রিকার্ডোর খাজনা তত্ত্ব
David Ricardo ছিলেন ইংল্যান্ডের কণিষ্ঠতম Classical অর্থনীতিবিদ। তিনি ১৮১৭ সালে তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ “The Principle of Political Economy and Taxation” – এ খাজনা সম্পর্কে যে মতামত প্রকাশ করেন, তা তাঁর নামানুসারে রিকার্ডোর খাজনা তত্ত্ব নামে পরিচিত। এ তত্ত্বে রিকার্ডো খাজনা কী, এর উৎপত্তির কারণ এবং এর পরিমাণ নির্ধারণে তার মতামত ব্যক্ত করেন।
খাজনা সম্পর্কে রিকার্ডোর মূলকথা হচ্ছে, “জমির আদি ও অক্ষয় শক্তি ব্যবহারের জন্য জমির উৎপাদনের যে অংশ এর মালিককে প্রদান করা হয় তাই খাজনা। জমির আদি ও অক্ষয় শক্তি বলতে এর উর্বরতা শক্তিকে নির্দেশ করা হয়। এই উর্বরতা শক্তির ব্যবহারের দামই খাজনা।
অনুমিত শর্তাবলি
রিকার্ডোর খাজনা তত্ত্ব নিম্নলিখিত অনুমিত শর্তের উপর নির্ভরশীল-
১. জমির আদি ও অক্ষয় ক্ষমতা বিদ্যমান;
২. জমির যোগান প্রকৃতিগত কারণে সীমাবদ্ধ;
৩. জমি প্রকৃতির দান বলে এর যোগান মূল্য নেই;
৪. জমিতে ক্রমহ্রাসমান প্রান্তিক উৎপাদন বিধি কার্যকর;
৫. জমির উর্বরতা পার্থক্য বিদ্যমান;
৬. জমির উর্বরতা পার্থক্যের কারণে জমিকে বিভিন্ন শ্রেণিতে ভাগ করা যায়;
৭. জমির উর্বরতার পার্থক্যের কারণে খাজনার উদ্ভব হয়;
৮. সমাজে পূর্ণ প্রতিযোগিতা বিদ্যমান।
রিকার্ডোর খাজনা তত্ত্বের বিশ্লেষণ
রিকার্ডো বলেন, উর্বরাশক্তির পার্থক্যহেতু জমিকে উৎকৃষ্ট বা নিকৃষ্ট শ্রেণিতে ভাগ করা যেতে পারে, উৎকৃষ্ট ও নিকৃষ্ট জমির উৎপাদনের পার্থক্যের উপর খাজনা নির্ভর করে। যে জমি চাষ করে উৎপাদনকারী কেবল উৎপাদন ব্যয় উঠাতে পারে তাকে প্রান্তিক জমি বা খাজনা বিহীন জমি বলে। উৎপাদন খরচের অতিরিক্ত আয় হলে তা খাজনা হিসেবে প্রদান করতে হয়। উর্বরতা শক্তির পার্থক্যের কারণেই বিভিন্ন শ্রেণির জমিতে খাজনার তারতম্য ঘটে। এ কারণে রিকার্ডো খাজনাকে “উৎপাদকের উদ্বৃত্ত বা পার্থক্যমূলক খাজনা” বলে অভিহিত করেছেন।
আরও পড়ুন: খাজনা কেন দেওয়া হয়? বা খাজনা দেওয়ার কারণ কি?
উদাহরণসহ তত্ত্বের বিশ্লেষণ
ধরা যাক, কোনো এক নির্জন দ্বীপে একদল লোক বসবাস করার জন্য গমন করল। দ্বীপে গিয়ে জীবনের প্রয়োজনে তাদের খাদ্য উৎপাদন আবশ্যক হয়ে পড়বে। দ্বীপের জমিকে উর্বরতার পার্থক্যের জন্য ১ম, ২য় ও ৩য় শ্রেণিতে বিভক্ত করা হয়। বুদ্ধিবৃত্তির কারণে লোকগুলো ১ম শ্রেণির জমিকে সর্বপ্রথম খাদ্য উৎপাদনের জন্য ব্যবহার করে। ১ম শ্রেণির এ জমিতে ২০ মন ধান খাদ্যের প্রয়োজনে উৎপাদিত হয়।
যেহেতু দ্বীপটির জনসংখ্যা সময়ের প্রেক্ষিতে বৃদ্ধি পায়, সেহেতু ২য় ও ৩য় শ্রেণির জমিকেও চাষের অধীনে আনতে হয়। এক্ষেত্রে ২য় শ্রেণির জমিতে ১৫ ও ৩য় শ্রেণির জমিতে ১০ মন ধান উৎপাদিত হয়। প্রতি মন ধানের দাম ২০০ টাকা হলে ১ম, ২য় ও ৩য় শ্রেণির জমি থেকে যথাক্রমে ৪০০০, ৩০০০ ও ২০০০ টাকার ধান উৎপাদন হয়। সব শ্রেণির জমির উৎপাদন আয় ২০০০ টাকা হলে ১ম ও ২য় শ্রেণির জমি থেকে যথাক্রমে ২০০০ ও ১০০০ টাকা উদ্বৃত্ত আয় সৃষ্টি হয়। ফলে ১ম ও ২য় শ্রেণির জমি থেকে যথাক্রমে ২০০০ ও ১০০০ টাকা খাজনা সৃষ্টি হবে। কিন্তু ৩য় শ্রেণির জমি থেকে উৎপাদিত ধানের দাম ও উৎপাদন খরচ সমান হলে এ জমি থেকে কোনো খাজনা সৃষ্টি হয় না। রিকার্ডো ৩য় শ্রেণির এ জমিকে “প্রান্তিক জমি” বা “খাজনাবিহীন জমি” বলে অভিহিত করেন। প্রান্তিক জমির আয় থেকে কেবলমাত্র উৎপাদন খরচ বহন সম্ভবপর হয়।
তালিকাটি নিম্নরূপ
জমির শ্রেণি | জমির আয়তন | উৎপাদন | মন প্রতি দাম | মোট আয় | মোট উৎপাদন ব্যয় | খাজনা |
১ম | ১ একর | ২০ মন | ২০০ টাকা | ৪০০০ টাকা | ২০০০ টাকা | ২০০০ টাকা |
২য় | ১ একর | ১৫ মন | ২০০ টাকা | ৩০০০ টাকা | ২০০০ টাকা | ১০০০ টাকা |
৩য় | ১ একর | ১০ মন | ২০০ টাকা | ২০০০ টাকা | ২০০০ টাকা | ০০০ টাকা |
রিকার্ডোর খাজনা তত্ত্বের সমালোচনা
রিকার্ডোর খাজনা তত্ত্ব আধুনিক অর্থনীতিবিদগণ কর্তৃক বিভিন্নভাবে সমালোচিত। সমালোচনাগুলো নিম্নরূপ-
১. জমির আদি ও অক্ষয় ক্ষমতা
রিকার্ডোর মতে, জমির আদি ও অক্ষয় ক্ষমতা বিদ্যমান। ফলে জমি থেকে খাজনার সৃষ্টি হয়। রিকার্ডোর এ ধারণা সঠিক নয়। কেননা বৈজ্ঞানিক চাষাবাদে জমির উর্বরাশক্তি বাড়ানো সম্ভব।
২. চাষাবাদ পদ্ধতি
তত্ত্বটিতে প্রথমে উৎকৃষ্ট, পরে কম উৎকৃষ্ট এবং সবশেষে নিকৃষ্ট জমি চাষের কথা বলা হয়। কিন্তু অর্থনীতিবিদ Carcy ও Rosches এর সাথে দ্বিমত পোষণ করে বলেন, ‘কৃষকরা জমির উর্বরতার চেয়ে অবস্থানকে বেশি গুরুত্ব প্রদান করে। চাষের পূর্বে মানুষ জমির অবস্থানগত গুরুত্ব বিবেচনা করে।’
৩. খাজনাবিহীন জমি
রিকার্ডোর কল্পিত খাজনাবিহিীন জমি এর অস্তিত্ব বাস্তবে নেই। সব ধরনের জমির জন্যই কম বা বেশি খাজনা দিতে হয়।
৪. শুধুমাত্র জমিতে খাজনার উদ্ভব ঘটে
এ তত্ত্ব মতে, শুধুমাত্র জমিতে খাজনার উদ্ভব ঘটে। কিন্তু আধুনিক অর্থনীতিবিদদের মতে যে কোনো দুষ্প্রাপ্য উপকরণ থেকে খাজনার উদ্ভব ঘটতে পারে।
৫. পূর্ণপ্রতিযোগিতা
রিকার্ডো তার তত্ত্বে সমাজে পূর্ণপ্রতিযোগিতা ধরলেও বাস্তবে এর অস্তিত্ব নেই।
৬. ক্রমহ্রাসমান প্রান্তিক উৎপাদন বিধি
তত্ত্বটিতে এ বিধিটি কার্যকর বলে ধরা হয়েছে। কিন্তু ক্রমবর্ধমান ও সমানুপাতিক উৎপাদন বিধিতে এ তত্ত্ব অকার্যকর।
৭. খাজনা নির্ধারণ
এ তত্ত্বটিতে খাজনার উদ্ভব ও এর কারণ ব্যাখ্যা করা হয়েছে। কিন্তু খাজনা কীভাবে নির্ধারিত হয়ে তার সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা নেই।