ সদস্যরা জনগণের সরাসরি ভোটে নির্বাচিত ‍হয়ে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পান। নির্বাচনের মধ্য দিয়ে যেহেতু সংসদ সদস্যরা নির্বাচিত হন, সে কারণে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নির্বাচনের গুরুত্ব বেশি। তবে নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় আসলেই কিন্তু সে সরকার গণতান্ত্রিক চরিত্রধারী হয় না। সরকারকে মুক্ত ও অবাধ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে নির্বাচিত হয়ে সবার মতামতের ভিত্তিতে সহনশীলতার সঙ্গে দেশ পরিচালনা করতে হয়। প্রভাব খাটিয়ে ক্ষমতাসীন দলের নির্বাচনে জেতার প্রচেষ্টা ও পরাজিত দলের নির্বাচনি ফলাফল মেনে না নেওয়ার সংস্কৃতি বাংলাদেশী রাজনীতির দীর্ঘমেয়াদী অসুখে পরিণত হয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যে কোন উপায়ে ক্ষমতায় টিকে থাকার প্রবণতা প্রবল হওয়ায় দলীয় সরকারের অধীনে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন সম্ভব বিবেচনা করে স্বচ্ছ ও দুর্নীতিমুক্ত নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে এবং গণতন্ত্রকে স্থিতিশীল রূপ দেবার স্বার্থে সামরিক শাসনের অবসানের পর রাজনীতিবিদরা সম্মিলিতভাবে অগণতান্ত্রিক ও অভিনব প্রকৃতির তত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার উদ্ভাবন করেন। রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশ ১৯৯০ সালের ডিসেম্বর মাসে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার ধারণার জন্ম দেয়। ১৯৯১ সালের পঞ্চম জাতীয় সংসদ সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে সাংবিধানিক স্বীকৃতি দিলে ১৯৯৬ ইং সালের ১২ই জুন দ্বিতীয় বার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। তাই অনেকে মনে করেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত এ নির্বাচন তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলোতে মডেল হিসেবে গৃহীত হবে।

তত্ত্বাবধায়ক সরকার কাকে বলে?

একটি সরকার ক্ষমতা হস্তান্তর করে অন্য একটি সরকার নির্বাচিত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত যে সরকার মধ্যবর্তী সময়ে ক্ষমতা গ্রহণ করে রাষ্ট্রের স্বাভাবিক কার্যক্রম পরিচালনা করেন, কিন্তু মৌলিক নীতিগত কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না, তাকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বলে।

সাধারণ অর্থে তত্ত্বাবধায়ন করেন যিনি, তিনিই তত্ত্বাবধায়ক। কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক সরকার একটি বিশেষ ধারণা। এটি কোন স্বাভাবিক সরকার নয়। কোন দেশের বিশেষ রাজনৈতিক পরিস্তিতিতে এর আবির্ভাব ঘটে থাকে। প্রধানত কোন নির্বাচিত সরকারের প্রতি জনগণ যখন আস্থা হারিয়ে ফেলে, তখন সে সরকারকে আন্দোলনের মুখে পদত্যাগ করতে হয়। পরবর্তী নির্বাচন না হওয়া পর্যন্ত সাময়িক সময়ের জন্য দেশ পরিচালনার ক্ষেত্রে সরকার অনিবার্য হয়ে পড়ে। সাময়িক ভাবে এ অবস্থায় যে সরকার গঠিত হয়, সে সরকারকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বলা হয়।

এককথায়, তত্ত্বাবধায়ক সরকার বলতে একটি অন্তবর্তীকালীন সরকারকে বুঝায়, যে সরকারের দায়িত্ব মূলত একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠান করা এবং নির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করে বিদায় নেয়া। নতুন সরকারের শপথ গ্রহণের সাথে সাথে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিলুপ্তি ঘটে। সুতরাং, নির্বাচিত সরকারের পরিবর্তে বা অনুপস্থিতিতে সাময়িক সময়ের জন্য যে ব্যক্তি বা ব্যক্তি সমষ্টি সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে প্রজাতন্ত্রের সকল কর্মকান্ড পরিচালনা করে, তাকেই বলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার।

আরও পড়ুন:   সরকারি প্রশাসন ও বেসরকারি প্রশাসনের মধ্যে পার্থক্য

বাংলাদেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রবর্তনের কারণ

বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর রাজনীতিতে এসব উন্নত সংস্কৃতি অনুপস্থিত। ক্ষমতা হস্তান্তর প্রক্রিয়ায় নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতা, জটিলতা, কারচুপি, ও ক্ষমতার অপব্যবহার হয়ে থাকে। তাই রাজনৈতিক দলগুলো পরস্পরের প্রতি এক ধরনের আস্থাহীনতায় ভোগে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেও এ ধরনের আস্থাহীনতার মাত্রা ক্রমশ প্রবল হয়ে দেখা দেয়। এর কারণগুলো হল-

☞স্বৈর-শাসক এরশাদের পতন

১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ নির্বাচিত সরকার হটিয়ে অস্ত্রের মুখে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন জেনারেল এরশাদ। অগণতান্ত্রিক পন্থায় ক্ষমতা দখল এবং নিজের ও নিজ দলের স্বার্থে স্বৈরতান্ত্রিক পন্থায় ক্ষমতা চর্চা করার কারণে  প্রথম থেকেই বাংলাদেশের গণতন্ত্রকামী মানুষের মধ্যে এরশাদ বিরোধী মনোভাব জন্মলাভ করে। বিশেষত ১৯৮৬ সালের নির্বাচনে ক্ষমতাসীন জাতীয় পার্টির ভোট ডাকাতি, নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবীকে যৌক্তিক পর্যায়ে নিয়ে যায়। ফলে তার বিরুদ্ধে রীতি অনুযায়ী প্রবল আন্দোলন গড়ে উঠে। সুদীর্ঘ আন্দোলনের এক পর্যায়ে রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবীটি উত্থাপিত হয়।

☞ নির্বাহী বিভাগের হস্তক্ষেপ

নির্বাচন কমিশন সচিবালয়টি প্রধানমন্ত্রীর দফতরের সাথে সংযুক্ত ছিল। ফলে নির্বাহী বিভাগ কমিশনের কর্মকান্ডে বিভিন্নভাবে হস্তক্ষেপ করে এবং নির্বাচন কমিশনের পক্ষে স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে কাজ করা অসম্ভব হয়ে পড়ে।

☞ নির্বাচন কমিশনের উপর শর্তাবলী প্রয়োগ

যদিও নির্বাচন কমিশনারদের চাকরির মর্যাদা সুপ্রিম কোর্টের বিচারকের সমমর্যাদা রাখা হয়। কিন্তু সংশিষ্ট আইন ও সংবিধানের মাধ্যমে এমন শর্তাবলী জুড়ে দেয়া হয়েছে যে, কমিশনের কর্মকর্তা-কর্মচারীগণের পক্ষে নিরপেক্ষভাবে নির্বাচনী কার্যাবলী সম্পাদন করা সম্ভব হয় না।

☞ নির্বাচন কমিশনারের স্বাধীন কার্যক্রমে বাধা

নির্বাচনী ফলাফল ঘোষণার ক্ষেত্রে মূল দায়িত্ব পালন করে থাকেন প্রত্যেক জেলার জেলা প্রশাসকগণ, যারা রিটার্নিং অফিসার নামে পরিচিত। তাদেরকে যে কোন দলীয় সরকার খুব সহজেই প্রভাবিত করতে পারে এবং তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার অভিন্ন ও স্বাধীন ক্ষমতা নির্বাচন কমিশনারের নেই। রিটার্নিং অফিসার একবার কাউকে বিজয়ী ঘোষণা করলে নির্বাচন কমিশনারের কার্যত তেমন কিছুই করার থাকে না। নির্বাচন সংক্রান্ত যাবতীয় কারচুপির অভিযোগ কেবল নির্বাচনী ট্রাইবুনালে নিষ্পত্তি করা হয়। কিন্তু নির্বাচনী ট্রাইবুনালের দীর্ঘসূত্রিতা নির্বাচনকে কলুষিত ও পক্ষপাতিত্ব দোষে দুষ্ট করার আরেক মাধ্যম। নির্বাচন কমিশনের এসব সীমাবদ্ধতা কমিশনকে তার নির্বাচনী কার্যক্রম স্বাধীনভাবে সম্পন্ন করার প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করে।

☞ রাজনৈতিক দলগুলোর পারষ্পরিক অবিশ্বাস

নির্বাচন কমিশন যদি স্বাধীনভাবে তার কার্যক্রম করতে পারে, তবে ভিন্ন কোন অনির্বাচিত সরকারের দরকার হয় না। কিন্তু যে সরকার ক্ষমতায় থাকে, তারা মুখে নির্বাচন কমিশন স্বাধীন বললেও নির্বাচন কমিশনের উপর নগ্ন হস্তক্ষেপ করে থাকে। যার ফলে বিরোধী পক্ষ এই নির্বাচন কমিশনের অধীনে নির্বাচনের আস্থা রাখতে না। রাজনৈতিক দলগুলোর এই পারষ্পরিক অবিশ্বাসের জন্য নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি উঠে।

☞ নির্বাচন কমিশনের দুর্বলতা

নির্বাচন কমিশনের দুর্বলতার কারণে দলীয় সরকারের অধীনে এ দেশে জাতীয় নির্বাচন নিরপেক্ষ ও বিশ্বাসযোগ্য হয় না।

☞ ক্ষমতা হস্তান্তরের ত্রুটি

ক্ষমতা হস্তান্তরের বিদ্যমান প্রক্রিয়ায় নানা-ধরনের ত্রুটি রয়েছে। নির্বাচন পরিচালনার মূল দায়িত্ব হলো নির্বাচন কমিশনের। নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে সরকারি হস্তক্ষেপ থেকে মুক্ত রেখে স্বাধীনভাবে পরিচালনার জন্য নির্বাচন কমিশনের বিধান পৃথিবীর বিভিন্ন গণতান্ত্রিক দেশে রয়েছে। বাংলাদেশ সংবিধানের সপ্তমভাগে নির্বাচন সংক্রান্ত একটি আলাদা বিভাগ রয়েছে এবং এতে নির্বাচন কমিশন শুধুমাত্র এ সংবিধান ও আইনের অধীন হবে। কিন্তু সংবিধানের এ বিধানটি অনেকটা শুভংকরের ফাঁকিতে পরিণত হয়েছে। 

Related Posts