কার্ল মার্কস একজন বস্তুবাদী দার্শনিক। ঐতিহাসিক বস্তুবাদ মার্কসের অন্যতম একটি দর্শন। সমাজের দার্শনিক ব্যাখ্যায় মার্কসবাদ যে বিপ্লব ঘটিয়েছিল ঐতিহাসিক বস্তুবাদ ছিলো তার ভিত্তি। এটি সমাজ ও ইতিহাসের বস্তুবাদ ও জড়বাদকে ব্যাখ্যা করে।
ঐতিহাসিক বস্তুবাদ সম্পর্কে বলতে গিয়ে স্ট্যালিন বলেছেন, “সমাজ জীবনের ইতিহাস ও চরিত্র বিশ্লেষণের জন্য বস্তুবাদের নীতিগুলোর প্রয়োগ করাকেই ঐতিহাসিক বস্তুবাদ বলে।”
Howard Selsam বলেছেন, “দ্বন্দমূলক বস্তুবাদের নীতিসমূহ যেমনি ঐতিহাসিক বস্তুবাদের তাত্ত্বিক ভিত্তি গঠন করে, ঐতিহাসিক বস্তুবাদও তেমনি দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের উদ্ভব ও বিষয়বস্তুর সামাজিক ঐতিহাসিক ভিত্তি ও ব্যাখ্যা উপস্থাপন করে।”
কার্ল মার্কসের ঐতিহাসিক বস্তুবাদ তত্ত্ব
দার্শনিক কার্ল মার্কস বলেন, “ইতিহাসের গতিপথ অর্থনৈতিক উপাদানের দ্বারাই পরিবর্তিত হয়।” নিম্নে মার্কসের বস্তুবাদ তত্ত্ব সম্পর্কে আলোচনা করা হলো-
১. উৎপাদনের দু’টি দিক
ঐতিহাসিক বস্তুবাদ অনুযায়ী, উৎপাদনের দু’টি দিক রয়েছে। একটি হল উৎপাদন শীক্ত, শ্রমিক ও তার শ্রম ক্ষমতা, আনুষঙ্গিক যন্ত্রপাতি ইত্যাদি উৎপাদন শক্তি এবং দ্বিতীয়টি হল উৎপাদন সম্পর্ক। এটি হল উৎপাদন প্রক্রিয়ায় মানুষে মানুষে তথা শ্রেণীতে শ্রেণীতে উৎপাদনভিত্তিক পারস্পরিক সংযোগ বা সম্পর্ক।
২. সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবন ব্যবস্থার গতি প্রকৃতি
মার্কসের মতে, “উৎপাদনের উপাদানগুলো যখন যে শ্রেণীর হাতে থাকে, তখন সে শ্রেণী সমাজে প্রাধান্য লাভ করে এবং সেভাবে সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনের গতি প্রকৃতি নির্ধারিত হয়।”
৩. উৎপাদন ব্যবস্থা শ্রেণী বৈষম্য সৃষ্টি করে
উৎপাদন ব্যবস্থা সমাজকে পুঁজিপতি ও প্রলেতারিয়েত এ দুই শ্রেণীতে বিভক্ত করে। ফলে শ্রেণীসংগ্রাম শুরু হয়। অবশেষে শ্রেণীসংগ্রামের অবসান ঘটে এবং শ্রেণীহীন সমাজ গড়ে উঠে।
৪. দাস সমাজ
দাস যুগে আদিম সমাজব্যবস্থা থেকে প্রাপ্ত উৎপাদন শক্তিসমূহ অধিকতর উন্নত হয়। দাসদের নির্মমভাবে শোষণ করা হতো। তারা ছিল সকল প্রকার অধিকার থেকে বঞ্চিত। এ সমাজে দাস মালিকরাই ছিল উৎপাদনের উপকরণ এবং দাসদের মালিক। পরবর্তী সময়ে উৎপাদন শক্তি ও উৎপাদন সম্পর্কে দ্বন্দ্ব দেখা দেয় এবং দাসদের বিদ্রোহের ফলে দাস সমাজ ভেঙে গড়ে উঠে সামন্ত সমাজ।
আরও পড়ুন: রুশোর সামাজিক চুক্তি মতবাদ ব্যাখ্যা কর
ঐতিহাসিক বস্তুবাদের ব্যাখ্যা
মার্কসীয় বস্তুবাদের মূলকথা হল বস্তুই মৌল এবং মন ও সচেতনতা গৌণ। বিশ্বব্রহ্মাণ্ড অনন্ত, সময় ও বিস্তৃতিতেও তা অনন্ত। অতএব, সচেতনতা গড়ে উঠেছে বস্তুর ভিত্তিতে। এখানে অতীন্দ্রিয় কোন সত্তার সাহায্যে বস্তুজগৎকে ব্যাখ্যা করার প্রচেষ্টা অপ্রয়োজনীয় বলে মনে করা হয়েছে। উপরন্তু এ বস্তুজগতের অস্তিত্ব সমাজের মানুষের উপর নির্ভরশীল নয়। অর্থাৎ, বস্তুজগৎ সমাজের উর্ধ্বে কিন্তু সমাজ বস্তুজগতের উর্ধ্বে নয়, বরং সামাজিক চিন্তাচেতনা বস্তুজগৎ নিঃসৃত।
মার্কসীয় মতে বস্তুই প্রাথমিক চেতনা পরবর্তী সময়ের। ভাববাদীদের বক্তব্যের সমালোচনা করতে গিয়ে মার্কস বলেছেন, “চিন্তা কল্পনাপ্রসূত নয় বা আকাশ থেকে আসে না। অভিজ্ঞতার আলোকে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্যভাবেই চিন্তার প্রতিফলন ঘটে।”
সমাজ নিজেই একটি বস্তু। সমাজের বাস্তব অবস্থা থেকে সামাজিক চেতনার সৃষ্টি। এ সামাজিক চেতনা ও চিন্তা গড়ে উঠেছে সামাজিক অভিজ্ঞতার আলোকেই। তাই সামাজিক অভিজ্ঞতা অজ্ঞেয় নয়। কেননা, সমাজ বস্তুর প্রেক্ষাপটেই গড়ে উঠেছে সামাজিক অভিজ্ঞতা, কালক্রমে যা সঞ্চিত হচ্ছে মানুষের জ্ঞানের ভাণ্ডারে।
মার্কসীয় মতবাদে বস্তুবাদী ব্যাখ্যার নিমিত্তে যে পদ্ধতি ব্যবহৃত হয় তা হচ্ছে দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ। দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের ব্যাখ্যা দেওয়া হচ্ছে যে, কোন বস্তুর বিশ্লেষণ অন্য বস্তু থেকে বিচ্ছিন্ন রেখে করা যায় না। কেননা, পৃথিবীর কোন বস্তুরই স্বতন্ত্র অস্তিত্ব থাকতে পারে না।
আবার বস্তু বা ঘটনাকে বিশ্লেষণের সময় তার গতি বা পরিবর্তনের প্রতি লক্ষ্য রাখা প্রয়োজন। কেননা, প্রতিটি বস্তুই গতিশীল এবং প্রতিটি ঘটনারই উৎপত্তি এবং পরিণতি রয়েছে। আবার বস্তুর বিশ্লেষণের সময় বস্তুর গতির চরিত্র সম্বন্ধে ধারণার প্রয়োজন। এখানে মনে রাখা প্রয়োজন যে, সকল বস্তুই সামনের দিকে, উন্নতির দিকে এগিয়ে যায় এবং গতি পশ্চাদমূখী নয়।
মার্কস ও তাঁর অন্যতম সহযোগী বন্ধু ও আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনের নেতা কমরেড ফ্রেডরিখ এঙ্গেলস দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদী দর্শন সমাজের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করেন, ঐতিহাসিক পরিপ্রেক্ষিতে সমাজ বিশ্লেষণের এ বস্তুবাদী পদ্ধতি ও ব্যাখ্যাকে বলা হয় ঐতিহাসিক বস্তুবাদ।