Home » ছায়ামূল্য কি? ছায়ামূল্য পরিমাপের পদ্ধতি সমূহ আলোচনা কর।

ছায়ামূল্য কি? ছায়ামূল্য পরিমাপের পদ্ধতি সমূহ আলোচনা কর।

by TRI

ছায়ামূল্য

অনুন্নত দেশে উপকরণসমূহের দুষ্প্রাপ্যতা তুলে ধরার জন্য এমন মূল্য দরকার যা বাজার মূল্য থেকে উত্তমরূপে সঠিক চিত্রের প্রতিফলন ঘটাতে পারে। এর ধরনের মূল্যকে সাধারণত “দুষ্প্রাপ্য মূল্য” অথবা “হিসাব মূল্য” বলা হয়। জেন টিনবারগেন একে “ছায়ামূল্য” বলেন। তাঁর মতে ছায়ামূল্য হল পরিকল্পনবিদদের দ্বারা বাস্তব নিরীক্ষার মাধ্যমে উদ্ভাবিত উপকরণের অন্তর্নিহিত মূল্য।

ছায়ামূল্য পরিমাপের পদ্ধতি

ছায়ামূল্য সাধারণত দুইটা পদ্ধতির অধীনে নির্ণয় করা সম্ভব। নিম্নে সেগুলো সম্পর্কে আলোচনা করা হলো-

১. সাধারণ ভারসাম্য পদ্ধতি

এই পদ্ধতিতে সব পণ্যের চূড়ান্ত চাহিদা ও যোগান বিবেচনা না করে এদের উৎপাদনের মধ্যে ভারসাম্য বের করা হয়। এজন্য অর্থনীতির বিভিন্ন খাতের তথ্য সংগ্রহ করা হয়। তারপর প্রতিটি উপাদানের ছায়া মূল্য বীজগণিতের প্রতীক দ্বারা প্রকাশ করে সমগ্র অর্থনীতির জন্য যোগ করা হয়। ভারসাম্য মূল্যের উপর ছায়া মূল্য নির্ভরশীল। এজন্য প্রতিটি উপকরণ/দ্রব্যের মূল্য নির্ণয়ের জন্য সামগ্রিক ভারসাম্য থাকা প্রয়োজন।

ছায়া মূল্যের মূল্যায়ন দুই ভাবে করা সম্ভব- ক) ভুল/শুদ্ধি পদ্ধতিতে দ্রব্য/উপকরণ ও বৈদেশিক মুদ্রার জন্য ধরে নেয়া মূল্য এবং সব বিনিয়োগ প্রকল্পে অগ্রাধিকার প্রাপ্ত অংকের ভিত্তিতে ছায়া মূল্যের মূল্যায়ন করা হয়। এই পদ্ধতি প্রযোজ্য না হলে খ) ক্রমিক পদ্ধতির আশ্রয় গ্রহণ করা যায়। এক্ষেত্রে সব দ্রব্যের যোগান ও সব উপকরণের চাহিদার জন্য বীজ গণিতের প্রতীকে এক একটি ছায় মূল্যে সামগ্রিক চাহিদার সঙ্গে যোগানের সমতা বিধান করা হয়। তবে বিভিন্ন জটিলতা হেতু সাধারণ ভারসাম্য পদ্ধতির সাহায্যে ছায়ামূল্য নির্ধারণ করা কঠিন হয়। এর বিকল্প হিসাবে আংশিক ভারসাম্য পদ্ধতির আশ্রয় নেয়া হয়।

আরও পড়ুন:  অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের মধ্যে পার্থক্য

২. আংশিক ভারসাম্য পদ্ধতি

এই পদ্ধতির অধীনে মূলধন, শ্রম, বৈদেশিক বিনিময় ইত্যাদির ছায়ামূল্য পৃথক পৃথকভাবে নির্ধারণ করা হয়।

ক. মূলধনের ছায়ামূল্য নির্ধারণ

মূলধনের ছায়া মূল্য/সুদের ছায়া হার নিরূপণের জন্য এর চাহিদা ও যোগান সম্পর্কে জানা দরকার। তবে মূলধনের ছায়া মূল্য পরিমাপের ক্ষেত্রে অনুন্নত দেশে মূলধনের চাহিদা ও যোগানকে যেসব উপাদান প্রভাবিত করে সেগুলো একসাথে বিবেচনা করতে হবে।

অনুন্নত দেশে মূলধনের যোগান এবং সুদের হারের মধ্যে সুদূর প্রসারী সম্পর্ক বিদ্যমান। ফলে এসব দেশে মূলধনের প্রান্তিক উৎপাদনশীলতার উপর ভিত্তি করে এর ছায়া মূল্য পরিমাপ করা সম্ভব। জাতিসংঘের একটি উন্নয়ন প্রকল্প ম্যানুয়ালে মূলধনের ছায়া মূল্য নির্ধারণের জন্য নিম্নোক্ত সূত্র দেয়া হয়েছে।

মূলধনের সামাজিক আয় = দ্রব্যের মূল্য – জিনিসপত্রের ব্যয়, ক্ষয়ক্ষতি, শ্রম ব্যয় / বিনিয়োগ ব্যয় (/ = ভাগ)

খ. শ্রমের ছায়ামূল্য নির্ধারণ

শ্রমিকের শ্রেণী অনুযায়ী দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা ভিন্ন হয়। ফলে শ্রমের ছায়া মূল্য নির্ধারণ একটি কঠিন সমস্যা। দক্ষ ও অদক্ষ শ্রমের ছায়া মূল্য এক হতে পারে না। বিভিন্ন শ্রমিকের ছায়ামূল্য ভিন্ন হতে বাধ্য। অনুন্নত দেশে শ্রমের যোগান অফুরন্ত। গ্রামাঞ্চলে শ্রমিকের প্রান্তিক উৎপাদন ক্ষমতা প্রায় শূন্যের কাছাকাছি। অবশ্য এজন্য ঐ শ্রমিকের ছায় মূল্য শূন্য হতে পারে না।

এরূপ ক্ষেত্রে অদক্ষ শ্রমিকের হিসাব মূল্য বাজার মূল্য অপেক্ষা কম হবে। উদ্বৃত্ত শ্রম মানেই বেকারত্ব। আমরা যদি বেকারত্বের পরিমাণ ß শতাংশ ধরি, তবে ছায়া মূল্যের পরিমাণও ß শতাংশ হবে। অর্থাৎ চলতি মজুরি হারে শ্রমের যে অংশ কর্মহীন থাকে প্রচলিত মজুরি হার ঠিক সে অনুপাতে কমাতে হবে যাতে করে সব শ্রমের নিয়োগ সুনিশ্চিত হয়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, বেকারত্ব যদি ২৫ শতাংশ হয় তবে প্রচলিত মজুরি হার ২৫ শতাংশ কমাতে হবে এবং এটাই হলো ছায়ামূল্য। এখন সরকার বেসরকারি খাতে উক্ত অনুপাতে শ্রমিক পিছু ২৫ শতাংশ ভর্তুকি প্রদান করে ছায়া মূল্য কার্যকর করতে পারে।

গ. বৈদেশিক বিনিময়ের ছায়া মূল্য নির্ণয়

বৈদেশিক লেনদেন ঘাটতি দূর করতে ইচ্ছুক অনুন্নত দেশের জন্য বৈদেশিক মুদ্রায় ছায়া মূল্য নির্ধারণ করা একান্ত প্রয়োজন। সাধারণত উন্নয়ন পরিকল্পনায় বৈদেশিক বিনিময়ের ছায়া মূল্য রপ্তানি আয়ের জন্য বাড়তি ব্যয় এবং আমদানি বিকল্পন হেতু বৈদেশিক মুদ্রা সঞ্চয়ের জন্য বাড়তি ব্যয়ের সমান হবে। অনুন্নত দেশে রপ্তানি দ্রব্যের সংখ্যা কম। ফলে রপ্তানি আয়ের জন্য বাড়তি ব্যয়ের উপর নির্ভর করে ছায়া মূল্য নির্ণয় সহজ হলেও দ্বিতীয় পদ্ধতিতে নির্ধারণ সহজ ব্যাপার নয়। মনে করি, বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময়ের ছায়া মূল্য বাজার মূল্য থেকে ২৫ শতাংশ বেশি। এ অবস্থায় বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময়ের ব্যয় ও আয় ০.৫ হবে। 

ঘ. বাণিজ্যিক/বাজারজাত দ্রব্যের ছায়া মূল্য

বাজার অর্থনীতিতে অপূর্ণতা থাকে। এজন্য মূল্যের কাঠামো বিকৃত থাকে। ফলে দ্রব্যের মূল্য সঠিকভাবে পরিমাপ করা সম্ভব নয়। এই অবস্থায় ব্যয়-লাভ বিশ্লেষণের এসব মূল্য ব্যবহার করা সম্ভব হয় না। ফলে অর্থনীতিবিদরা প্রতিটি বাজার মূল্যের মধ্যে সামঞ্জস্য করে ব্যয় লাভ বিশ্লেষণে ব্যবহার করতে সচেষ্ট হন। আংশিক ভারসাম্যের আলোকে পণ্যের ছায়া মূল্য নিরূপণের বিষয়টি ব্যাখ্যা করা সম্ভব।

মনে করি, কোন সেচ প্রকল্পে প্রচুর সিমেন্ট দরকার। ধরা যাক এর যোগান কোন একচেটিয়া ফার্ম থেকে আসে যা পণ্যটির প্রান্তিক ব্যয় অপেক্ষা অনেক বেশি মূল্য দাবী করে। ব্যয়-লাভ বিশ্লেষকের সমস্যা হল প্রকল্প মূল্যায়নের জন্য তিনি কোন বাজার মূল্য ব্যবহার করবেন অর্থাৎ সিমেন্টের বাজার মূল্য অথবা উৎপাদকের প্রান্তিক ব্যয় এই দুইয়ের মধ্যে তিনি কোনটি ব্যবহার করবেন। এই প্রশ্নের উত্তর নির্ভর করবে সরকার প্রকল্পটি গ্রহণ করলে সিমেন্টের উৎপাদনের উপর কি প্রতিক্রিয়া পড়বে সে সম্পর্কে ব্যয় লাভ বিশ্লেষকের প্রত্যাশার উপর। যদি বিশ্লেষক প্রত্যাশা করেন প্রকল্পের প্রয়োজন অনুপাতে সিমেন্টের জাতীয় উৎপাদন বাড়বে তবে সিমেন্টের ছায়া মূল্য এর প্রান্তিক ব্যয়ের সমান হবে। পক্ষান্তরে সিমেন্টের যোগান পুরোপুরি অস্থিতিস্থাপক এবং সরকার প্রকল্প গ্রহণ করলেও যদি একই অবস্থা বিরাজ করে তাহলে এক্ষেত্রে ছায়ামূল্য নির্ধারণের কোন প্রয়োজন হবে না।

Related Posts