বর্তমান বিশ্বের অধিকাংশ দেশেই গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। গণতান্ত্রিক চেতনা ও আদর্শের ব্যাপক বিস্তারের ফলে শাসনব্যবস্থা হিসেবে রাজতন্ত্রের অবসান অনিবার্য হয়ে পড়েছে। কিন্তু বিশ্বের প্রাচীনতম সংসদীয় গণতন্ত্রের দেশ হিসেবে ব্রিটেন রাজতন্ত্র আজও টিকে আছে।
ব্রিটেনে রাজতন্ত্র টিকে থাকার কারণ
তত্ত্বগতভাবে ব্রিটেনের রাজা বা রানী প্রভূত ক্ষমতার অধিকারী হলেও বাস্তবে তিনি নিয়মতান্ত্রিক প্রধান ছাড়া আর কিছুই নন। তিনি রাজত্ব করেন কিন্তু শাসন করেন না। স্বভাবতই এ নিয়মতান্ত্রিক প্রধানের দায়িত্ব পালনের জন্য কেন এখনও ব্রিটেনে রাজতন্ত্র টিকে আছে এ বিষয়ে প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক। নিম্নে ব্রিটেনে রাজতন্ত্র টিকে থাকার কারণ সম্পর্কে বিভিন্ন মতবাদ ও দৃষ্টান্ত আলোচনা করা হল-
১. ইংরেজ জাতির রক্ষণশীল চরিত্র
ইংরেজ জাতি প্রকৃতিগতভাবে রক্ষণশীল মনোবৃত্তি সম্পন্ন হওয়ার জন্য সুদীর্ঘকালের ঐতিহ্য সমন্বিত এ রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানকে তারা সহজেই বিনষ্ট করতে চান না। তাই ১৯৫৭ সালে লর্ড আলট্রিনচান রাজতন্ত্রের বিলোপ সাধনের প্রস্তাব করলে তার বিরুদ্ধে ব্যাপক সমালোচনার ঝড় উঠে।
২. গণতন্ত্রের বিকাশের পথে প্রতিবন্ধক নয়
বুর্জোয়া শ্রেণী বিভিন্ন প্রকার সংস্কারমূলক কাজের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সম্প্রসারণে আত্মনিয়োগ করলে ব্রিটিশ রাজশক্তি তাদের সে কাজে যথেষ্ট পরিমাণে সহায়তা করেছিল। এ প্রসঙ্গে Ogg and Link বলেছেন, “ব্রিটিশ রাজশক্তি ব্রিটেনের সরকারি ব্যবস্থায় প্রগতিশীল বিকাশের পথে কখনও বাধা হয়ে দাঁড়ায় নি।” তাই এরূপ প্রতিষ্ঠানের বিলোপ সাধনে কেউ কোনদিন আন্তরিকভাবে চেষ্টা করে নি।
৩. রাজনীতি নিরপেক্ষ
রাজশক্তি যদি রাজনীতির ঘূর্ণাবর্তে জড়িয়ে পড়ত তাহলে অনেক আগেই সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী পার্লামেন্ট আইন প্রণয়নের মাধ্যমে তার বিলোপ সাধন করত। কিন্তু রাজা বা রানী সবসময় রাজনৈতিক দলাদলির উর্ধ্বে অবস্থান করেন বলে তারা সব রাজনৈতিক দল কিংবা সর্বশ্রেণীর মানুষের কাছে আজও অতি আপনজন বলে বিবেচিত হয়।
৪. দেশপ্রেম জাগরিত করে
আপামর জনসাধারণ রাজা বা রানীকে শ্রদ্ধার চোখে দেখে এবং তাঁর প্রতি অখণ্ড আনুগত্য প্রদর্শন করে। এ আনুগত্য প্রদর্শন দেশপ্রেমেরই বহিঃপ্রকাশ।
৫. সংসদীয় ব্যবস্থার জন্য অপরিহার্য
ব্রিটেনে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ফলে রাজতন্ত্রের উপস্থিতি অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। কারণ সংসদীয় শাসনব্যবস্থার অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য হল নিয়মতান্ত্রিক রাষ্ট্রপ্রধানের উপস্থিতি। রাজশক্তির বিলোপ সাধন করা হলে শাসনকার্যে নিরবচ্ছিন্নতা দূর করার জন্য ভারতের মত একজন নিয়মতান্ত্রিক রাষ্ট্রপ্রধানের পদ সৃষ্টি করতে হবে।
আরও পড়ুন: কার্ল মার্কসের শ্রেণী সংগ্রাম তত্ত্ব আলোচনা কর
৬. ব্যয়বহুল নয়
অনেকের মতে, ব্রিটেনে রাজপদ বংশানুক্রমিক বলে অন্যান্য দেশের রাষ্ট্রপ্রধানের নির্বাচনে যে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় হয় তা এখানে হয় না। রাজতন্ত্রের পিছনে ব্যয় রাজস্বের শতকরা এক ভাগ মাত্র। দেশের শাসনব্যবস্থায় রাজপদের উপযোগিতার তুলনায় এ ব্যয় ইংরেজদের কাছে যৎসামান্য।
৭. রাজা বা রানীর ব্যক্তিগত ভূমিকা
কোন কোন রাজা বা রানীর ব্যক্তিগত চরিত্রের মাধুর্য, আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব ও দূরদর্শীতা যুক্তরাজ্যের জনগণের কাছে রাজশক্তিকে অধিকতর গ্রহণযোগ্য করে তুলেছে। উদাহরণ হিসেব হ্যানোভার বংশের রানী ভিক্টোরিয়া (১৮৩৭-১৯০১) কিংবা উইল্ডজোর বংশের রাজা পঞ্চম জর্জ (১৯১০-১৯৩৬) এর কথা বলা যায়।
৮. জাতীয় ঐক্যের প্রতীক
জনসাধারণের কাছে রাজপদ হল ঐক্যের প্রতীক, ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক, সর্বজনীন প্রতিনিধি এবং ভবিষ্যৎ আশা-আকাঙ্ক্ষার কেন্দ্রস্থল। রাজা কোন বিশেষ দল বা শ্রেণীর প্রতিনিধি নন, তিনি জাতির প্রধান। ‘সর্বসাধারণের রাজা বা রানী’ এ অনুভূতি ইংরেজদের মধ্যে দেশপ্রেমের সৃষ্টি করে।
৯. ব্রিটেনের সাথে কমনওয়েলথের সংযোগ রক্ষা
ব্রিটিশ রাজা বা রানী হলেন কমনওয়েলথের প্রধান। কমনওয়েলথভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে এটি ঐক্যের প্রতীক হিসেবে যোগসূত্র রক্ষা করে। অনেকের মতে, রাজতন্ত্রকে বাদ দিয়ে কমনওয়েলথের ঐক্য ও অস্তিত্বের কথা ভাবা যায় না।
১০. কেবিনেটকে পরামর্শ দান
মন্ত্রীদের মত রাজা বা রানীর কার্যকালের মেয়াদ রাজনৈতিক উত্থানপতনের উপর নির্ভর করে না। ফলে সুদীর্ঘকালের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে রাজা বা রানী কোন জটিল বিষয়ে কেবিনেটকে পরামর্শ দিতে পারে। সাধারণত কেবিনেটও তাকে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করে। এছাড়া বিশেষ কোন পরিস্থিতির মোকাবেলা করার জন্য কেবিনেট রাজাকে পরামর্শ দানের জন্য অনুরোধ করতে পারে।
১১. শাসক শ্রেণীর নিজস্ব প্রয়োজনে
ব্রিটেনের অধিকাংশ রাজনৈতিক দল রক্ষণশীল। ফলে তারা বৈপ্লবিক চিন্তাধারা ও পরিবর্তনকে ঠেকানোর জন্য রাজা বা রানীর ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তাকে ব্যবহার করে। ব্রিটেনের রাজতন্ত্র এভাবে কায়েমী স্বার্থের পরিপোষক হিসেবে রক্ষণশীল ভূমিকা গ্রহণ করে। অধ্যাপক লাস্কি ও বার্কার উভয়ে এ বিষয়ে মতামত পোষণ করেন।
রাজতন্ত্র গণতন্ত্রের পরিপন্থি কি না?
ব্রিটেনের রাজতন্ত্র গণতন্ত্রের পরিপন্থি নয়। কেননা, ব্রিটেনে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ফলে রাজতন্ত্রের উপস্থিতি অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। কারণ গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য হল নিয়মতান্ত্রিক রাষ্ট্রপ্রধানের উপস্থিতি। রাজতন্ত্রের বিলোপ সাধন করা হলে শাসনকার্যে নিরবচ্ছিন্নতা দূর করার জন্য একজন নিয়মতান্ত্রিক রাষ্ট্রপ্রধানের পদ সৃষ্টি করতে হবে। কিন্তু অন্যান্য গণতান্ত্রিক দেশের রাষ্ট্রপ্রধানগণ রাজনীতি নিরপেক্ষ নয় বলে শাসনকার্য পরিচালনার ক্ষেত্রে অনেক সমস্যা দেখা দেয়। অপর দিকে ব্রিটেনের রাজা বা রানী রাজনীতি নিরপেক্ষভাবে কাজ করেন বলে শাসনকার্য পরিচালনায় কোন সমস্যা সৃষ্টি হয় না। তাছাড়া রাজতন্ত্র গণতান্ত্রিক বিকাশের পথকে সুগম করে। সুতরাং, ব্রিটেনের রাজতন্ত্রকে গণতন্ত্রের পরিপন্থি বলা যায় না।