বিশ্বের সকল গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র তাদের সংবিধানে নাগরিকদের মৌলিক অধিকার ঘোষণা করেছে। ব্রিটেন, যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, ফ্রান্স প্রভৃতি দেশের ন্যায় ভারতের সংবিধানেও নাগরিকদের মৌলিক অধিকার সন্নিবেশিত হয়েছে।
মৌলিক অধিকার কী?
মৌলিক অধিকার বলতে বুঝায় যে অধিকারের সাথে মানুষের ব্যক্তিত্বের পূর্ণ বিকাশ ঘটে। ব্যক্তিত্ব বিকাশ মৌলিক অধিকারের হাতিয়ার হিসেবে বিবেচিত হয়। মূলত দেশের সংবিধানের মাধ্যমে নাগরিকদের যেসব অধিকার স্বীকৃত ও রক্ষিত হয় তাকে মৌলিক অধিকার বলা হয়।
ভারতের মৌলিক অধিকার
ভারতীয় সংবিধানে নাগরিকদের যেসব মৌলিক অধিকার সংযোজিত হয়েছে, অর্থাৎ ভারতের মৌলিক অধিকারগুলো কি কি সে বিষয়ে নিম্নে আলোচনা করা হল-
১. স্বাধীনতার অধিকার
ভারতীয় নাগরিকদের মৌলিক অধিকারসমূহের মধ্যে স্বাধীনতার অধিকার একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অধিকার হিসেবে স্বীকৃত। এটি সংসদীয় গণতন্ত্রের মূলভিত্তিস্বরূপ। ভারতীয় সংবিধানের ১৯ থেকে ২২ নং ধারা অনুযায়ী নাগরিকদের স্বাধীনতা সংক্রান্ত অধিকার সমূহ নিম্নরূপ-
ক. বাক স্বাধীনতা বা মতামত প্রকাশের অধিকার।
খ. শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করার অধিকার।
গ. সভা-সমিতি গঠনের অধিকার।
ঘ. স্বাধীনভাবে চলাফেরা করার অধিকার।
ঙ. ভারতের সর্বত্র সম্পত্তি ক্রয়ের অধিকার।
চ. সরকারের সমালোচনা করার অধিকার।
ছ. প্রাপ্তবয়স্কদের ভোট প্রদানের অধিকার।
জ. আইনানুযায়ী যে কোন পেশা গ্রহণের অধিকার ইত্যাদি।
২. শিক্ষার অধিকার
“Education is the backbone of a nation.” সংবিধানে বলা হয়েছে সকল নাগরিক যে কোন শিক্ষা গ্রহণ করতে পারবে এবং যে কোন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন ও পরিচালনা করতে পারবে।
৩. সাম্যের অধিকার
ভারতীয় সংবিধানের প্রস্তাবনায় সমতার আদর্শ ঘোষিত। প্রস্তাবনার সমমর্যাদা এবং সমান সুযোগের নীতি স্বীকৃতি পেয়েছে। সংবিধানের তৃতীয় অংশে ১৪-১৮ নং ধারার সাম্যের অধিকার আলোচনা করা হয়েছে। এছাড়াও সংবিধানের অন্যত্র এবং দেওয়ানি ও ফৌজদারি বিধির মাধ্যমেও সমতার নীতি স্বীকৃতি পেয়েছে। জাতি, ধর্ম, বর্ণ, নারী, পুরুষ নির্বিশেষে সকল প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিকের ভোটাধিকারের ক্ষেত্রে সমমর্যাদা স্বীকৃতি পেয়েছে।
আরও পড়ুন: ব্রিটিশ সংবিধানের বৈশিষ্ট্য আলোচনা কর
৪. ধর্মীয় অধিকার
ভারতীয় সংবিধানের ২৫ থেকে ২৮ নং ধারায় ধর্মীয় স্বাধীনতার অধিকার সংযোজিত হয়েছে। বলা হয়েছে, আইনশৃঙ্খলা ও নৈতিকতা সাপেক্ষে সকল নাগরিক যে কান ধর্ম অবলম্বন, পালন, প্রচার ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান স্থাপন করতে পারবে। জোরপূর্বক কাউকে কোন ধর্ম পালনে বাধ্য করা যাবে না। তবে ধর্মীয় স্বাধীনতা কোনভাবেই নিরঙ্কুশ ও অবাধ নয়। পরিস্থিতি সাপেক্ষে রাষ্ট্র এ স্বাধীনতার উপর হস্তক্ষেপ করতে পারে।
৫. শোষণের বিরুদ্ধে অধিকার
শোষণের বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ প্রতিবাদ জানানোর অধিকারের স্বীকৃতি ভারতীয় সংবিধানে বিধিবদ্ধ হয়েছে। শোষণ সংক্রান্ত নাগরিকদের মৌলিক অধিকারসমূহ সংবিধানের ২৩ ও ২৪ নং ধারায় বিশদভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। ২৩নং ধারা অনুযায়ী জোরপূর্বক বেকার খাটানো বা শ্রম প্রদানে বাধ্য করা এবং মানুষ ক্রয়বিক্রয় করা দণ্ডনীয় অপরাধ হিসেবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। শিশু শ্রম নিষিদ্ধ করে বলা হয়েছে ১৪ বছরের কম বয়স্ক শিশুদের কোন মিলকারখানায় বা অন্য কোন কাজে নিয়োগ করা যাবে না।
৬. সাংস্কৃতিক অধিকার
ভারতীয় নাগরিকদের মৌলিক অধিকারসমূহের মধ্যে সাংস্কৃতিক অধিকার অন্যতম। ভারতে বসবাসকারী নাগরিকদের অংশবিশেষ নিজস্ব ভাষা, লিপি ও সংস্কৃতি সংরক্ষণের বিধান সংবিধানে বিধিবদ্ধ রয়েছে। সরকার পরিচালিত প্রতিষ্ঠানসমূহে ভারতের কোন নাগরিককে ধর্ম, বর্ণ, ভাষার প্রভেদের কারণে প্রবেশাধিকার থেকে বঞ্চিত করা যাবে না। সংবিধানের ২৯নং ধারায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জন্য সংস্কৃতি সংরক্ষণের ব্যবস্থা রয়েছে।
৭. নিরাপত্তা ও গোপনীয়তার অধিকার
রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, জনশৃঙ্খলা, জনসাধারণের নৈতিকতা বা জনস্বাস্থ্যের স্বার্থে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধ সাপেক্ষে সকল নাগরিক প্রবেশ, তল্লাশি ও আটক হতে গৃহে নিরাপত্তা লাভের অধিকার পাবে এবং চিঠিপত্র ও অন্যান্য যোগাযোগে গোপনীয়তার অধিকার পাবে।
৮. সম্পত্তির অধিকার
সংবিধানের ৩১ নং ধারায় নাগরিকদের সম্পত্তির অধিকার বর্ণিত ও স্বীকৃত হয়েছে। এতে উল্লেখ করা হয়েছে যে, আইন ছাড়া কোন নাগরিক অধিকার পূরণ করতে পারে না। আর যদি তা করতে চায় তাহলে ক্ষতিপূরণ সাপেক্ষে করতে হবে।
৯. শাসনতান্ত্রিক প্রতিবিধানের অধিকার
ভারতীয় সংবিধানের ৩২ নং এবং ২২৬ নং ধারা দু’টিতে নাগরিকদের মৌলিক অধিকার রক্ষার জন্য শাসনতান্ত্রিক প্রতিবিধানের অধিকার লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। ৩২ নং ধারা অনুযায়ী মৌলিক অধিকারগুলোকে বলবৎ ও কার্যকর করার জন্য নাগরিকগণ সুপ্রিম কোর্টের নিকট আবেদন করতে পারে। সুপ্রিম কোর্ট এ অধিকারগুলোকে বলবৎ করার জন্য ৫ ধরণের নির্দেশ বা আদেশ জারি করতে পারে। যথা- Habeas Corpus, Mandamus, Prohibition, Quo-warranto, and Certionary.
১০. অন্যান্য অধিকার
উপরিউক্ত অধিকারগুলো ছাড়াও ভারতের নাগরিকরা আরও যেসব অধিকার ভোগ করে তা হল জীবন ও ব্যক্তিস্বাধীনতার অধিকার, চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা, যে কোন রাজনৈতিক সংগঠনের সদস্য হওয়ার অধিকার, আদালত কর্তৃক ন্যায়বিচার লাভের অধিকার ইত্যাদি।